পারকোরে দুর্দান্ত চট্টগ্রামের দুই তরুণ!
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ক্রল করতে গিয়ে হঠাৎ একটি ভিডিও সামনে আসতেই ভয়ের একটা শীতল স্রোত বেয়ে গেল! না! এটা কোন ভৌতিক বা সহিংসতাপূর্ণ দৃশ্য নয়। দু'জন তরুণ বিশাল ভবনের একটি থেকে অন্যটিতে লাফিয়ে অনায়াসে পাড়ি দিচ্ছেন। উঁচুনিচু অট্টালিকা কিংবা দুই ভবনের মাঝে থাকা বিশাল ব্যবধান, কোন বাধাই যেন থামাতে পারছে না তাদের দৌড়ের গতি। কাজটি যে দুঃসাহসিক ও ভয়ংকর তা ভিডিও'র শুরুতেই সতর্কবার্তা দিয়ে সাবধান করে দেওয়া হয়। লেখা থাকে- 'সতর্কতা: যে দুঃসাহসিক খেলাটি আপনারা দেখতে যাচ্ছেন, এটি প্রফেশনাল ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের দ্বারা পারফর্ম করা হয়েছে। তাই নিজেরা করার চেষ্টা করবেন না।'
বাড়ির ছাদ, দেয়াল দৌড়ে-লাফিয়ে পাড়ি দেওয়ার এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটিকে সাধারণভাবে নিছক পাগলামি মনে হতে পারে। তবে এটি এক ধরনের খেলা, যার নাম পারকোর। ইউরোপ, আমেরিকায় বহু আগে থেকে এই খেলার চর্চা চলে আসছে। কিন্তু আমাদের দেশে এই ভিন্নধর্মী খেলা একেবারেই নতুন। তাই চট্টগ্রামের দুই তরুণ সাজ্জাদ ও মিনহাজ এই খেলা অনুশীলন শুরু করলে অনেকেই তাদেরকে নানা কথা শুনিয়েছেন। বাড়ির সদস্যদের প্রহার থেকে শুরু করে, বন্ধুমহলের কাছেও শুনতে হয়েছিল গঞ্জনা।
নতুন পথ
চট্টগ্রামের কাজির দেউরির বাসিন্দা সাজ্জাদ ও মিনহাজ একে অপরের বাল্যকালের বন্ধু। মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ ঘানেম। অন্যদিকে ওমর ফারুক মিনহাজের একই ক্লাসে পড়ার কথা থাকলেও পারিবারিক অস্বচ্ছলতার জন্য পড়াশোনায় ইতি টানতে হয়েছিল আরও ৭ বছর আগে। কিন্তু এখনো দুজনের বন্ধুত্ব রয়ে গেছে অটল। তাই তো দু'জনে ছোটবেলা থেকে এখনো একসাথে পারকোর খেলার অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
সাজ্জাদ বলেন, "ছোটবেলায় নিনজা হাতোরি কার্টুন দেখতে বেশ ভালো লাগতো। এই কার্টুনের মূল চরিত্র 'নিনজা' দৌড়ঝাঁপ করে নানা সমস্যা সমাধান করতো। তখন খুব ইচ্ছে হতো নিনজার মতো হতে। তখন থেকেই টুকটাক দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। পরবর্তীতে বড় হয়ে জানতে পারি এটি একটি আন্তর্জাতিক খেলা, অনেকটা ভিডিও গেমের মতো। তারপর ইউটিউব দেখে পারকোর খেলা অনুশীলন শুরু করি। ৬-৭ বছরের প্র্যাক্টিস ও চেষ্টার পর আজকের এখানে পৌঁছাতে পেরেছি। যদিও আরও ভালো করার জন্য সামনে কঠোর অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে।"
চেষ্টায় মেলে সফলতা
"শুরুতেই আমরা বাড়ির ছাদে দৌড় অনুশীলনে নেমে পড়িনি। যেহেতু আমাদের দেশে পারকোর শেখার কোন প্রশিক্ষণ সেন্টার বা গ্রাউন্ড নেই। শরীরে ফ্লেক্সিবিলিটি আনতে প্রথমে বিছানা ও সমতল জায়গা থেকে লাফ দেওয়া-বিশেষ করে বালিতে লাফালাফি ও দৌড়ানো শুরু করি। ইউটিউবে বিদেশি পারকোর প্লেয়ারদের ভিডিও দেখে অনুশীলন চালিয়ে গেছি। অনুশীলন করতে যেয়ে কয়েকবার আঘাত পেয়েছি। তারপরও তীব্র আগ্রহবোধ ও নেশা কাজ করতো এই খেলায়," এভাবেই পারকোর খেলায় নিজেদের শুরুর কথা জানাচ্ছিলেন সাজ্জাদ ঘানেম।
দুই বন্ধুর মধ্যে পারকোর খেলা চলছিল বেশ। এক বছর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পেজ খুলে ভিডিও পোস্ট করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া মিলেনি বলে হতাশা থেকে ওখানেই ইতি টানতে হয়েছিল। কিছুদিন আগে তারা আরেকবার চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
এবার 'সাজ্জাদ ও মিনহাজ' নাম দিয়ে একটি পেজ খুলে নিজেদের পারকোরের ১ মিনিট ১১ সেকেন্ডের ভিডিও আপলোড করেন তারা। এবং রাতারাতি সেটাতে ১৮ লাখ মানুষের ভিউ পড়ে। ট্রেন্ডের ভাষায় যেটাকে বলা যায় 'ভাইরাল হওয়া'। বাংলাদেশে ভিন্নধর্মী এই খেলা ছিল একেবারেই নতুন কিছু। মানুষের সাধুবাদ তাদের উৎসাহ কে আরও বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি, এটা নিয়ে ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণাকে আরও মজবুত করে দিয়েছে।
প্রতিবন্ধকতা থামাতে পারেনি তাদের
ভিডিও গেম হিসেবে পারকোর খুবই জনপ্রিয়। এটাকে 'ফ্রি রানিং' অর্থাৎ বাধাহীন দৌড় বলা হলেও কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। পারকোরে একটি নির্দিষ্ট পয়েন্ট থেকে অন্য আরেকটি পয়েন্টে লাফিয়ে পাড়ি দিতে হয়। জিমন্যাস্টিকসের সাথে পারকোর খেলার একরকম সম্পর্ক রয়েছে। শরীরের নমনীয়তা ছাড়া এই খেলা অসম্ভব। কারণ এখানে দৌড়ের পাশাপাশি উচ্চতা থেকে লাফ দিতে হয়, কখনো শরীরকে গড়িয়ে পাড়ি দিতে হয় দেয়াল ও কয়েক ধাপের সিঁড়ি।
সাজ্জাদ ও মিনহাজ যে এলাকায় বড় হয়েছেন, সেখানে এটাকে খেলা নয়, পাগলামি বলেই গণ্য করেছিল লোকে। সাজ্জাদ বলেন, "আমরা এভাবে ছাদ বেয়ে লাফালাফি করতাম বলে পরিচিতরা আমাদের ঠাট্টার ছলে 'বানর' বলতো। পরিবার থেকে সবসময় একটা চাপ ছিলো, কেন পড়াশোনায় মন না দিয়ে এসব করে বেড়াচ্ছি? এগুলো করে কি হবে? মিনহাজের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। ওর জন্য চাপটা ছিলো আরও বেশি। পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারকোর বাদ দিয়ে চাকরি ও কাজ করার জন্য বলা হতো।"
"পরিবারের সাপোর্ট ও আর্থিক অবস্থা কোনটাই অনুকূলে না থাকায়, নিজেরা টাকা জমিয়ে পারকোরের জন্যে স্নিকারস জুতা কিনি। ভিডিও করতে দামী ফোন বা ক্যামেরা প্রয়োজন, যেগুলোর কোনটি আমাদের নেই। এলাকার পরিচিত এক ছোট ভাইয়ের ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করা হয়। তারপর সেটা এডিট করতে যে কম্পিউটারের প্রয়োজন, তার জন্যে আমাদের ছুটে যেতে হয় পরিচিত আরেক ভাইয়ের বাড়িতে। এভাবেই এখন পর্যন্ত ভিডিও করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। বাড়ির মালিকেরা ছাদে পারকোর করার অনুমতি দিতে চান না। এটা আমাদের অন্যতম বড় একটা সমস্যা।"
সাজ্জাদ প্রথমে দৌড়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের একটি থেকে অন্যটি পাড়ি দেন। তার পেছনে মুখে ক্যামেরা লাগিয়ে ছুটতে থাকেন তার বন্ধু ও পারকোর সঙ্গী মিনহাজ। ক্যামেরা মুখে নিয়ে ভারসাম্য রেখে দৌড়ানোর এই কাজটি মোটেও সহজ নয়। আবার পর্যাপ্ত মনোযোগের অভাবে উচ্চতা থেকে পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে ব্যাপক। কিন্তু অনুশীলনের মাধ্যমে এই বিষয়টিকে নিজেরা আয়ত্ত করে নিয়েছেন তারা দু'জনে।
সবার আগে স্ক্রিপ্ট সাজানো হয়। অর্থাৎ কোন বিল্ডিং থেকে কোন বিল্ডিং-এ লাফিয়ে যাওয়া হবে; একটা ম্যাপ নিজেদের মাথায় ঠিক করে ফেলে দু'জনে মিলে। এই কাজটি করতে তাদের প্রায় ৩০ মিনিট সময় লেগে যায়, কখনোবা ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়ে কম-বেশিও লাগতে পারে। ম্যাপ বা স্ক্রিপ্ট সাজানোর মূল কারণ হচ্ছে, অনেক বাড়ির ছাদে দড়ি টানানো থাকে, কখনো বৈদ্যুতিক তার বা খুঁটি লাগানো থাকে। তাই সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে শুরুতে তারা একটা ম্যাপ সাজিয়ে নেন।
দর্শকের অনুরোধের ভিত্তিতে সাজ্জাদ ও মিনহাজ একটি করে থিমকে সামনে রেখে পারকোর ভিডিও করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের তৃতীয় নম্বর পারকোর ভিডিওটি ছিলো টেম্পল রান গেম থিমের ওপর। যেখানে ভূতের মুখ থেকে বাচঁতে নানা বাধা পাড়ি দিয়ে দৌড়াতে থাকে গেমার। এই থিমকে সামনে রেখে তারা পরিত্যক্ত পুরোনো বাড়িগুলোকে বেছে নেন। এবং সেই পারকোর করা ভিডিওতে ভৌতিক আবহ আনতে ভয়ানক চিৎকারের শব্দ যোগ করে দেন।
তরুণ এই দুই খেলোয়াড়ের ইচ্ছা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলোতে বাংলাদেশ থেকে পারকোর খেলায় অংশ নেওয়ার। কিন্তু কীভাবে সে লক্ষ্যে পৌঁছাবেন সে পথটাও স্পষ্ট নয়। তারা চান আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে কেউ এগিয়ে আসুক, তাদের এই স্বপ্নকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে। সেই সাথে আন্তর্জাতিক পারকোরে বাংলাদেশকে বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চান সাজ্জাদ ও মিনহাজ। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে পারকোর প্রশিক্ষণ সেন্টার খোলার পরিকল্পনাও রয়েছে এই দুই খেলোয়াড়ের।