‘ডক্টর মিস সাহেবা’, ভারতবর্ষে এশিয়ার প্রথম নারী হাসপাতাল গড়ে তোলেন যিনি
১৮৭০ সালে বেরেলিতে পৌঁছানোর মাস কয়েক পরে মার্কিন মেডিকেল মিশনারি ক্লারা সোয়েন রামপুরের নবাব স্যার কালব আলি খানের সঙ্গে দেখা করতে যান। নবাব কালব আলি খানের বিস্তর জায়গাজমি ছিল। বেরেলির মেথডিস্ট চার্চের পাশে নবাবের পড়ে থাকা একখণ্ড জমিতে নারীদের জন্য হাসপাতাল ও ডিসপেনসারি বানানোর কথা বলতে তারা নবাবের কাছে গিয়েছিলেন।
সেদিন নবাবের সঙ্গে দেখা করতে এসে অভ্যর্থনার বহর দেখে অবাক হয়ে যান সোয়েন ও বেরিলির কালেক্টর সাহেব রবার্ট ড্রামন্ড। তাদেরকে পালকিতে চড়িয়ে মিছিল করে নবাবের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই মিছিলে আবার উট, হাতির ব্যবস্থাও ছিল। বিনোদনের জন্য দুজনকেই হস্তচালিত সংগীত বাক্স দেওয়া হয়। এরপর শরীরচর্চার প্রদর্শনী অনুষ্ঠান করা হয় তাদের সম্মানে।
নবাবের কাছে ওই জমির কথা পাড়া মাত্রই তিনি বলে উঠলেন, 'নিয়ে নিন, নিয়ে নিন। এমন একটা মহতী কাজে আমি খুব আনন্দের সঙ্গে ওই জমি দান করছি।' নিউইয়র্কে বোনকে পাঠানো এক চিঠিতে এমনটাই লিখেছেন সোয়েন।
এই সাক্ষাতের মাধ্যমে সোয়ানের ভারতবর্ষে কাজের সূচনা ঘটে। নবাবের জমিতে ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ওই হাসপাতালটি ছিল নারী ও শিশুদের জন্য তৈরি করা এশিয়ার প্রথম হাসপাতাল।
'ডক্টর মিস সাহেবা'
১৮৭০ সালে প্রথম নারী মেডিকেল মিশনারি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বোম্বেতে আসেন সোয়েন। পরবর্তী ২৫ বছর তিনি ভারতবর্ষের বেরেলি ও করদ রাজ্য (প্রিন্সলি স্টেট) খেত্রিতে বাস করেন। এই পঁচিশ বছরে কেবল তিনবার অল্প সময়ের জন্য নিজ দেশে ফিরেছিলেন সোয়েন।
মেথডিস্ট এপিস্কোপাল চার্চের প্রতিনিধি হিসেবে খ্রিস্ট ধর্মের বাণী প্রচার করা সোয়েনের কাজের একটি প্রয়োজনীয় অংশ ছিল। কিন্তু ভারতবর্ষে নারীদের উন্নয়নের জন্য তিনি যা করেছেন ইতিহাসে সেটিই অক্ষয় হয়ে রয়েছে।
বেরেলির হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সোয়েন নারীদেরকে নারী ও শিশু বিষয়ক চিকিৎসাবিদ্যা শিখিয়েছিলেন, সকল বালিকার যৌনতাবিষয়ক সম্মতির বিষয়ে বয়স বৃদ্ধি করার ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছিলেন এবং নবজাতক কন্যাসন্তান হত্যা বন্ধ করার পক্ষে কথা বলেছিলেন।
ভারতে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন 'ডক্টর মিস সাহেবা' নামে। নিজের বোন ও বন্ধুদের কাছে পাঠানো চিঠির সংকলন 'আ গ্লিম্পজ অভ ইন্ডিয়া' (১৯০৯) গ্রন্থে সোয়েন ভারতে কাজ করতে গিয়ে যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন সেগুলো এবং ভারতবর্ষে নারীদের নিয়ে তার দুশ্চিন্তার কথা উল্লেখ করেছেন।
ভারত ভ্রমণ
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের এলমিরাতে ১৮৩৬ সালের ১৮ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন ক্লারা সোয়েন। মা-বাবার দশ সন্তানের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। ১৮৬৬ সালে সোয়েন পেনসিলভানিয়ার উইমেনস মেডিকেল কলেজে পড়তে যান।
ওই সময় বেরেলিতে একটি অনাথাশ্রম পরিচালনা করতেন ডিডব্লিউ টমাস নামক জনৈক মিশনারি। ভারতে একজন নারী চিকিৎসকের প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে মেথডিস্ট মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। এ খবর সোয়ানের কানে যায়। তিনি এটিকে 'ঈশ্বরের ইচ্ছা' বিবেচনা করে স্বেচ্ছায় কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
তখন মেথডিস্ট চার্চ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে হাসপাতাল ও অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করছিল। পীড়িতদের সাহায্য করা এই চার্চের 'সোশ্যাল গসপেল' ছিল।
১৮৬৯ সালের ১৮ নভেম্বর নিউইয়র্ক থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন সোয়ান। পরের বছর ২০ জানুয়ারি বেরেলিতে পৌঁছান তিনি। বোম্বাই থেকে বেরেলি পৌঁছানোর জন্য তিনি রেলগাড়ি, ডাকগাড়ি, ও ডুলি'র(পালকি) ওপর ভরসা করেছিলেন।
বেরেলিতে প্রথমদিন তিনি ১৪ জন রোগীকে দেখেন। তার লেখা থেকে জানা যায়, সেখানে প্রথম বছরের শেষদিকে তিনি শহর ও আশপাশের গ্রামের প্রায় ৭০টি বিভিন্ন পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় রোগীবাড়িতে যান ২৫০ বার। এছাড়া মিশনগৃহে তিনি প্রায় ১২২৫ জন রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছিলেন।
স্বাস্থ্যসেবায় নাগাল
বেরেলিতে প্রথম বছর ১৭ জন তরুণীকে মেডিকেল শিক্ষা দিতে থাকেন সোয়ান। এই শিক্ষার্থীরা তার কাছে শারীরবিদ্যা (অ্যানাটমি), শারীরতত্ত্ব (ফিজিওলজি), এবং ঔষধবিদ্যা শেখেন। অবশ্য এসব শিক্ষা দিতে হয়েছিল একজন অনুবাদকের মাধ্যমে। তিন বছর পড়ালেখা করার পর একজন সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা দেওয়ার পর তাদেরকে প্র্যাকটিস করার অনুমতি দেওয়া হয়।
বেরেলির হাসপাতালটি নারীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হাসপাতালটি সরাইখানার মতো করে তৈরি করা হয়। কারণ যেসব নারী এখানে চিকিৎসা নিতে আসতেন, তাদের সঙ্গে আরও অনেকে সঙ্গী হিসেবে আসত। তারা হাসপাতালের বাইরে ঘুমাতেন এবং রান্নাবান্না সারতেন।
খেত্রিতে গমন
১৮৮৫ সালে খেত্রির রাজা অজিত সিংহের স্ত্রী রানি চম্পাবতীজি সাহেবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে দেখতে রাজার অনুরোধে বেরেলি থেকে ৫১০ কিলোমিটার ভ্রমণ করে খেত্রি যান সোয়েন। তার চিকিৎসায় মুগ্ধ হয়ে রাজা তাকে খেত্রিতে অবস্থান করে একটি ডিসপেনসারি পরিচালনা এবং রানি ও অন্যান্য নারীদের নার্স হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার অনুরোধ জানান।
সোয়েন রাজার অনুরোধে সাড়া দেন। তবে শর্ত জুড়ে দেন রাজাকে খেত্রিতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে এবং তার সহকারি পিই পানেলকে সেটার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিতে হবে।
রাজা অজিত সিং পরে স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত হয়েছিলেন। ১৮৯৩ সালে বিবেকানন্দের আমেরিকা ভ্রমণের খরচ বহন করেছিলেন তিনি। সোয়েনের অনুরোধে স্কুল প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি ওই স্কুলে উপস্থিতি বাড়াতে তিনি পুরস্কারের ব্যবস্থাও করেন।
স্কুলে বালিকাদেরকে নতুন স্কার্ট এবং মাথার ঘোমটা দেওয়া হয়। প্রতিদিন সকালে তাদেরকে এক পাউন্ড করে ময়দা দেওয়া হতো, যা তাদের দৈনিক আয়ের সমান ছিল। যেসব নারী সপ্তাহে একদিনও স্কুলে অনুপস্থিত থাকতেন না তাদেরকে শনিবারে এক পাউন্ড ময়দা বেশি দেওয়া হতো।
খেত্রিতে প্রায় এক দশকের মতো অবস্থান করেছিলেন সোয়েন। এ সময় রাজকুমারীর সঙ্গে তার বিশেষ সখ্যতা গড়ে ওঠে। কিন্তু ১২ বছর বয়সে রাজকুমারীর বিয়ে দিয়ে দেওয়ার ঘটনায় ব্যথিত হন তিনি।
১৮৯৭ সালে খেত্রি ত্যাগ করে চূড়ান্তভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান ক্লারা সোয়ান। তবে এক দশক পরে তিনি তার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালটির জয়ন্তী উদযাপন করতে বেরেলিতে আসেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল এই হাসপাতাল। ক্লারা সোয়ান মিশন হাসপাতাল আজও মানুষকে সেবা দিচ্ছে।
সূত্র: স্ক্রল ডটইন, ইংরেজি থেকে অনূদিত