আগাথা ক্রিস্টির ‘১১ দিনের অন্তর্ধান রহস্য’ সমাধান করলেন বিবিসির ইতিহাসবিদ!
নিজের লেখা গোয়েন্দা উপন্যাসের কোনো চরিত্রের মতোই একদিন হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিলেন ইংরেজ লেখিকা আগাথা ক্রিস্টি। ১৯২৬ সালের এক দিনে নিজের বার্কশায়ারের বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যান ৬৬টি গোয়েন্দা উপন্যাসের লেখিকা, 'কুইন অব ক্রাইম' খ্যাত আগাথা ক্রিস্টি। ১১ দিন পর তাকে পাওয়া যায় বাড়ি থেকে শত শত মাইল দূরের একটি হোটেলে! বহু বছর যাবত ঐতিহাসিকরা আগাথা ক্রিস্টির 'সাময়িক অন্তর্ধান' রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করে এসেছেন, কিন্তু কোনো কূলকিনারা মেলেনি।
কিন্তু সম্প্রতি ইতিহাসবিদ লুসি ওর্সলি জানিয়েছেন, তিনি আগাথা ক্রিস্টির অন্তর্ধানের কারণ খুঁজে বের করতে পেরেছেন! তার ভাষ্যে, ওই ঘটনার সময় আগাথা ক্রিস্টি একটি বিরল মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় ভুগছিলেন এবং এর কারণ ছিল মানসিক আঘাত।
ওই সময় আগাথা ক্রিস্টির বয়স ছিল ৩৬ বছর এবং তিনি এমন একটি মানসিক অবস্থায় ছিলেন যে তিনি আত্মপরিচয় ভুলে গিয়েছিলেন। সেই সাথে অ্যামনেসিয়ায় ভুগছিলেন এবং বাড়ি থেকে দূরে, কোনোরকম পরিকল্পনা ছাড়াই ভ্রমণের ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।
ইতিহাসবিদ লুসি বলছেন, এর পেছনে দুই ধরনের মানসিক আঘাতকে কারণ হিসেবে ধরা যায়।
আগাথা ক্রিস্টি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আট মাস আগে, ১৯২৬ সালের এপ্রিলে তিনি তার মাকে হারান। মায়ের সাথে লেখিকার অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক ছিল এবং মায়ের মৃত্যুর পর হতাশায় ভুগছিলেন তিনি।
এরপর ১৯২৬ সালের আগস্টে আগাথা ক্রিস্টির স্বামী কর্নেল আর্চি ক্রিস্টি (যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একজন পাইলট হিসেবে কর্মরত ছিলেন) তার কাছ থেকে বিচ্ছেদের আবেদন করেন, কারণ তিনি আরও কমবয়সী একজন নারী, ন্যান্সি নিলের প্রেমে পড়েন ।
ইতিহাসবিদ লুসি ওর্সলি জানান, আগাথা ক্রিস্টির আত্মজীবনীমূলক বই রচনার জন্য তিনি লেখিকার অন্তর্ধানের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন। বিবিসি হিস্টোরি ম্যাগাজিনকে লুসি জানান, তিনি বিশ্বাস করেন ওই সময়ের মধ্যে আগাথা ক্রিস্টির মানসিক অবস্থা আরও খারাপের দিকে চলে গিয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, "তিনি (আগাথা ক্রিস্টি) তখন প্রায়ই বিভিন্ন কথা ভুলে যেতেন, কান্নাকাটি করতেন, ইনসমনিয়ায় ভুগছিলেন এবং স্বাভাবিক জীবনে খাপ খাইয়ে নিতে পারছিলেন না। তার মানসিক অবস্থা এতই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে তিনি আত্মহত্যা করার কথাও ভেবেছিলেন।"
ডিসেম্বর মাস চলে আসতে আসতে আগাথা ক্রিস্টি 'ফিউগ স্টেট'-এ চলে যান, অর্থাৎ এমন একটি অবস্থা যেখন ব্যক্তি নিজের পরিচয় মনে রাখতে পারে না এবং অন্য অনেক স্মৃতি হারিয়ে ফেলে।
লুসি ওর্সলি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, "এটি আসলে খুব বিরল একটি অবস্থা। এর ফলে ব্যক্তি তার স্বাভাবিক সত্ত্বা থেকে বিচ্যুত হয়ে যায় এবং অন্য একটি সত্ত্বা ধারণ করে, যাতে করে তাকে নিজের জীবনের মানসিক আঘাতগুলো নিয়ে ভাবতে না হয়।"
১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর আগাথা ক্রিস্টির তার স্বামীর সাথে বাদানুবাদ হয় এবং এর কয়েক ঘন্টার মাথায় তিনি তার সাত বছর বয়সী মেয়ে রোজালিন্ডকে বিদায় জানিয়ে বার্কশায়ারের সানিংডেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।
পরদিন সকালে সারে'র নিউল্যান্ডস কর্নারে তার গাড়িটি পার্ক করা অবস্থায় পাওয়া যায় এবং গাড়ির ভেতরে মেয়াদোত্তীর্ণ ড্রাইভিং লাইসেন্স ও জামাকাপড় পাওয়া যায়।
আগাথা ক্রিস্টির অন্তর্ধানের খবর সেসময় গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে, দেশজুড়ে তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। এক হাজারেরও বেশি পুলিশ অফিসার, ১৫০০০ স্বেচ্ছাসেবী এবং একাধিক এরোপ্লেন আগাথা ক্রিস্টিকে খোঁজার কাজে নিয়োজিত হয়।
শার্লক হোমসের লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েলও এই ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি লেখিকার একটি দস্তানা দিয়ে তাকে খুঁজে বের করতে সহায়তা করেন।
অবশেষে ১৯২৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর ইয়র্কশায়ারের হ্যারোগেট শহরের একটি হোটেলে আগাথা ক্রিস্টিকে খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে তিনি মিসেস ট্রেসা নিলে- (স্বামীর মিসট্রেসের নামের পদবী) নামে রেজিস্টার করিয়েছিলেন।
খুঁজে বের করার পরেও আগাথা ক্রিস্টি মনে করতে পারছিলেন না বিগত ১১ দিনে কী কী ঘটেছে এবং পরবর্তীতেও তিনি এ বিষয়ে আর কথা বলেননি বললেই চলে।
এ ঘটনার পর কেউ কেউ অভিযোগ করেছিলেন, আগাথা ক্রিস্টি পুরো ঘটনাটাই নাটক করেছিলেন তার স্বামীকে শিক্ষা দিতে বা তাকে হত্যা মামলায় ফাঁসাতে। কিন্তু ঐতিহাসিক লুসি ওর্সলি এর সাথে একমত নন। তিনি বলেন, "এই ঘটনার মানে নিজের স্বামীকে ফাঁসানো নয়, এর মানে হচ্ছে খুবই গুরুতর মানসিক সমস্যায় থাকা।"
১৯২৮ সালে নিজের স্বামীকে ডিভোর্স দেন আগাথা ক্রিস্টি এবং ১৯৩০ সালে তিনি ম্যাক্স ম্যালোয়ানকে বিয়ে করেন।
১৯৭১ সালে আগাথা ক্রিস্টিকে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে সম্মানসূচক ডেম খেতাবে ভূষিত করা হয় (নাইটহুড পান) এবং ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে ৮৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এযাবত আগাথা ক্রিস্টির দুই বিলিয়ন বই বিক্রি হয়েছে এবং তার লেখা মঞ্চনাটক 'দ্য মাউসট্র্যাপ' রেকর্ড ৭০ বছর ধরে চলেছে।
সূত্র: ডেইলি মেইল