ভ্রমণের পাশাপাশি মেয়েদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলছে ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’
আট বছরের ছোট্ট আদৃতা, ঘুরে বেড়াতে খুব ভালোবাসে। এ পর্যন্ত ঘুরেছে সুন্দরবন, দেবতাখুম, সাজেক ও সিলেটে। ভাবছেন এইটুকু মেয়ে কী করে এতো জায়গায় ঘুরে ফেলল! আসলে ক্ষুদে এ পর্যটকের মা ছুটিছাটা পেলেই মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে। আর মা-মেয়ের চমৎকার সব ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছে "ভ্রমণকন্যা- ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ"। আদৃতা বা তার মা-ই নয়, এরকম হাজারও কিশোরী, তরুণী বা বৃদ্ধাদের ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছে সংগঠনটি।
শুরুটা হয়েছিল ২০১৬ সালে। সমগ্র দেশ ঘুরে দেখতে চেয়েছিলেন দুই তরুণ নারী চিকিৎসক ডা. সাকিয়া হক ও ডা. মানসী সাহা। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা করতে করতেই প্রতিষ্ঠা করেন 'ভ্রমণকন্যা: দ্য ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ'।
২০১৭ সালে ভ্রমণের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতার অংশ হিসেবেও প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করতে চাইলেন তারা। আর তাইতো নিজ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর শেকড়ের টানে ঝড়-বাদল-রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কেবল দুটি স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তারা। উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করা, একইসঙ্গে দেশের ৬৪ জেলা ঘুরে দেখা। এভাবেই গল্পচ্ছলে ভ্রমণকন্যার শুরুর দিকের কথা জানাচ্ছিলেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মানসী সাহা।
একে একে জানালেন সংগঠনটির পক্ষ থেকে আয়োজিত ট্যুরের বিষয়ে, প্রথমদিকের ট্যুরগুলোর অভিজ্ঞতার কথা। জানালেন, সংগঠনটির 'নারীর চোখে বাংলাদেশ', জেন্ডার ইক্যুইটি ও এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রাম (জিপ), শিক্ষণ, ট্রাভেল গার্লস ইনের মতো বেশকিছু উদ্যোগের কথা। ভ্রমণের পাশাপাশি মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালীন বিষয়, আত্মরক্ষা, স্বাস্থ্যসচেতনা নিয়ে কাজ করতে করতে একটি সামাজিক সংগঠনে রূপ নিলো ভ্রমণকন্যা, সেসবও উঠে এলো তার কথায়।
ভ্রমণকন্যার যত কার্যক্রম
হাঁটি হাঁটি পা পা করে ৬ বছর পূর্ণ হয়েছে ভ্রমণকন্যার। শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১৩৪টি ট্যুরের আয়োজন করেছে সংগঠনটি। ভ্রমণের কথা শুনলেই অল্পবয়সী এক ঝাঁক তরুণের ঘোরাঘুরি নিয়ে যে একটি চিত্র ভেসে ওঠে মানসপটে তা ভেঙে দিয়েছে ভ্রমণকন্যা। কেননা সংগঠনটির পক্ষ থেকে আয়োজিত ট্যুরগুলোয় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন শিশু থেকে তরুণ- সব বয়সীরা।
বাংলাদেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে শুরু করে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, কোথায় নেই ভ্রমণকন্যাদের আনাগোনা! দেশের বাইরেও সংগঠনটির সদস্যরা পাড়ি জমিয়েছে বেশ কয়েকবার!
অনেকের কাছে ভ্রমণ কেবল লাক্সারি বা অবকাশের বিষয় হলেও ডা. মানসীর মতে, ভ্রমণ বিষয়টি শিক্ষারই একটি অংশ। এর মধ্য দিয়ে নিজেকে জানা, মানুষকে জানা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
ভ্রমণকন্যার ফেসবুক পেজ ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ- এ দেখা গেল, ইতিমধ্যে আগামী অক্টোবর পর্যন্ত দেশে-দেশের বাইরে প্রায় ১৫টির মতো ভ্রমণের পরিকল্পনা করা হয়ে গেছে। চলছে বুকিং কার্যক্রমও।
কীভাবে পরিচালিত হয় ভ্রমণকন্যার কার্যক্রম
ভ্রমণকন্যা মূলত ২৪ জন কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নিয়ে পরিচালিত হয়।
স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন জিপ ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। প্রতিমাসে কার্যনির্বাহী কমিটি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা দেন।
ডা. মানসী জানালেন, শিক্ষণ, ট্রাভেল গার্লস ইন- প্রকল্পগুলো থেকে ব্যয় বাদে যে পরিমাণ চাঁদা ওঠে, তার প্রায় সবটাই চলে যায় জেন্ডার ইক্যুয়িটি এন্ড এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রামে (জিপ ও ভ্রমণকন্যার অন্যান্য অনুষ্ঠানে)। তবে শিক্ষণে যারা শেখান তাদের জন্য প্রতিমাসে কিছু সম্মানীর ব্যবস্থা রয়েছে বলেও জানালেন তিনি।
শত বাধা ঠেলে
ভ্রমণকন্যাদের আজকের এ অবস্থান কিন্তু একদিনে আসেনি। প্রথমদিকে বিভিন্ন ধরনের বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে তবেই আজকের এ অবস্থানে এসেছে ভ্রমণকন্যা।
ভ্রমণকন্যার শুরুর কথা জানাচ্ছিলেন ডা. মানসী সাহা। তিনি বলেন, 'প্রথমদিকে যখন ৫১ জন মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে যেতাম, রাস্তার সবাই তাকিয়ে থাকত, মাঝেমাঝে অনেক আজেবাজে কথাও বলতো। কখনও কখনও এমনও হয়েছে যে, আমাদের দলের কারো সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার করেছে, ফলে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে। এজন্য যেখানে যেতাম সেখানকার ট্যুরিস্ট পুলিশ, লোকাল গাইডকে জানিয়ে রাখতাম। ব্যয়ও কমিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম সবসময়।'
'আবার প্রথমদিকে গ্রুপট্যুরগুলোতে মেয়েদের পরিবার থেকে অনেক আপত্তি আসতো। অনেকেই ফোন করে বলতো, "আপু আমাকে বাসা থেকে যেতে দিতে রাজি হচ্ছে না। একটু বুঝিয়ে বলো।" তখন তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে বুঝিয়ে বলতাম আমরা। আবার এমনও হয়েছে ষাটোর্ধ্ব অনেক আন্টিও ফোন করে বলতেন, তার ছেলে মাকে একা ছাড়তে ভয় পাচ্ছে, যেন একটু বুঝিয়ে বলি। সেক্ষেত্রে পরিবারগুলোকে বুঝিয়ে বলতে হতো যে, এতোগুলো মেয়েকে নিরাপদে নিয়ে একসঙ্গে যাচ্ছি।'
'এখন শুধু ছাত্রীরাই নয়, পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীরাও যাচ্ছে সমানতালে। এদের অনেকেই আগে পারিবারিক, চাকরি বা সুবিধার অভাবে বেড়াতে যেতে পারেননি। তারা যখন পরিবারের বাইরে থেকেও সময়টুকু খুব স্বাধীনভাবে উপভোগ করেন, যখন বলেন, 'মা জানো এই প্রথম সকালবেলা উঠে ভাবতে হয়নি, আজকে কী রান্না করতে হবে,' তখন মনে হয় আমরা যাই করেছি, যতটুকুই করেছি, ওনাদের জন্য আমরা সফল। আমাদের সঙ্গে যারা ঘুরতে গিয়েছেন, বেশিরভাগের মতেই পরিবার-পরিজন ছাড়া ওটাই ছিল তাদের প্রথম ট্যুর। পরবর্তীতে তারা নিজেরাও ঘুরতে গেছেন, তবে প্রথম বের হওয়াটা ছিল আমাদের সঙ্গেই। আমি মনে করি, সেটাও আমাদের একটা সাফল্য।
আবার 'নারীর চোখে বাংলাদেশে'ও (প্রকল্প) বেশ কয়েকবার বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাদের ছবি তুলতে না দেওয়া, পোশাক নিয়ে বিভিন্ন ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া এগুলোও দেখেছি। অন্যায় কিছু হতে দেখলে আমরা কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু ভেঙে পড়িনি, সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ জানিয়েছি।
স্কুটি চালানোর সময় তো কটু কথা, ফেসবুক পোস্টে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করা হতো, অনেক হুমকিও আসতো! বাজে কথার ছড়াছড়ি তো ছিলই। কখনও কখনও কোথাও গেলে সেখান থেকে ফেরত আসার সময় পোস্ট দিতাম। আগে বললে হামলার সম্ভাবনা থাকায় এরকম করতে হতো।'
তবে বেশিরভাগ সময় আমরা ইতিবাচক মনোভাবই পেয়েছি দেশের মানুষের কাছে। যদিও শিক্ষণ, ভ্রমণকন্যাঘর এসব কর্মকাণ্ডে আমরা অনেক অনেক দারুণ প্রতিক্রিয়া পেয়েছি।
একটি সফল ট্যুরের আত্মকাহিনী
একসঙ্গে এতোগুলো মেয়েকে নিয়ে ভ্রমণের ব্যবস্থা করা কিন্তু খুব সহজ কোনো বিষয় নয়। প্রথমে কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা ভ্রমণের স্থান নির্ধারণ করেন। এরপর ভ্রমণকন্যার ফেসবুক পেজে ট্যুরের সম্ভাব্য এলাকাগুলোর তালিকা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে প্রতিটি ট্যুরের জন্য আলাদা আলাদা করে ইভেন্ট খোলা হয় ফেসবুক পেজে। এরপর ট্যুর পরিচালনার দায়িত্বে যিনি থাকেন তিনি আগ্রহী ভ্রমণকন্যাদের তালিকা তৈরি করেন এবং সে অনুযায়ী প্রতিনিয়ত যোগাযোগের ব্যবস্থাও করেন তাদের সঙ্গে। একদম ট্যুর শেষ হওয়া পর্যন্ত নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন তিনি।
খরচ কেমন
সর্বনিম্ন আড়াই হাজার টাকা থেকে শুরু করে সাধারণত পাঁচ থেকে ছয় হাজারের মধ্যে আয়োজনের চেষ্টা করা হয় ট্যুরগুলোতে। প্রতিটি ট্যুরে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় ভ্রমণকন্যার পক্ষ থেকেই। তবে কোনো রিসোর্টে বা দেশের বাইরে থাকার পরিকল্পনা থাকলে খরচ প্রয়োজন সাপেক্ষে বাড়ে-কমে।
হোস্টিং
কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা একেকটি ট্যুর পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন বলে জানাচ্ছিলেন ভ্রমণকন্যার প্রধান তথ্য কর্মকর্তা টুম্পা প্রামাণিক। ভ্রমণের জন্য নির্ধারিত স্থান খুব ভালো করে জানা প্রয়োজন। এছাড়া স্থানীয় প্রশাসন ও লোকাল গাইডের সঙ্গে যোগাযোগ থাকাটাও খুব জরুরি বিষয়। সাধারণত ট্যুরে প্রতি ১৫ জনে একজন হোস্ট থাকেন, ভ্রমণকন্যাদের সংখ্যা যদি বেশি হয় সেক্ষেত্রে হোস্টের সংখ্যাও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
অনেক সময় প্রয়োজন হয় নতুন হোস্টের। সেক্ষেত্রে সিনিয়র সদস্যদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার পাঠানো হয় আগ্রহীদের। অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ হলে তবেই পুরো ট্যুরের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় তার কাঁধে, এমনটিই জানালেন টুম্পা।
চাইলেই কেবল মেয়েদের ভ্রমণ সংগঠন হিসেবেই থেকে যেতে পারত ভ্রমণকন্যা। তবে এতো বড় পরিসর বেছে নেওয়ার পেছনের কারণ উঠে এলো ডা. মানসীর কথাতেই।
তিনি বলেন, 'মেয়েদের অনেক বাধা-অসুবিধার জায়গা থেকে এ প্ল্যাটফর্মটির জন্ম। ভ্রমণ করতে ইচ্ছুক এমন নারীদের এক জায়গায় করার একটি ভাবনা থেকে 'ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ' বা 'ভ্রমণকন্যার' যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের জুন মাসে `নারীর চোখে বাংলাদেশ' নামে একটি প্রকল্প হাতে নেই। যার থিম ছিল স্কুটি চালিয়ে দেশের ৬৪ জেলায় ভ্রমণ এবং প্রতি জেলার একটি করে স্কুলে নারী উন্নয়ন নিয়ে কথা বলা। এছাড়া মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালীন বিভিন্ন সমস্যা, স্বাস্থ্যসচেতনতা, আত্মরক্ষা এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলা হতো প্রতিটি সেশনে। দুইবছর একমাস সময় প্রয়োজন হয় এ ক্যাম্পেইন শেষ হতে। পরবর্তীতে এ প্রকল্পটি একটু বড় পরিসরে জেন্ডার ইকুইটি এন্ড এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রাম হিসেবে হাতে নিই।'
জেন্ডার ইক্যুয়িটি এন্ড এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগাম (জিপ)
জেন্ডার ইকুইটি এন্ড এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগামের (জিপ) অধীনে এখন সংগঠনটির বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় প্রায় ৮০০ থেকে ১ হাজার জন সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবী রয়েছে। প্রত্যেকটি বিভাগকে একটি জোন করে দেওয়া হয়েছে, একজন করে জোন লিডার রয়েছে। তারা মূলত বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাসংক্রান্ত কর্মসূচিগুলো পরিচালনা করে বলে জানালেন ডা. মানসী।
মেয়েদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যে পাঁচ বছরব্যাপী প্রতি বিভাগে মাসে দুইটা করে স্কুলে এ প্রোগ্রামটি আয়োজন করা হয়। এরসঙ্গে প্রায় ১,২০০ স্বেচ্ছাসেবী সরাসরি কাজ করছেন। স্বেচ্ছাসেবীরা প্রত্যেকেই হয় শিক্ষার্থী, নয় চাকরিজীবী।
শিক্ষণ
মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য দক্ষতা প্রয়োজন। সে জায়গা থেকে সাইকেল ও স্কুটি চালনা শেখানোর লক্ষ্য থেকে 'শিক্ষণ' প্রতিষ্ঠা করে ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ। প্রথমে সাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে শুরু হয় শিক্ষণের কার্যক্রম। বর্তমানে স্কুটি চালানোর ওপরও প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছে সংগঠনটি।
সাইক্লিং শিক্ষণ
সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে গেলাম। সেদিন প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন নিসা তাবাসসুম। ততক্ষণে এক আপুর সেদিনের মতো প্রশিক্ষণ নেওয়া শেষ। জানালেন, ভ্রমণকন্যার সহায়তায় মোটামুটি ৫ দিনের ভেতরেই রপ্ত করে নিয়েছেন চালানোর পদ্ধতি। আরেকজনের ছিল ভ্রমণকন্যায় প্রথমদিনের প্রশিক্ষণ। এর আগেই সাইকেল মোটামুটি চালানো শিখে ফেলেছিলেন, তবে অনাকাঙ্ক্ষিত এক দুর্ঘটনার কারণে বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর এবার ভ্রমণকন্যার কাছে চলে এসেছেন প্রশিক্ষণ নিতে।
কথায় কথায় জানা গেল, এ পর্যন্ত ৩৭ জন সাইক্লিং-এর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, কলাবাগান, খিলগাঁও, টিএসসিসহ ৬টি জোনে মোট ৭ জন প্রশিক্ষক আছেন। যারা প্রত্যেকদিন ভোর ৬টা থেকে ৮টার মধ্যে এসব জায়গায় সাইকেল চালনা শেখান। হয়। ৭ দিনের এ কোর্সটির জন্য মোট ১২ দিন সময় পান একেকজন। ফি জনপ্রতি ১২০০ টাকা।
শেখানো হচ্ছে স্কুটিও
ভ্রমণকন্যা চায় মেয়েরা সবদিক থেকেই এগিয়ে যাক। নিজস্ব বাহন ছাড়া চলাচল দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই সাইকেলের পাশাপাশি স্কুটি চালানোরও প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছে সংগঠনটি। প্রাথমিকভাবে উত্তরায় শুরু হয়েছে এ কার্যক্রম।
আপাতত ভ্রমণকন্যা ডা. সাকিয়া হক তার ৬৪ জেলা ঘুরে বেড়ানো স্কুটিটি প্রশিক্ষণের জন্য দিয়ে দিয়েছেন।
কেমন খরচ?
যারা সাইকেল চালাতে পারেন তাদের জন্য ৪ হাজার, যারা পারেন না তাদের জন্য সাড়ে ৪ হাজার টাকা।
শিক্ষণের প্রশিক্ষক হালিমা তুজ সাদিয়া তানহা জানালেন, স্কুটি প্রশিক্ষণে যে খরচ পড়ে তার বেশিরভাগ অংশ সার্ভিসিং বাবদ ব্যয় হয়। বাকি অংশের কিছুটা প্রশিক্ষক পান, কিছুটা ভ্রমণকন্যার ফান্ডে চলে যায়।
কোনো ট্যুরের সময় এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম যাতে বন্ধ না হয়ে যায়, সেদিকেও লক্ষ্য রয়েছে ভ্রমণকন্যার। একজন কো-অর্ডিনেটর রয়েছেন যিনি কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। তিনি প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখেন।
এ বিষয়ে ডা. মানসী জানালেন, কোনো জায়গায় যেতে হলে নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত এবং বাসে বিভিন্ন আপত্তিকর ঘটনার মুখোমুখি যেন না হতে হয় সেজন্যই শিক্ষণের জন্ম। গণপরিবহনে মেয়েদের জন্য বরাদ্দ কেবল ৩ থেকে ৪টা সিট, সেসব সিটে অনেক সময় বসাও যায় না। সেজন্য নিরাপদে যাতায়াতের লক্ষ্যে সাইকেল বা স্কুটি চালানোর ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া মাইক্রোসফট অফিসের ওয়ার্ড, এক্সেল ও পাওয়ার পয়েন্টের ওপর প্রশিক্ষণের বিষয়টিও জানালেন তিনি।
ভ্রমণকন্যার ঘর, ট্রাভেল গার্লস ইন
চাকরি বা যে কোনো কাজের প্রয়োজনে অনেকসময় মেয়েদের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে থাকতে হয়। তবে সবসময় থাকার ব্যবস্থা করাটা বেশ কঠিন। এ বিষয়টি থেকেই ভ্রমণকন্যার ট্রাভেল গার্লস ইন বা ঘর ভাড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে সংগঠনটির পক্ষ থেকে।
এ প্রসঙ্গে ডা. মানসী বলেন, 'ডর্মের এ ধারণাটি এসেছে দেশের বাইরে ঘুরতে গিয়ে। বাইরের বিভিন্ন দেশে গেলে বোঝা যায় মেয়েদের বাইরে থাকাটা কতখানি নিরাপদ। একইসঙ্গে খরচও বেশ কম। ঢাকায় এ সুবিধা পাওয়াই যায় না বলতে গেলে। আমিও আমার প্রয়োজনের সময় এ সুবিধা পাইনি। আমাদের প্রায় ৬৫ হাজার সদস্য রয়েছে। তারা যদি কখনোও ঢাকায় আসে কিংবা দেশের বিভিন্ন জায়গায় যায়, তখন আমরা কোনো উপকারে আসতে পারব কিনা, এ ভাবনা থেকে ট্রাভেল গার্লস ইন চালু করা হয়।'
বর্তমানে প্রায় আড়াই বছর ধরে চলছে ডর্মটি। ঢাকার ভেতরে লালমাটিয়াতে দুটি, ঢাকার বাইরে নরসিংদী, খুলনাতেও ঘরের ব্যবস্থা করেছে ভ্রমণকন্যা। তবে বর্তমানে কক্সবাজারে যে আরও একটি ডর্ম ছিল, সেটি বন্ধ রয়েছে।
ভাড়া
শিক্ষার্থী হলে প্রতি সিট ভাড়া ৩৫০ টাকা। বাকিদের জন্য এ ভাড়ার পরিমাণ ৫০০ টাকা।
ভ্রমণকন্যার ফেসবুক ও ওয়েবসাইটে থাকা ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে প্রথমে সিট ভাড়া বুকিং দিতে হয়। পরবর্তীতে নরসিংদী বা খুলনাতে থাকতে চাইলেও একই পদ্ধতিতে যোগাযোগ করতে হবে।
ডেসটিনেশন ম্যাডনেস
একে কিছুটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট বলা যায় বলে দাবি ডা. মানসীর। কেউ যদি ভ্রমণের সঙ্গে উৎসব বা বিশেষ কোনো মুহূর্তকে যুক্ত করতে চায় তাদের জন্যই ভ্রমণকন্যার এ আয়োজন। অর্থাৎ বিয়ে বা অন্য কোনো উৎসব যদি কেউ যদি পর্যটন স্পটে গিয়ে করতে চায় তবে তা ভ্রমণকন্যার পক্ষ থেকে করে দেওয়া হবে।
লাক্সারিয়াস হাউজবোট
ভ্রমণকন্যার নতুন আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে, বেহুলা! অবাক হচ্ছেন? বেহুলা হচ্ছে, মূলত একটি হাউজ বোট। তবে ভ্রমণ বাদে অন্যান্য সময় হাউজবোটটিকে সাধারণ মানুষের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করছে ভ্রমণকন্যা
সম্প্রতি মেয়েদের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ করে দিচ্ছে ভ্রমণকন্যা। এ সংক্রান্ত বেশকিছু পোস্ট দেওয়া হয়েছে পেজটিতে। এ প্রসঙ্গ ভ্রমণকন্যার অর্থসংক্রান্ত উপদেষ্টা ও পেশায় চিকিৎসক ডা. সাদিয়াতুল মোনতাহা কিছু তথ্য জানালেন।
নতুনদের সুযোগ করে দিতেই এ উদ্যোগ। তিনি জানান, 'ভ্রমণকন্যা থেকে কার্যকরী কমিটির সদস্যরাই আগে ট্যুরগুলো পরিচালনা করতেন। তবে বর্তমানে সংগঠনটি অনেক বড় হয়ে যাওয়ায় নতুনদের উপস্থিতি খুবই প্রয়োজন।'
ভ্রমণকন্যার মতে, নতুনরা কাজ করার সুযোগ পেলেই ট্যুর হোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী কমিউনিটি তৈরি করা সম্ভব। তাই শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসার বিষয়ে জোর দেয় সংগঠনটি।
'কাজের পাশাপাশি আয়ও হোক শিক্ষার্থীদের। মোট কথা কর্মক্ষমতা বাড়ুক। এজন্য মূলত ইন্টার্ন ও কন্টেন্ট রাইটার নিতে চাচ্ছি। সংগঠন আস্তে আস্তে বড় ও সংগঠিত হচ্ছে। এজন্যই আমরা এ ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছি', বলে জানালেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডা. মানসী।
তিনি বলেন, 'বাইরের দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য পার্টটাইম জবের বিষয়টিকে অনেক গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হলেও আমাদের দেশের পরিস্থিতি তেমন না। অনেকে কাজ করলেও বিষয়টি খুব একটা প্রচলিত নয়। আমাদের ট্যুর হোস্টিং যেহেতু শুক্র-শনিবারই থাকে ফলে পড়াশোনার পাশাপাশি আর্থিকভাবেও যেমন সাফল্য আসবে, তেমনি পরবর্তীতে লিডারশিপের ক্ষেত্রেও এটি কাজে দেবে।'
প্রথমে তিনজনকে ইন্টার্নশিপের সুযোগ দেবে ভ্রমণকন্যা। এজন্য প্রথম তিনমাস গ্রুমিংয়ের পর সেখান থেকে একজন হোস্ট হিসেবে পার্টটাইম চাকরির সুযোগ পাবে।
এদিকে এ ধরনের পোস্টে মেয়েদের অভূতপূর্ব সাড়া দেখে রীতিমতো মুগ্ধ ভ্রমণকন্যা দল। দেশে তো বটেই, দেশের বাইরে থেকেও প্রচুর সাড়া পাওয়ার কথা জানালেন তারা।
করোনাকালে ভ্রমণকন্যা
সামাজিক কার্যক্রমেও পিছিয়ে নেই ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ-ভ্রমণকন্যা। ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় প্রায় সবকিছু্ই বন্ধ হয়ে যায়। সেসময় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঢাকাসহ মোট ১০টি জেলায় ত্রাণ বিতরণ করেন তারা।
একইসময়ে অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রামের আয়োজন করেন তারা। পোষা প্রাণীর যত্ন, ট্রাভেলের খুঁটিনাটি নিয়ে বিভিন্ন কথা, ঘরবন্দি জীবনকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় এসব বিষয় নিয়েও আলোচনা করে সংগঠনটি।
টুকিটাকি
শুধু ভ্রমণই নয়, ভ্রমণের বিভিন্ন গল্প নিয়ে প্রতি বছর একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করে ভ্রমণকন্যা। ২০২১ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ ম্যাগাজিনটিতে উঠে এসেছে ভ্রমণকন্যাদের সাহসী সব ভ্রমণের কথা। এছাড়া ভ্রমণকন্যার সিল সম্বলিত চাবির রিং, পাসপোর্ট কেস, টিশার্টও বের করেন তারা।
'থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে', এই নীতিকে বেদবাক্য ভেবে মনে ঠাঁই দেওয়া দুই ভ্রমণকন্যা প্রথমে হয়তো ভাবতেও পারেননি একসময় সত্যিই তাদের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হবে; দেশের হাজারও নারীর হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা করে নেবেন তারা।