আগুন নিয়ে খেলা! আগুন নিয়ে নাচা!
খোলা আকাশের নিচে কৌতূহল ও বিস্ময়ে ভরা কয়েকশ' জোড়া চোখ; কিছুক্ষণ না যেতেই মুহুর্মুহু উল্লাসে ফেটে পড়ছে চারপাশ, সবার মনোযোগ সামনের দিকে নিবদ্ধ! একটু এগোতেই চোখে পড়ে একটা স্টেজ, তিউনিসিয়ীয় মিউজিকের তালে তালে যেখানে দেখানো হচ্ছে 'আগুন নাচ'!
কখনও একজন, কখনওবা যৌথভাবে আগুনের গোলা নিয়ে হাত ঘোরাচ্ছেন; আবার কখনও মুখ দিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে আগুনের হল্কা! বেশ কয়েকটি লোহার শিক একসঙ্গে নিয়ে আগুনের মশালের মতো তৈরি করে, তার সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনা বা 'ফায়ার ড্যান্সের' প্রচলন বাংলাদেশে খুব একটা নেই বললেই চলে।
দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের লেলিহান শিখা, তার সঙ্গে মিউজিকের তালে তালে এ ধরনের নাচের মাধ্যমে এরমধ্যেই সবার মন জয় করে নিয়েছে `ফায়ার ড্যান্স বিডি ম্যাক্স' নামে একটি দল।
ফায়ারওয়ার্কস বা আতশবাজির পাশাপাশি পয়, ট্রন, সোভার মতো পাশ্চাত্যঘেঁষা বেশ কয়েকধরনের নাচেও তাদের ভূমিকা দারুণ। ফায়ারওয়ার্ক ড্যান্সের ভেতর সবচেয়ে পরিচিত মাধ্যম 'পয় ড্যান্স'। রিং বা বেশ কয়েকটি লোহার শিকে আগুন ধরিয়ে তার তালে তালে নাচের বিভিন্ন মুদ্রা ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে এরইমধ্যেই বেশ নাম কুড়িয়েছে দলটি।
ফায়ারড্যান্সের অন্যতম আরেকটি মাধ্যম 'ট্রন ড্যান্স'-এও দলটির দক্ষতা চোখে পড়ার মতোই। সম্পূর্ণ অন্ধকার পরিবেশে কস্টিউমের এলইডি লাইটগুলো জ্বলে ওঠায় যে ভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়– তার ভেতর তাদের পরিবেশনা হয়ে ওঠে নিঃসন্দেহে দারুণ উপভোগ্য।
সোভা নামে আরও একটি ওয়েস্টার্ন নাচের সঙ্গে আগুন নিয়ে খেলার কাজটি দিয়েও তারা দর্শকদের মন মাতাচ্ছেন নিয়মিতই। ফায়ার ড্যান্স বিডি ম্যাক্সের ইউটিউব পেজে গেলেই মিলবে এর প্রমাণ।
প্রথম শোয়ের অভিজ্ঞতা
আগুন নিয়ে নাচের অভিজ্ঞতা যে খুব সুখকর, তা কিন্তু নয়। অনুশীলন করতে করতে আগুনের আঁচ লাগার ঘটনাও কিন্তু এ শিল্পীদের নেহায়েত কম নয়। আলাপ হলো দলটির প্রতিষ্ঠাতা আয়ান খান ওরফে ম্যাক্সের সঙ্গে।
জানালেন, ছোটবেলা থেকেই নাচ নিয়ে অনেকবেশি আগ্রহ ও ভালো লাগা কাজ করতো তার। একটু বড় হওয়ার পর থেকেই নাচের প্রতি আগ্রহ যেন অনেক বেশি বেড়ে যায়। ২০০৬ সালের দিকে প্রথম ইউটিউব দেখেই নাচ শেখা শুরু করেন তিনি। তবে প্রথমেই কিন্তু ফায়ার ড্যান্স শুরু করেননি তিনি।
২০১৬ সালের দিকে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো ফায়ার ড্যান্স করে চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে। তখনও ভরসা ছিল সেই ইউটিউবেই। সেই স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে প্রথম পারফরম্যান্সগুলোর টুকরো টুকরো অনুভূতিগুলো যেন একের পর এক ভেসে উঠছিল তার চোখে।
তবে নাচের সঙ্গে আত্তিকরণের গল্পটা এতটা সহজ ছিল না। টুকটাক পুড়ে যাওয়া বা আহত হওয়ার মতো ঘটনা যেন হাতের নস্যি। বলতে বলতেই আয়ান দেখালেন মুখের দুইপাশে দুটি ক্ষত। সম্প্রতি একটি শো শেষে আগুন নিয়ে খেলতে খেলতে হুট করেই গায়ে লেগে আহত হন বলে কিছুটা হাসির ছলেই জানালেন আয়ান।
তবে শুরুর পথটা কিন্তু মোটেও খুব একটা সহজ ছিল না তারজন্য। পরিবারের পক্ষ থেকে নাচকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেওয়ার সমর্থন ছিল না মোটেই। এরপরও দায়বদ্ধতা অংশ হিসেবে নাচ চালিয়ে গেছেন সবসময়। তৈরি করেছেন `ম্যাক্স ড্যান্স স্কুল' নামে নাচের একটি স্কুলও।
নিজের বাড়ির একটি বাড়তি ঘরে চলে সেই স্কুলের কার্যক্রম। সেই সূত্র ধরেই গেলাম রাজধানীর উত্তর বাড্ডায়। বেশ বড় একটা ঘর। ভেতরে চলছে নাচের মহড়া। যদিও আয়ানের ভাষ্য, মাত্র একদিন আগেই দুটি বড় বড় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করায় সেদিন স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল কিছুটা কম। নিয়মিতভাবে অনুশীলন করেন বা শেখেন এমন ২০ থেকে ২২ জনের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে তার স্কুলে। শনি থেকে মঙ্গল মোট ৪ দিন স্কুলটি খোলা থাকে তার স্কুলটি।
বাড়ির ছাদেই যখন প্র্যাকটিস
আগুনের তালে নাচ! শুনতে যেমন ভয় ভয় লাগে, কাজটাও কিন্তু যথেষ্টই ভয়ের। এ নাচ রপ্তের বিষয়টি কিন্তু মোটেই ছেলেখেলা নয়। এজন্য আগে ভালোমতো রপ্ত করতে হবে নাচ। তবে পরিপক্কতা যতই আসুক, দিনের পর দিন অনুশীলন ছাড়া কিন্তু ফায়ার ড্যান্সের ক্ষেত্রে স্টেজে ওঠা সম্ভব নয়।
তাই স্কুলটিতে ভর্তির শুরুতেই কিন্তু আগুন নাচের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না, বরং নাচ শেখার ওপরই বেশি জোর দেওয়া হয়। নাচের ওপর কিছুটা দখল এলে সেইসময় শুরু হয় আসল প্রশিক্ষণ। তখনই শুরু হয় আগুন নাচের আসল ধাপ, এমনটি জানাচ্ছিলেন আয়ান। তাই আগুনের অনুশীলনের জন্য বেছে নিয়েছেন নিজেদের বাড়ির ছাদকেই।
তবে আয়ানের মতে, নাচ শিখলেই যে আগুনের সঙ্গে নাচাও শিখতে হবে, তা কিন্তু নয়। এজন্য অদম্য সাহস, মনোবল আর ইচ্ছাটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
যখন ফায়ার ড্যান্স প্র্যাকটিস করেন, সেসময় আশেপাশের বিল্ডিংগুলোর সবাই তাদের রিহার্সেল দেখতে ছাদে উঠে পড়ে। এমনকি রিহার্সেল ভালো হলে, চেঁচিয়ে উৎসাহ দেওয়ার সংখ্যাও নিতান্তই কম নয় বলে জানাচ্ছিলেন তিনি। কথাগুলো বলতে বলতে, ছড়িয়ে পড়া হাসির ছটাই বলে দিচ্ছিল কতটা উপভোগ্য হয়ে ওঠে তাদের সে অভিজ্ঞতাগুলো।
প্রত্যেক শোয়েই নতুনত্ব!
যেকোনো শিল্পে নতুনত্ব থাকাটা যেন অপরিহার্য। ফায়ার ড্যান্সও ব্যতিক্রম নয়। পারফরম্যান্সে নতুনত্ব আনতে কাজ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়তই, নতুন নতুন কৌশল নিয়ে কাজ করছেন আয়ান ও তার দলবল। যতবেশি নতুনত্ব থাকবে, তাদের দলের প্রতি দর্শকদের আগ্রহ ঠিক ততটাই বাড়তে থাকবে, এমনটি মনে করেন আয়ান।
ফিলিপিনো বা তিউনিসীয় মিউজিকের সঙ্গেই বেশি নাচেন তারা। কেন বাংলা গানের সঙ্গে নাচেন না?- এ প্রশ্নের জবাবে জানালেন, তারা যে ধরনের নাচ করেন, এ ধরনের নাচ সাধারণত বাংলাদেশে হয় না। আবার নাচের ধরনটা কিছু ভিন্ন হওয়ায়, বাংলা গানের সঙ্গে খুব একটা ভালোও লাগে না।
দর্শক প্রতিক্রিয়া
এ পর্যন্ত ঠিক কতগুলো শো'তে অংশ নিয়েছেন, তা আর মনে করতে পারেন না আয়ান। তবে যেকটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন, প্রত্যেকটিতেই দর্শকদের প্রতিক্রিয়া খুবই দারুণ ছিল বলে জানালেন তিনি।
অনেকসময় দর্শক সারি থেকে উত্তেজিত হয়ে অনেকেই স্টেজে চলে আসে। আর তখনই বাধে বিপত্তি। নাচ দেখে যতই খুশি হোক, আগুনের ফুলকি গায়ে লাগার সম্ভাবনাকে তো উড়িয়ে দেওয়ার জো নেই।
তাই কেউ যদি হুট করে স্টেজে চলে আসে, অথবা গায়ে আঁচ লাগার সম্ভাবনা থাকলে সঙ্গেসঙ্গেই সেই আগুন নিভিয়ে ফেলার জন্য প্রস্তুত থাকেন তার দলের সদস্যরা। শো' শুরুর পর থেকে হাত দিয়েই ব্যারিকেড তৈরি করে রাখেন ফায়ার ড্যান্স দলের সদস্যরা।
বড় দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও কম নয়
তবে প্র্যাকটিস বা অনুশীলন যে আগুনকেও বশে আনে তার জোরালো প্রমাণ আয়ান ও তার দল। তবে আগুন নিয়ে খেলা দেখালে তো স্বাভাবিকভাবেই দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে প্রচুর। যদিও এপর্যন্ত তেমন বড় কোনো দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়নি তাদের, এমনটি জানালেন আয়ান খান। আর আগুনের আঁচ যা লাগে, সর্বোচ্চ নাকি ৪দিন, এর বেশি সময় লাগে না ক্ষত সারতে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য অদম্য মনোবলই– সবচেয়ে বড় ভরসা।
তবে যত যাইহোক, যেকোনো পারফরম্যান্সের সময়ই কোনো ধরনের দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, সেজন্য সর্বোচ্চ সচেনতার ওপর খুবই জোর দেন আয়ান। কেননা, হুট করে স্টেজে তো উঠে যাওয়াই যায়। তবে আগুন নিয়ে স্টেজে ওঠা আর স্বাভাবিকভাবে স্টেজে ওঠার মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ– সে তো বলাইবাহুল্য। আর এজন্য প্রতিটি পারফরম্যান্সেই প্রায় ২২ জনের মতো একটি দল প্রস্তুত থাকে। যাতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের বিশ্রাম দেওয়া যায় অনায়াসেই।
আয় কিন্তু নেহায়েত মন্দ নয়
সারাবছরই হাতে কাজ থাকে ফায়ার ড্যান্স শিল্পীদের। তবে অক্টোবর থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে ফায়ার ড্যান্সের মৌসুম। জানা গেল, ঢাকার ভেতরে কোনো পারফরম্যান্স থাকলে সেক্ষেত্রে প্রায় ৪০ হাজার, আর ঢাকার বাইরে হলে প্রায় ৬০ হাজার টাকার চার্জ করেন তারা।
আগুন নাচের পরিসর এখনও বাংলাদেশে খুব একটা বড় নয়, তবু এরইমধ্যে আয়ান ও তার দল- জয় করেছে দর্শকদের মন, মিলেছে স্বীকৃতিও।
এবছর নারী দিবসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর হাত থেকে আয়ান খান পান বিশেষ পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি।
সমালোচনাও আছে বেশ
অনেকসময় নাচ করা বা শেখানো নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়। বিশেষ করে, যারা একাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন, তাদের মুখ থেকে প্রায়ই নানান নেতিবাচক কথা শুনতে হয়। তবে সমালোচনা শুনে থেমে যাওয়ার কোনো মানে নেই বলে বেশ স্পষ্টভাবে জানালেন আয়ান।
তারমতে, নিজস্বতা ধরে রাখতে পারলে যেকোনো কাজই করা যায়। সবকিছুর ভেতর নেতিবাচকতা খুঁজে বের করার কোনো মানে হয় না। যেকোনো কাজেই ভালোমন্দ দুটিই আছে। তাই কোনো কাজকেই ছোট করে দেখা উচিত নয় বলে বিশ্বাস করেন তিনি।
তবে ফায়ার ড্যান্স হোক বা যেকোনো শিল্প– পরিবারের সহযোগিতা অনেক বেশি প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশে ফায়ার ড্যান্সের এ পথিকৃৎ। তারমতে, সকল শিক্ষাই শিক্ষা। যেকোনো গুরুমুখী বিদ্যাকেই শিক্ষা বলা যায় বলে দাবি করেন তিনি।
তারমতে, নাচের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে, তাদের এলাকার অনেক অল্পবয়সীরা নিজেদের যেকোনো খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখতে পারছে।
তবে সহযোগিতার মাত্রা পুরোপুরি না থাকলেও, পরিবারের পক্ষ থেকে এখন আর বাধা পেতে হয় না আয়ানকে। যদিও কোথায় যাচ্ছেন, কাদের হয়ে অনুষ্ঠান করছেন- সেসব এখনও জানিয়ে যেতে হয়, বলেই হাসলেন চার ভাই-বোনের ভেতর মেজো আয়ান।
নাচই জীবন
নাচের পাশাপাশি, বাড্ডা আলাতুন্নেসা স্কুল-কলেজ থেকে এসএসসি, এইচএসসি পাশ করে স্নাতকের উদ্দেশ্যে গুলশান কমার্স কলেজে ভর্তি হন তিনি। তবে নাচ আর পুঁথিগত বিদ্যা দুটোই একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়াটা তার জন্য বেশ কষ্টসাধ্য। তবে সবকিছুর মধ্যেই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান। যদিও নাচ নিয়ে ভবিষ্যতে আরও উচ্চতর ডিগ্রি নেবেন কিনা- সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেননি।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ফায়ার ড্যান্সকে এমন একটি অবস্থানে যেতে চান আয়ান– যাতে মৃত্যুর পরও সবাই মনে রাখে তাকে। বিশেষ করে, বাংলাদেশে যারাই ফায়ার ড্যান্স নিয়ে কাজ করবে– সবাই যেন তাকে এক নামে চেনে দিনশেষে এমন স্বপ্নেই বিভোর আগুন নাচের এ স্বপ্নদ্রষ্টা।