যারা সুন্দরবনের ড্রাগন!
আমাদের ডিজেলচালিত ভটভটি নৌকাটি চারপাশ কাঁপিয়ে এগিয়ে চলছে। মোটরবোটের আওয়াজ শুনে একটা চিত্রা হরিণ একপলক আমাদের দিকে তাকিয়ে জঙ্গলের ভেতর হারিয়ে গেল। আরেকটা সারস তীর থেকে উড়াল দিলো। কিন্তু এত গমগম শব্দেও যে প্রাণীটি ভ্রুক্ষেপ করল না, সেটি হচ্ছে সুন্দরবনের বিশালকায় লোনাপানির কুমির (Crocodylus porosus)।
সজনেখালি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ঢোকার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রথম কুমিরটা দেখতে পাই। ভাটার সময় তখন কাদার বুক চিরে শ্বাসমূলগুলো বেরিয়ে এসেছে। পানি সরে যাওয়া পাড়ের ওপর সারা গায়ে কাদা মাখিয়ে মূর্তির মতো নিশ্চুপ শুয়ে আছে মহাশয়। আমাদের মোটরবোটের তীব্র শব্দেও চোখের পাতাটি পর্যন্ত ফেলল না কুমিরটি। বর্মের মতো শক্ত ত্বক, খাঁজকাটা পৃষ্ঠদেশ, ও বিশাল লেজ; চোয়ালজোড়া বন্ধ থাকলেও সুচালো হলুদ দাঁতগুলো দিব্যি দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে, মজা পাচ্ছে আমাদেরকে দেখে। 'আপনার দিকে তাকিয়ে হাসছে,' আমার গাইড রামকৃষ্ণ মণ্ডলও হেসে উঠল। সারাদিনে আরও কয়েকটা কুমিরের দেখা পেলাম। সবগুলোই মরাকাঠের মতো নিশ্চল পড়ে ছিল তীরের ওপর।
শীর্ষ জলজ শিকারি
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও ভারী সরীসৃপ হচ্ছে লোনাপানির কুমির। একটি পুরুষ কুমির ২০ ফুট পর্যন্ত বড় ও ১০০০ কেজি পর্যন্ত ভারী হতে পারে। দ্য লাস্ট অভ দ্য রুলিং রেপটাইলস: অ্যালিগেটরস, ক্রোকোডাইলস, অ্যান্ড দেয়ার কিন গ্রন্থে ডব্লিউ টি নিল ব্রিটিশ শাসনের শেষদিকে ভারতবর্ষে প্রায় ৩০ ফুট লম্বা একটি কুমির দেখার কথা বর্ণনা করেছেন যাকে তিনি 'বেঙ্গল জায়ান্ট' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
লোনাপানির কুমিরের প্রজাতিটি এর তুতোভাই ঘড়িয়াল, স্বাদুপানির কুমির (মগর), ও কেইম্যানের চেয়ে ভিন্ন। এ কুমিরের লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতা বেশি। এটি সুন্দরবনের খালে বাস করলেও সাঁতার কেটে সমুদ্রেও পৌঁছাতে পারে। এ কুমির স্বাদুপানিতেও বাস করতে পারে।
সুন্দরবনের হাঙর (রিভার শার্ক), শঙ্খচূড়, অজগর, ও বাঘের মতো ভয়ংকর জলজ শিকারিকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে শক্তিশালী শিকারি হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে এ কুমির।
খাওয়াদাওয়ায় বাছবিচার নেই কুমিরের। মাছ, পাখি, মহিষ, বুনো শূকর, রেসাস বানর, হরিণ, কাঁকড়া, সাপ সবই রোচে এর মুখে। পানিতে সাঁতার কাটা বাঘকেও দিব্যি হারিয়ে দিতে পারে কুমিরগুলো। তবে খুব বেশি দরকারে না পড়লে কারো সঙ্গে সংঘাতে যায় না এটি। মূলত হঠাৎ আক্রমণ করেই শিকারের কাজটি সারে প্রাণীটি।
আরো পড়ুন: সুন্দরবনের বাঘ আপনাকে সবসময় দেখছে
নদীর কিনারায় ডুবে চুপটি করে শিকারের আশায় বসে থাকে কুমিরগুলো। কেবল নাক আর চোখ পানির বাইরে বেরিয়ে থাকে। কোনো শিকার বেখেয়ালে কাছাকাছি চলে এলেই পানি থেকে ঝাঁপিয়ে উঠে শিকারের ঘাড় ধরে টেনে পানির নিচে নিয়ে যায়। ততক্ষণে শক্ত চোয়ালের চাপে শিকারের ঘাড় ভেঙে যায়।
তবে চোয়াল শক্ত হলেও কুমির ভালোমতো চিবোতে পারে না। তার বদলে শক্ত করে কামড়ে ধরে পানিতে শিকারকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এর শরীর ছিন্নভিন্ন করে ফেলে এটি। বর্তমানে বন্যপ্রাণী নিয়ে করা যেকোনো ডকুমেন্টারিতে কুমিরের এই 'ডেথ রোল' নিয়মিতই দেখা মেলে।
স্রোতের প্রাণী
কুমির শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণী। সূর্যের আলোর প্রয়োজন হয় বলেই নদীর পাড়ে এসে বসে থাকে এগুলো। একটি প্রাপ্তবয়স্ক কুমিরের শরীরের তাপমাত্রা ৩০-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকার প্রয়োজন হয়। গ্রীষ্মকালে কুমিরগুলো সকালে ও বিকেলে রোদ পোহায়। রোদ কড়া হলে পানিতে নেমে যায়। কিন্তু শীতকালে সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানির ওপরেই থাকে কুমিরগুলো।
সুন্দরবনে দিনে দুইবার জোয়ার-ভাটা হয়। তাই ভাটার সময় যখন বেশি সূর্যালোক পাওয়া যায়, সেসময়টাতে পাড়ে বেশি বিশ্রাম করে কুমিরগুলো। সুন্দরবনের সব প্রাণীর জীবনই জোয়ার-ভাটার মর্জির ওপর ভর করে চলে।
কিংবদন্তি
আমাদের মোটরবোট সহজাত আওয়াজ করে খালগুলোতে চষে বেড়াতে লাগল। পঞ্চমুখিনী মোহনার মুখে আরেকটি কুমিরকে রোদ পোহাতে দেখলাম। এখানে পাঁচটা বড়, প্রশস্ত নদী এসে মিলিত হয়ে সবগুলো একত্রে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। ১৭-১৮ ফুট লম্বা ওই কুমিরটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো মন্ডল, 'এ হচ্ছে কালু খান।' কালু রায়ের নাম অনুযায়ী কুমিরটির নাম রেখেছে স্থানীয়রা। খানসাহেবের সামনের বাম দিকের পায়ের একটা আঙুল নেই। 'বছরখানেক আগে ওই আঙুলটির মায়া ত্যাগ করতে হয়েছে তাকে,' জানাল মণ্ডল।
সুন্দরবনের স্থানীয় সংস্কৃতি এখানকার বুনো পরিবেশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। মণ্ডলের কাছে জানা গেল, এ ম্যানগ্রোভ বনের আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামের মৌয়াল ও জেলেরা জীবিকার উদ্দেশ্যে বনে প্রবেশ করার আগে কালু রায়ের পূজা করে নেয়। কালু রায় হচ্ছেন কুমির দেবতা। আর বনের বাঘের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করেন বনবিবি।
সুন্দরবনের আরেক বিখ্যাত কিংবদন্তি দক্ষিণ রায় ও বনবিবি'র লড়াই। লোভী, উদ্ধত ও অত্যাচারী দক্ষিণ রায় দুষ্ট এক বাঘে রূপান্তর হয়ে সুন্দরবনের অসহায় মানুষদের আক্রমণ করত। তার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্রামবাসী প্রার্থনা শুরু করলে সৃষ্টিকর্তা বনবিবিকে পাঠান।
বনবিবি ও দক্ষিণ রায়ের মধ্যে ভয়ংকর যুদ্ধ হয়। অত্যাচারী রায়ের হাত থেকে দুখে নামক এক ছেলেকে উদ্ধার করেন বনবিবি। দুখেকে নিজের পোষা কুমিরের পিঠে চড়িয়ে বাড়ি পাঠানোর আয়োজন করেন বনবিবি। ওই পোষা কুমিরের নাম সেকো। তারও পূজা করা হয় কিনা মণ্ডলের কাছে জানতে চাইলাম। 'না, মানুষ তাকে ভয় পায়। কারণ বাঘ ছাড়াও লোনাপানির কুমিরও সুন্দরবনের জেলেদের হত্যা করার জন্য বিখ্যাত। বোঝেন তো, জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ,' মণ্ডল বলে।
মানুষ-কুমির সংঘাত
সুন্দরবনে প্রতিবছর কুমিরের হামলার শিকার হয়ে বেশ কয়েকজন মানুষ মারা যায়। বিশেষ করে চিংড়ি শিকারীরা কুমিরে পেটে যান বেশি। সুন্দরবনের নারী ও কমবয়সী ছেলেমেয়েরা নদীর কিনারায় জাল ডুবিয়ে চিংড়ি ধরেন।
আর এরাই অনেক সময় কুমিরের শিকারে পরিণত হন। এ বনে বাঘের হামলায় মানুষের প্রাণ যাওয়া নিয়ে যে পরিমাণ আলোচনা হয়, কুমিরের হামলা ততটা মনোযোগ পায় না। তাই এ সমস্যার সমাধান নিয়েও কেউ তেমন মাথা ঘামায় না। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ আর কুমির দুটোই।
- ভাষান্তর: সুজন সেন গুপ্ত