শাঁখারিবাজারে তাজা শঙ্খের সেই অদ্ভুত গন্ধ আর নেই!
নরসিংদী থেকে নতুন বউ নিয়ে এসেছে সুদীপ(ছদ্মনাম)। সুদীপ থাকে ঢাকার শাঁখারিবাজারের রমাকান্ত নন্দী লেনের একটি ভাড়া বাড়িতে। কিন্তু ঘরে ঢুকতেই বাসার গন্ধে নতুন বউ দিলো বমি করে। হায় হায়! কী হলো, কী হলো রব পড়ে গেল। পরে জানা গেলো, শঙ্খের গন্ধেই টিকতে না পেরে বমি চলে এসেছে নতুন বউয়ের।
আগে যখন শ্রীলংকা থেকে বস্তায় করে ভেজা শঙ্খগুলো আসতো, গলির মুখ থেকেই নাকি এরকম দুর্গন্ধ পাওয়া যেত।
পুরোপুরি না শুকানো পর্যন্ত এই গন্ধ থাকতো। শুকিয়ে গেলে গন্ধও চলে যেত। শাঁখারী মানবচন্দ্র নাগ বলেন, 'একদম ভেজা শঙ্খ থেকে যে গন্ধ আসতো, তা রয়ে গেলে তো কেউ আর অলংকার হিসেবে শাঁখা পরতোই না।'
তাজা শঙ্খের সেই বিদঘুটে গন্ধ আর নেই
তবে এখন আর এই গন্ধ শাঁখারী বাজারে পাওয়া যায় না। শাঁখা ব্যবসা এখন ভারতমুখী হওয়ায় ভারত থেকেই নকশা করা শাঁখা চলে আসে এদেশে। তাই তাজা শঙ্খের সেই বিদঘুটে গন্ধ আর পাওয়া যায়না এখন।
চারপুরুষের ব্যবসা দেখাশোনা করছেন মানবচন্দ্র নাগ। বর্তমানের শাঁখারী বাজারের অন্যতম পুরোনো শাঁখারী তিনি। বয়সে
প্রবীণ না হলেও, অভিজ্ঞতায় ঠিকই প্রবীণ। ১৪ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে বসে এই কাজের হাতেখড়ি হয় মানবের। বাবা মারা যাবার পর আজ ৩৪ বছর ধরে তিনি নিজেই পুরোটুকু দেখাশোনা করছেন। সব মিলিয়ে ৪৪ বছর ধরে তিনি এই ব্যবসার আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো।
শুরুর দিকে শুধু শাঁখার বাইরের অংশ ঘষে মসৃণ করতেন। তখন তো মসৃণ করা সহ অন্যান্য কাজগুলো হাতেই করা হতো। পাটায় ডলে, গোল করে, রেতের দ্বারা নকশা করা হতো। মসৃণের কাজ শিখে যাওয়ার পর মেলায় যেতেন শাঁখা বিক্রি করার জন্য। লাঙ্গলবন্দের স্নান, চৌমহুনীর মেলা, সীতাকুণ্ডের মেলা, শিবরাত্রির মেলা এরকম বিভিন্ন মেলা, কীর্তন, পূজোতে যেতেন শাঁখা বিক্রি করতে।
শ্রীলঙ্কার শাঁখাগুলো হতো মানে ভালো এবং টেকসই
প্রায় ২০ বছর ধরে বাংলাদেশ ভারত থেকে শাঁখা আমদানি করছে। শিপ্রা সরকারের শঙ্খশিল্প নামক একটি গবেষণামূলক বইয়ে বলা আছে, প্রথমে বিশেষত পাকিস্তান আমলের প্রথম দিক পর্যন্ত দক্ষিণ ভারত থেকেই কাঁচামাল হিসেবে শঙ্খ আমদানি হতো। এরপর বাংলাদেশের শঙ্খ ব্যবসায়ীরা শ্রীলঙ্কা থেকে শঙ্খ আমদানি শুরু করে। কিন্তু ইম্পোর্ট লাইসেন্সের মাধ্যমে আমদানিকৃত শঙ্খের সাহায্যে যে শঙ্খবলয় নির্মাণ হয়, চাহিদার তুলনায় তা ছিল অপ্রতুল।
'ওয়েজ আর্নাস স্ক্রিমে' আমদানিকৃত শঙ্খের বিক্রয়মূল্য প্রায় দ্বিগুণ দামে আমদানিকারকরা শাখারীদের কাছ থেকে আদায় করতো। তাছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শঙ্খ আমদানি করা হতো বলে, দাম তুলনামূলকভাবে বেশি পড়তো।
মানবচন্দ্র জানালেন, ভারতের অনেক বড় বাজার। সেটা কম দামে এদেশের বাজারে আসছে। দেশে উৎপাদন করতে খরচ পড়ে এর চেয়ে বেশি। যে পরিমাণ চাহিদা আছে, সে পরিমাণ উৎপাদনের কারিগরও এখানে নেই। ভারত থেকে শঙ্খ এনে দেশে (পণ্য) তৈরি করতে খরচটা বেড়ে যায়। তাই তারা রেডিমেইডই কিনে আনেন। ফলে বাজার চলে গেছে ভারতের দিকে।
আগে মানবের বাড়িতেই কাজ করতো ১০-১২ জন কারিগর। বাইরে তো আরও ছিল। কিন্তু এখন ঘরেই আছেন একজন আর বাইরে পাঁচজন। সব মিলিয়ে ছয়জনের মতো কারিগর এখন তার।
তবে মানব ভারতমুখী হন প্রায় দশ বছর আগে। কারণ হিসেবে তিনি জানান, ভারতের শাঁখাগুলো মানে ভালো হয় না। টেকেও কম দিন। যেখানে শ্রীলঙ্কার শঙ্খ থেকে তৈরি শাঁখাগুলো হতো মানে ভালো এবং টেকসই।
একটা শঙ্খ থেকে একটা শাঁখা হতে এক সপ্তাহ লাগতো। একটা বড় শঙ্খ থেকে ছয়টা শাঁখা হতো। তার বাবা ৩০০ পিস শঙ্খ প্রতিদিন ভাংতেন বলে জানান মানবচন্দ্র।
শখ যে আমার শাঁখের করাত, আইতে যাইতে কাটে
এ শিল্পে শঙ্খ ছাড়াও প্রয়োজন শাঁখের করাত। বলয়গুলোকে অলংকৃত করার জন্য দরকার তেপায়া টুল, হাতুড়ি, নরুন, কুরা, বিলুনি, একধারা, উকো ইত্যাদি।
এছাড়া কাজের জন্য লাগে বাঁশের খুঁটি ( ১৫ ইঞ্চি লম্বা খুঁটির ৮ ইঞ্চি মাটির নিচে এবং ৭ ইঞ্চি মাটির উপরে থাকে), কাঠের পিঠলা, যাতে পিঠ ঠেকিয়ে কাজ করা যায়। কাঠের চাকাই, কুরা, ১৪ গিরা টাট-চট, তেলের বাটি, ন্যাকড়া ও শংখচূর্ণ। শাঁখারীরা কাজের সময় দেহের সামনে পাটের টাট পরে নেন।
ভারত মহাসাগরের তলদেশে শঙ্খগুলো হেঁটে বেড়ায়। ডুবুরিরা একদম সমুদ্রের তলে গিয়ে ধরে আনতো এই শঙ্খগুলো। এদেরকে তুলে এনে তীরে বালুর মধ্যে ফেলে রাখা হয়, তখন ভিতরের পেটা বের হয়ে যায়।
শঙ্খ সংগ্রহের পর শঙ্খের ওপরে এক ধরনের কালো আবরণ মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। হাইড্রোলিক অ্যাসিডের সাহায্যে সেই নোংরা আবরণ মুছে ঝকঝকে ভাব আনা হয়। এরপরের কাজ, 'কুরা' দিয়ে শঙ্খের বাড়তি অংশ ভাঙ্গা। এর নাম 'সংকাটা' বা 'পোনাকাটা'। কুরা হলো হাতললাগানো লোহার হাতুড়ি। কুরা দিয়ে পিটিয়ে গ্যারা(শংখের বাড়তি অংশ) ভেঙ্গে ফেলা হয়।
গানের কথায় আছে,
শখ যে আমার শাঁখের করাত, আইতে যাইতে কাটে
অল্প বয়সী বউ লইয়া পড়ছি আমি বাটে
এরপর এই শাঁখের করাত বা বিদ্যুৎচালিত গোলাকার করাত দিয়েই শঙ্খের মুখের অংশ ভেঙ্গে ফেলা হয়। এর নাম 'মাঝার দেওয়া'। এরপর ঝাপানির মাধ্যমে শংখের কাটা অংশ পাটায় ঘষে চ্যাপ্টা করা হয় এবং করাত দিয়ে শাঁখা কেটে বের করা হয়। কাটার সময় পানির ধারা চলতে থাকে। ফলে শাঁখা গুঁড়িয়ে যায় না।
শাঁখা কাটার পর ভিতর ও বাইরে মসৃণ করা হয় যথাক্রমে সলই কাঠের দন্ড ও পাথর দিয়ে ঘষে ঘষে। এরপর বাটালির কলমকাটা অংশ দিয়ে ফুল, লতা, ধানের শিষ, মাছ, পাখি ইত্যাদি নকশা ফুটিয়ে তোলা হয় অত্যন্ত ধৈর্য্যের সাথে।
নকশা করার পর মোম, নাইট্রিক অ্যাসিড এবং জিংক পাউডারের দ্রবণের সাহায্যে শাঁখাকে সূক্ষ্মভাবে মসৃণ করা হয়। একই দ্রবণ দিয়ে ফাটা বা পোকায় খাওয়া অংশ ভরাট করা হয়। আগুনের সাহায্যে শাঁখার ওপরের অংশ কিছুটা লাল করা হয়। এর নাম 'মালমতী'।
নেই কারিগর, নেই শিল্পীর আপন মনের মাধুরী মেশানো নকশা
তবে আগের মতো অলংকরণে তেমন যত্ন দেখা যায় না। যত্ন মানেই সময় ব্যয়। সময় ব্যয় মানেই শাঁখার দাম বেশি। কিন্তু ক্রেতারা কমদামেই শাঁখা কিনতে চায়। তাছাড়া শ্রমিকদের যে হারে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়, তা খুবই সামান্য। ফলে কারিগর আজ অনুপস্থিত, শিল্পীদের শিল্পকর্ম আজ অনুপস্থিত শাখাগুলোতে। কিন্তু কোনো প্রকার ক্যাটালগ ছাড়াই এই শাঁখাগুলোতে ফুটে উঠতো আগে শিল্পীর আপন মনের মাধুরী মেশানো নকশা।
শাঁখারিবাজারের ভেতর শাঁখারি কারিগরদের সমিতি 'শাঁখারি বাজার শঙ্খ শিল্প কারিগরি সমিতি'র কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারত থেকে শাঁখা তৈরি হয়ে আসে বলে এখানে শাঁখা তৈরির কাজ কমে গেছে। তাছাড়া ভারত থেকে আনা এই শাঁখার দাম খুব কম হওয়ায় এখানের কারিগররা অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। এছাড়া এ কাজের পারিশ্রমিক কম হওয়ায় কারিগররা অন্য পেশায় চলে গেছেন।
৪০ বছর ধরে শাঁখায় নকশার কাজ করে যাচ্ছেন অনুসুর নকশাকারী। তিনি বলেন, 'আর কোনো কাজ শিখিনি। আগে পাকিস্তান আমলে ছিলাম ১৫০-২০০ জন কারিগর। এখন ১০-১২ জন আছি আমরা ।'
পূর্বে শংখশিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য দুটো প্রতিষ্ঠান ছিল। দ্য কন-শেল ইন্ডাস্ট্রি (The conch-sheel industry) এবং দ্য কঞ্চ-শেল কো-অপারেটিভ সোসাইটি (The conch-shell Co-operative society) এই দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই। ফলে এই শিল্পে হিতে বিপরীতই হলো। আগে শ্রীলংকা থেকে আমদানিকৃত সব শঙ্খ ঢাকার শাঁখারী বাজারে আসতো। এরপর অন্যান্য জেলায় চলে যেত। এখন বেনাপোল থেকেই যার যার জেলায় আলাদাভাবে চলে যায়।
শঙ্খশিল্পের ইতিহাস সুপ্রাচীন
পুরান, ইতিহাস ও সাহিত্যেও শঙ্খের কথা বারবার এসেছে। শম্ভু মিত্রের 'দুই বাংলার লোকশিল্পচেতনা: শঙ্খশিল্প' নামক এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, দক্ষিণ ভারতের বেশ কিছু স্থানে প্রায় দু'হাজার বছর আগে শঙ্খশিল্পের প্রচলন ছিল। 'মাদুরাইক্কাকি' নামের একটি তামিল কবিতায় বলে হয়েছে, কোরকাই শহরে সৃষ্ট বিভিন শংখজাত দ্রব্য গ্রিক ও মিশরীয়ব্যবসায়ী মারফত ছড়িয়ে পড়তো সারা বিশ্বে।
প্রখ্যাত ফরাসি পর্যটক তাভার্ণিয়ে ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার শাঁখারিবাজারে এই শিল্পের প্রসার লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, ঢাকা ছাড়া শ্রীহট্ট ও পাবনাতেও শঙ্খশিল্প ছিল। জেমস ওয়াইজ জানিয়েছেন, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ পূর্ববঙ্গের শঙ্খশিল্পীদের এক –তৃতীয়াংশ থাকতেন ঢাকায়, বাকি দুই-তৃতীয়াংশ থাকতেন বাখরগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ঢাকা, বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম,টাঙ্গাইল,রংপুর, পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, হুগলি, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলা এবং কলকাতার বেশকিছু অঞ্চলে শাঁখারীরা ব্যবসা করছেন।
সেই একই রকম রয়ে গেছে শাখারী বাজারের পরিবেশ!
বুড়িগঙ্গা থেকে মাত্র আধ কিলোমিটার উত্তরে প্রায় ৩৫০ গড় দীর্ঘ একটি গলিই ঢাকার শংখশিল্পের প্রাচীন ঐতিহ্য আর গৌরব বহন করছে। এখানকার পরিবেশ নোংরা। বাড়ির প্রবেশপথ খুবই সংকীর্ণ। কারণ হিসেবে প্রবন্ধটিতে বলা হয়েছে, অনুমান করা হয়, বহিঃশত্রুর হাত থেকে সম্পদ ও নারীদের রক্ষার জন্যই এই ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। শাঁখারী বাজারের গলি যেমন সরু ও নোংরা , তেমনি বাড়ির ভিতরও। দিনের বেলাতেও বাড়ির ভিতর আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থাও নোংরা। কাজের জায়গাও অন্ধকার ও নোংরা।
শুধু একই চিত্র নেই শিল্পে...
শাঁখারীবাজারে প্রায় ১৫০ বাড়ি আছে। একসময় এখানে শঙ্খালঙ্কার ছাড়া অন্য কিছু বিক্রি হতো না। কিন্তু ক্রেতাদের অনাগ্রহের কারণে এখন এই দোকান সংখ্যা মাত্র ৫০ এ দাঁড়িয়েছে। ঔষুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকান গজিয়েছে অনেক।
বর্তমানে শাঁখারী বাজারে প্রায় ৫০ ঘর শাখারীরা আছে। চট্টগ্রামে ২ ঘর শাখারী(আগে ছিল ৮-১০ ঘর)। এরা ঢাকা থেকে শঙ্খাবলয় কিনে খুচরা বিক্রি করে। খুলনাতে আছে ৮ ঘর, পটুয়াখালীতে ৩ ঘর, ভোলায় রয়েছে ২ ঘর, ঝালকাঠিতে কয়েকবছর আগেও ছিল ১২ ঘর শাঁখারীর বাস। বরিশালের গৌরনদীর বাটাজোড়ের শঙ্খালংকার একসময় সমগ্র বাংলায় খুব নাম করেছিল। এছাড়া কয়েকবছর আগেও স্বতন্ত্র জেলা ঝালকাঠির শঙ্খবণিকরা স্বতন্ত্রভাবে উৎপাদন ও বিক্রি করতো শ্রীলংকা থেকে এনে।
এখন কেবল খুলনার জীবন দাসই গোটা বাংলাদেশে একমাত্র ব্যবসায়ী যে এখনো শ্রীলঙ্কা থেকে এখনো শঙ্খ নিয়ে আসে। সেখানে আগের ব্যবহৃত সব হাত মেশিনও আছে এখনও। তবে খুলনার এই শঙ্খালঙ্কার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় উত্তরবঙ্গের অঞ্চলগুলোতে।
অথচ, আগে ঢাকা থেকে প্রতি বছর পাঁচ লক্ষ টাকার শাঁখা বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হতো। ভারতের বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও এ-সব শাঁখা কখনো কখনো ভূটান ও মায়ানমার, নেপাল, ভূটান, চীন এমনকি আফ্রিকায় রপ্তানি হতো। এখনও কলকাতায় ঢাকার শাঁখা পাওয়া যায়।
আগে এই পেশায় কেবল শঙ্খবণিকরাই আসতো। তখন তো শঙ্খ ভেঙ্গে তা থেকে একদম শাঁখার বিক্রি করার আগ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ শাঁখারীরাই করতো। কিন্তু এখন তো শুধুই কেনাবেচার কাজ। ভারত থেকেই একদম তৈরি হয়ে আসে ফলে দক্ষ, নিপুণতার কাজ এখন আর থাকা লাগেনা। যদিও কিছু শাঁখা আসে যা মসৃণ এবং নকশা করে বিক্রি করা হয়। তবে সেটা শুধু কোনো অর্ডার এলেই হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্রেতাই এখন কম দামে রেডিমেড শাঁখা কিনতে আসে।
ফলে আগে যে মোটা শাঁখাগুলো কিনতে হতো ৪০০ দিয়ে, এখন তা ২০০-৩০০ এর মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। ২০০ থেকে শুরু করে ৮০০ এর মধ্যেই এখন শাঁখা পাওয়া যায়।
সম্পূর্ণ কেনা মাল এবং নিজস্ব শৈলী না থাকায় এখন যে কেউ-ই এই ব্যবসা করতে পারছে। অনেক মুসলিমরাও এখন শাঁখা বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত। তবে কারিগর হিসেবে নতুন কেউ এখন আর আসে না এ পেশায়।
হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলিম নারীদের হাতেও শোভা পেত শাঁখা
তবে শ্রীলংকার জায়াগায় ভারতীয় পণ্য কমদামে এলেও শঙ্খশিল্প তার জায়গা হারাচ্ছে দিনদিন। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে কোনো উদ্যোগ বা মাথাব্যাথা তো নেই-ই, এছাড়া ক্রেতা সংখ্যাও গেছে অনেকখানি। এ ব্যাপারে আরেক প্রভাবশালী শঙ্খবণিক বিদ্যুৎ কুমার নাগ জানান, আগের মতো হিন্দু নারীরা শাঁখায় আগ্রহী নয়। শাঁখা একটি মাঙ্গলিক অলংকার। তাই আগে কিছু মুসলিম নারীদেরও বিয়েতে শাঁখা পরতে দেখা যেত। কিন্তু আধুনিক হিন্দু নারীরাই যেখানে শাঁখা থেকে সরে এসেছে, মুসলিম নারীরা তো আরও নেই।'
পূজোর সময় শাঁখা বিক্রি হয় অনেক। অনেকে পূজো উপলক্ষ্যে নতুন শাঁখা বানিয়ে বা কিনে থাকে। আবার বিয়ের একবছর পর অনেকেই আসে পুরোনো শাঁখা বিক্রি করে নতুন নকশার একজোড়া কেনার জন্য। বিয়ের সময়গুলোতে বেশিরভাগ সময় বাপের বাড়ি থেকেই শাঁখা দেয়া হয়। বিধবা হলে এই শাঁখা ভেঙ্গে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় কিংবা মরণযাত্রায় স্বামীর চরণে দিয়ে দেওয়া হয়।
শাঁখার ব্যবহার বহুমাত্রিক
শঙ্খ দিয়ে নানা জিনিস তৈরি হয়। হাতের শাঁখা হলো প্রধান দিক। কিন্তু এছাড়াও, কানের টপ, খোঁপার কাঁটা, শংখের মালা, ঘড়ির চেন,আংটি, বোতাম, ব্রেস্লেট,ইত্যাদি অলংকার। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, ফুলদানি, এশট্রে, পেপার ওয়েট, আতরদানি ইত্যাদি।
সব শঙ্খ দিয়ে শাঁখা বানানো যেত না। যে শঙ্খগুলো একটু ভাঙ্গা বা যেগুলো দিয়ে শঙ্খ তৈরী করা যেত না, সেগুলো রেখে দেওয়া হতো উলুধ্বনির জন্য। যেখানে ফুঁ দিয়ে অপশক্তি ও অমঙ্গলকে দূর করার জন্য ধ্বনি বাজানো হয়।
আবার শঙ্খের ভিতরে যে ময়লা থাকে, সেটাও আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতো অনেকে। এছাড়া শঙ্খ দিয়ে তৈরী হয় পানের জন্য চুন। ত্বকের যত্নেও শঙ্খের আছে কার্যকরী ক্ষমতা, জানান বিদ্যুৎ কুমার নাগ।
শাঁখা ও শঙ্খজাত অলঙ্কার তৈরির জন্য ব্যবহৃত শঙ্খের মধ্যে তিতপুটি, রামেশ্বরি, মতি-ছালামত, পাটি, গারবেশি, কাচ্চাম্বর, ধলা, রায়াখাদ, খগা, সুর্কিচোনা, ঝাঁজি, দোয়ানি, জাডকি, কেলাকর, তিতকৌড়ি, গড়বাকি, সুরতি, দুয়ানাপাটি, আলাবিলা উল্লেখযোগ্য। আমদানিকৃত শঙ্খের মধ্যে তিতকৌড়ি শঙ্খ সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের এবং আলাবিলকে নিন্মমানের শঙ্খ বলে ধরা হতো। এখন তো একদম তৈরি হয়েই আসে তাই প্রজাতি বিশেষে আমদানি আর হয়না।
হাতের শাঁখার মধ্যেও বিভিন্ন নামের শাঁখা রয়েছে। এর মধ্যে সাতকানা, পাঁচদানা, তিনদানা, বাচ্চাদার, সাদাবালা, আউলাকেশী উল্লেখযোগ্য। সৌখিনদের জন্য রয়েছে সোনা বাঁধাই শাঁখা। কেউ সোনা দিয়ে বাঁধাতে চাইলে স্যাকরার কাছে নিয়ে যায়।
শাঁখারিবাজারের শঙ্খশিল্পী ও ব্যবসায়ীদের মতে, ভারতীয় পণ্যের বিস্তৃতিই এদেশে শাঁখা উৎপাদনকে সঙ্কুচিত করে ফেলেছে। সরকারের দিক থেকেও কোনো সাড়াশব্দ নেই। তার ওপর আধুনিকতার ছোঁয়ায় শাঁখার কদরও ক্রেতাদের কাছে কমে গেছে। ফলে ভবিষ্যতের দিনগুলোতে এই শঙ্খ ঐতিহ্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আজ প্রশ্নই বটে!