‘চাকরি খুঁজবো না চাকরি দেব’

চাকরি প্রত্যাশী আমজাদ হোসেনের গত ২বছর ধরে লাগাতার চেষ্টা করেও মিলেনি একটি ভালো মানের চাকরি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর তাকে নিয়ে পরিবারের আশার বাতি যেন আরেকটু প্রকট হয়ে জ্বলে উঠেছিল।
কিন্তু সে আশা এখন সমুদ্রের ঝটিকা ঢেউয়ে বালি ধুয়ে নেওয়ার মতো ভেসে গেছে। বেকার তকমা নিয়ে হতাশার একরাশ অভিশাপ থেকে এখন নিস্তার পথ খুঁজছেন আমজাদ। কিন্তু জানেন না কী করবেন!
উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও, অভিজ্ঞতা ও এই বিষয়ক ধারণা না থাকায় অনিশ্চিত পথে পা বাড়াতে ভরসা পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশের শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যেন হিড়িক দিয়ে বেড়ে চলেছে। জ্ঞান, দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে অনেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার হাটতে পারছেন না। এমনটাই ঘটেছিল নাঈম সরকারের সাথে। তিনি ২০১৬ সাল থেকে ব্যবসায়ের সাথে জড়িত থাকলেও; ২০২০ সালে নতুন একটি ব্যবসায় করার পরিকল্পনা নেন।
কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন হাজার খোঁজাখুঁজির পরেও দেশে কোন উদ্যোক্তা বিষয়ক পরামর্শ প্রতিষ্ঠান ও ট্রেনিং সেন্টার খুঁজে পাননি। তিনি তার এই সমস্যা কে সামগ্রিক দিক থেকে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলেন একটি প্লাটফর্ম তৈরি করবেন। যেখানে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রত্যাশীরা সবরকম সুযোগ সুবিধা পাবে।
নাঈম সরকার বলেন, "আমাদের দেশে প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণ সেন্টার ও ডিজিটাল মার্কেটিং-এর কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও; শুধু উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করে এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে নানারকম বাধা থাকে।
একজন নতুন উদ্যোক্তা কিভাবে এসব মোকাবেলা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন সেই ভাবনা থেকেই 'ইভারসিটি' প্রতিষ্ঠান চালু করা। এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের বেকার জনগোষ্ঠীকে সঠিক নির্দেশনার মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তোলা। এবং শিক্ষিত বেকারদের চাকরির পেছনে না দৌড়ে নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে স্ব স্ব ভাবনার মাধ্যমে নতুন কিছু শুরু করা"।
চাকরি খুঁজবো না চাকরি দিব
"একজন উদ্যোক্তা নতুন কোন ব্যবসায় শুরু করলে তিনি কেবল নিজের উপার্জন উৎস নিশ্চিত করছেন না, পাশাপাশি অন্যদের কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছেন। কিন্তু সামাজিকভাবে এমন কিছু ধারণা আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, যে কারণে অনেকে চাকরিকে ব্যবসায়ের থেকে অধিক সম্মানের মনে করে।
যা তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথে বড় বাধা। তাই এই ধরনের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন তখনই সম্ভব যখন এটি নিয়ে সঠিক পথনির্দেশনা ও জ্ঞান পাওয়া যাবে"- উদ্যোক্তা হওয়ার গুরুত্ব নিয়ে এমনটাই জানান 'ইভারসিটি' প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা-নাঈম সরকার।
'ইভারসিটি' একটি অনলাইন শিক্ষামূলক প্লাটফর্ম। একাডেমিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে কী পরিমাণ লাভ-ক্ষতির ঝুঁকি ও সম্ভাবনা রয়েছে, এবং সেগুলো মোকাবেলায় করণীয় কী- এসব বিষয়েও পরামর্শ দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিতে।
'ইভারসিটির' প্রতিষ্ঠাতা নাঈম সরকারের সাথে আরও ৩জন সহ-প্রতিষ্ঠাতারা হলেন- সজল চৌধুরী, মেহেরাব সরকার অভি ও নাজমুল হাসান। গত বছরের শুরু থেকে এই প্লাটফর্মটি দাড় করার কাজ শুরু করা হয় এবং ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। মাত্র ৭মাসে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষামূলক এই প্রতিষ্ঠানটি। ইতিমধ্যে অনেকেই এখান থেকে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ নিয়ে উদ্যোক্তা হয়েছেন।
অল্প দিনের যাত্রায় প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান নিবন্ধিত সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার। প্রতিষ্ঠানটির সদস্য খাতায় নাম লিখাতে কোনরকম ফি প্রয়োজন হয়না। তবে উদ্যমী ও আগ্রহী মনোভাবের উদ্যোক্তাদের নানারকম সুবিধা ও সুযোগের ব্যবস্থা করা হয় 'ইভারসিটি' প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ সেবা দেওয়া, উদ্যোক্তা মেলার আয়োজন করা, নতুন স্টার্স্ট আপের জন্যে সহায়তা করা, উদ্যোক্তাদের মধ্যে কমিউনিটি গড়ে তোলা ও বিশেষ মূল্যছাড়ের মাধ্যমে তাদেরকে উৎসাহিত করা।
নতুন এক যাত্রা
ব্যবসায় ও উদ্যোক্তা সম্পর্কিত এই ধরনের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে প্রথম হওয়ায় নাঈম সরকারের জন্যে চ্যালেঞ্জটা ছিলো বেশি। ব্যবসায় ও উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করা ভারতীয় মোটিভেশনাল স্পিকার 'ড. ভিভেক বিন্দার' কে অনুসরণ করে নাঈম তার নিজ প্রতিষ্ঠান 'ইভারসিটির' কোর্সগুলো সাজিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠান চালু করার বহু আগ থেকেই তরুণ উদ্যোক্তা নাঈম নিয়মিত 'ভিভেক বিন্দার' ভিডিও ফলো করতেন। হতাশ ছিলেন নিজ দেশে এমন কোন প্লাটফর্ম ছিলনা বলে। সেই হতাশা ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই তার মতো অন্যান্য উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে বড় একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। ঠিক করলেন কোন উদ্যোক্তা যেন তার মতো অকূল পাথারে পড়ে না যান, তাই তাদেরকে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ জ্ঞান দিতে ডিজিটাল একটি প্লাটফর্ম তৈরী করবেন।

অনলাইন মাধ্যম হলে দেশের বিভিন্ন জায়গার মানুষ এই সেবা সহজে পেতে পারবেন। তাই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অনলাইনে যাবতীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
'ইভারসিটির' থেকে একজন উদ্যোক্তা যে সকল প্রশিক্ষণ ও সেবা সুবিধা পাবে- ৩ মাস ও ৬ মাস মেয়াদী রেকর্ড কোর্স, লাইভ ক্লাস, বিজনেস কোর্স, সফট স্কিল কোর্স। এছাড়াও আছে স্পেশাল ট্রেনিং এবং বিজনেস কোচিং।
প্রতিষ্ঠানটি নতুন হলেও এখানে প্রশিক্ষক ও উপদেষ্টা হিসেবে দেশসেরা ব্যক্তিবর্গরা রয়েছেন। কর্পোরেট ট্রেইনার হিসেবে আছেন- গোলাম সাদমানি ডন, জনপ্রিয় সিনদাবাদ ডট কমের সিইও কামরুল হাসান, ন্যাচেরালের ফাউন্ডার কোচ কাঞ্চন, বিডিপ্রেনোয়ারের ফাউন্ডার এবং চাকরি খুঁজব নাকি দিবো গ্রুপের এডমিন সাজ্জাদ হোসেন।
এছাড়াও ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি কন্টিনটোর প্রতিষ্ঠাতা নাফিস কাউসারের মতো প্রতিষ্ঠিত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গরা নিয়মিত ক্লাস নেন 'ইভারসিটি'-তে।
স্কিল ডেভেলপমেন্ট কোর্সের একেকটি ক্লাসের ব্যাপ্তি ২-৩ ঘন্টা এবং ক্লাস প্রতি নির্ধারিত ফি হচ্ছে ৫০০ টাকা। এছাড়াও ৬ মাসের প্রশিক্ষণ ফি ৬ হাজার টাকা। যেখানে নগদ ৩ হাজার টাকা ও ধাপে ধাপে বাকি ৩ হাজার টাকা দেওয়ার সুবিধা রয়েছে। অনেকেই আছেন যারা অর্থের অভাবে নতুন কোন ব্যবসায় শুরু করতে পারছেন না।
উদ্যমী এই উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ায় 'ইভারসিটি'। যদি উদ্যোক্তার ব্যবসায় পরিকল্পনাটি অভিনব ও কার্যকরী মনে হয়, তখন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিনিয়োগকারীদের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এভাবেই অন্যদের স্বপ্ন পূরণে কাজ করে যাচ্ছে 'ইভারসিটি' টিম।
নাঈম সরকার বলেন, "আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে-দেশের বেকারত্ব ঘুচিয়ে উন্নত রাষ্ট্র চীন, জাপানের মতো হাজার হাজার উদ্যোক্তা গড়ে তোলা। নতুন নতুন স্টার্ট-আপ শুরু করার মাধ্যমে আমাদের দেশ অন্য উন্নত রাষ্ট্রের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে। এমনকি চাকরির ওপর নির্ভরশীলতা কমবে, যা তরুণদের তাদের মেধা কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু করতে প্রত্যয়ী করে তুলবে"।
"আমাদের কোর্স ও সেবাগুলো বর্তমানে অনলাইন ভিত্তিক হলেও সামনে আমরা আরও বৃহৎ পরিসরে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যাবো। তরুণ ও ছাত্রদের উদ্যোক্তামুখী করতে আমরা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়ার্কশপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তরুণ উদ্যোক্তারাই হয়তো একদিন আমাদের দেশ কে বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে"।