শুকনো ফুলের কাগজ, খাম আর ডায়েরির কারিগর

হাতে লেখা চিঠি আর ডিজিটাল টেক্সটের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য কী বলুন তো? আমার মনে হয় ঘ্রাণ। চিঠিতে যে স্মৃতির ঘ্রাণ মিশে থাকে টেক্সটে তার আবেশ পাওয়া যায় না কখনো। তাই তো মুহূর্তেই বার্তা পাঠানোর এই যুগেও স্মৃতিকাতর মানুষের পছন্দ জুড়ে আছে কাগুজে চিঠির আমেজ। কাগজ, চিঠি আর ঘ্রাণের এই স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখতেই ময়মনসিংহের তরুণী সান্ত্বনার কাগজ বানানোর শুরু।
ফারিহা আলভী সান্ত্বনা পড়ছেন আনন্দমোহন কলেজের গণিত বিভাগে। ছোটবেলায় যখন সবে একটু একটু লিখতে শিখছেন তখন থেকেই এক-দুই লাইনে চিঠি লিখতেন তার বন্ধু আর আত্মীয়দের কাছে। সেই থেকে চিঠি লেখার অভ্যাস আর ছাড়েননি। পত্র-বন্ধুও হয়েছিলো তার। চিঠির সাথের খামগুলোও বানিয়ে দিতেন নিজের হাতেই। ডায়েরিতে স্মরণীয় ঘটনা লিখে রাখা আর সাথে সেদিনের স্মৃতি ধরে রাখতে ফুল, পাতা, ফেলে দেওয়া কাপড় বা বোতাম লাগিয়ে রাখা ছিলো নিত্যদিনের কাজ।
ব্রহ্মপুত্রের পাড় ঘেঁষা ময়মনসিংহ শহরে সান্ত্বনাদের বাড়িটি গাছ-গাছালি আর নানা জাতের ফুলে ঘেরা। বিচিত্র ফুল-পাতার রঙ, ঘ্রাণ তাকে টানে সবসময়।

"বারান্দার শখের ফুল, উপহার হিসেবে পাওয়া বিলাসী ফুল বা রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া প্রিয় বুনো ফুলগুলো কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় তা ভাবতে ভাবতেই ফুলের কাগজ বানানোর চিন্তা এসেছিলো," বলেন সান্ত্বনা। প্রিয় ফুলকে অমর করে রাখতে চিঠি লেখার কাগজ বা স্মৃতি জমানোর ডায়েরির পাতার চেয়ে ভালো গন্তব্য আর কী হতে পারে!
কাগজ বানানোর অল্প-বিস্তর অভিজ্ঞতা আগে থেকেই ছিল সান্ত্বনার। ফুল সংরক্ষণের নানা উপায় নিয়ে ইন্টারনেট ঘাটতে ঘাটতে শিখে যান রঙ ঠিক রেখে কাগজের সাথে ফুল মেশানোর প্রক্রিয়াও। প্রিয় মানুষদের জন্য কাঁচা হাতে ফুলের কাগজ আর ডায়েরি বানাতে শুরু করেন এরপর। শুকনো ফুল-পাতা, পুরোনো খাতাপত্র বা অব্যবহৃত জামা-কাপড় কিছুই ফেলতে চাইতেন না তিনি। সব কিছুই তাই রিসাইকেল করে তৈরি করেন নতুন কাগজ, ডায়েরি, খাম বা জার্নাল।
সান্ত্বনার সৃজনশীলতায় মুগ্ধ হয়ে তার বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বোনেরা উৎসাহ দিতেন অনলাইনে ডায়েরিগুলো বিক্রি করতে। সান্ত্বনার কথা, "আমার কাছ থেকে কে এগুলো কিনবে তা ভেবেই আগাতে চাইতাম না আমি। পেন-ফ্রেন্ডও আমাকে তাগদা দিতো খুব। সবাই বলতো এগুলো মানুষকে দেখানো উচিত। একদিন দুই ছোট বোন মিলে জোর করেই পেইজ খুলে দেয়। ছোট ভাই বলতো আমার বানানো কাগজগুলো দেখলেই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে! তার পরামর্শেই তাই পেইজের নাম ঠিক হয় 'Cheesy Paper'।"
২০২১ সালের মার্চ মাস থেকে অনলাইনে শুরু হয় সান্ত্বনার কাজ।

কুড়িয়ে পাওয়া দুর্লভ এক নীল রঙা ফুল শুকিয়ে বানানো ডায়েরি ছিলো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তৈরি চিজি পেপারের প্রথম পণ্য। ১০ টাকায় কেনা কিছু কাগজ আর পুরোনো কাগজ রিসাইকেল করে বানিয়েছিলেন সেই ডায়েরিটি।
পেইজে পোস্ট করার ৫ মিনিটের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায় সেটি। এরপর আর কাজ থেকে ফুরসত মেলেনি সান্ত্বনার। প্রায় দেড় বছর ধরে কাগজপ্রেমীদের জন্য বানিয়েছেন অসংখ্য খাম, ডায়েরি, চিঠির কাগজ, জাপানিজ ওয়াশি পেপার, জার্নাল, বুকমার্ক ইত্যাদি। জার্নাল কিট আর ডায়েরির সাথে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী তাদের প্রিয় কবিতা, গল্প বা লেখা জুড়ে দিয়ে 'ভিন্টেজ' ধাঁচ আনেন সান্ত্বনা। তার বানানো প্রতিটি পণ্যেই থাকে গ্রাহকের চাহিদার ছাপ।
গোলাপ, জবা, জারুল, অলকানন্দা, অপরাজিতা, কাঠ গোলাপ, বাগানবিলাস থেকে শুরু করে রেইন লিলি, কচুরিপানা, ঘাসফুল, সরিষা ফুল, কাশফুল-ইত্যাদি কিছুই বাদ যায় না সান্ত্বনার সংগ্রহে। ফুল অনুযায়ী প্রতিটির সংরক্ষণ করার ধরণও আলাদা। সৌন্দর্য আর রঙ ঠিক রাখতে কোনো ফুল সংরক্ষণ করতে হয় নির্দিষ্ট কেমিক্যাল দিয়ে, কোনো ফুল শুকাতে হয় বাতাসে ঝুলিয়ে বা বইয়ের ভাজে চেপে আবার কোনো ফুল প্রক্রিয়াজাত করা হয় মাইক্রোওয়েভ ওভেনের তাপে।

ফুলের সাথে পেপার পাল্প, পুরানো কাগজ বা কাঠের গুড়া মিশিয়ে বানান কাগজ। ফুল মিশিয়ে হাতে বানানো কাগজ কিছুটা "টেক্সচারড" হয় বলে জানান সান্ত্বনা। ফুল ছাড়া শুধু পেপার পাল্প দিয়ে বানানো কাগজগুলো হয় মসৃণ।
গোলাপ, ঘাসফুল, নীল অপরাজিতা, চা-কফি ইত্যাদি দিয়ে ডায়েরির কাগজগুলো রঙ করেন তিনি।
শুধু চোখের দেখাতেই নয়, সান্ত্বনার বানানো কাগজগুলো ঘ্রাণেও মন জুড়ায় গ্রাহকের। ডায়েরি, জার্নাল আর চিঠির পাতা থেকে আসে ফুল আর কফির সুগন্ধ। "কাগজের সাথে এই বিশেষ ঘ্রাণটা প্রত্যেকেই অনেক বেশি পছন্দ করে। কেউ কেউ তো এই ঘ্রাণ পেতে ডায়েরি বা কাগজগুলো তাদের বেড-সাইড টেবিলে রেখে দেন সবসময়," হেসে বলেন তিনি।

প্রতি মাসেই এখন ২০০-২৫০টি পার্সেল দেশের নানা প্রান্তে পাঠান সান্ত্বনা। তার এই কাজে শুরু থেকেই পাশে আছে পুরো পরিবার। তার ভাষ্যে, "একা আমি কখনোই পারতাম না এই কাজটা। আমার মা, ছোট ভাই আর বোনেরা সব কাজে সাহায্য করে আমাকে। মূল ডিজাইন আর সাজানোর কাজটা সবসময় আমি করলেও কাগজ বানানো, রঙ করা, বাঁধাই করার মতো সব কাজ ভাগ করে করি সবাই।"
একটা ডায়েরি বা জার্নাল বানাতে নকশা ভেদে সময় লাগে ৩-৭ দিন। গ্রাহক তার চাহিদা জানানোর পরই কাজ শুরু করেন সান্ত্বনা। তাই শুরুতেই কাস্টমারের কাছ থেকে সময় চেয়ে নেন কাজের। ডিজাইনভেদে হাতে বানানো ডায়েরিগুলোর দাম ৩০০ থেকে ৩০০০ টাকা আর জার্নাল কিটের দাম ৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত।
পোস্ট অফিসের মাধ্যমে তার বানানো ডায়েরি, জার্নাল দেশের বাইরেও পাঠিয়েছেন অনেকবার। কিন্তু ডেলিভারি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত পার্সেল পাঠাতে পারেন না বাইরের দেশে।

প্রতি মাসেই ৩৫-৪০ হাজার টাকার ডায়েরি, জার্নাল আর কাগজ বিক্রি হয় চিজি পেপারে। ১০ টাকার কাগজ দিয়ে কাজ শুরু করার পর ব্যবসার আয় থেকেই নতুন কাজ করে গেছেন সান্ত্বনা।
প্রতিনিয়ত গ্রাহকদের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসাই তার কাজ করার শক্তি জোগায়। অপরিচিত অনেক গ্রাহক প্রায়ই তার কাজে মুগ্ধ হয়ে দূর-দুরান্ত থেকে চিঠি লিখে প্রকাশ করেন মুগ্ধতা। হুট করেই কেউ পাঠিয়ে দেন জমিয়ে রাখা শুকনো ফুল। প্রিয়জনেরা নতুন কোনো ফুল পেলেই নিয়ে আসেন তার জন্য।

এমনকি পার্কের নিরাপত্তা কর্মীরাও দুর্লভ ফুলের সন্ধান জানান তাকে। ব্যবসার চেয়ে বরং শখ হিসেবেই ফুলকে কাগজে পরিণত করার কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।