বিলুপ্ত প্রাণীর ফিরে আসা: ‘জুরাসিক পার্ক’ কি বাস্তব রূপ নিতে যাচ্ছে?

শেষবার জঙ্গলে তাসমানিয়ান বাঘের দেখা মিলেছিল ১৯৩০ সালে, এক কৃষক গুলি করে মেরে ফেলার পর। অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে বসতি স্থাপনকারী ইউরোপীয়রা তাসমানিয়ান বাঘকে তাদের হাঁস-মুরগি ও ভেড়ার পালের জন্য হুমকি মনে করতো।
তাই তাদের দৌরাত্ম্যে 'থাইলাসাইন' নামে পরিচিত এই প্রাণীটি বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যায়। কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানী ও গবেষকরা ৬ ফুট লম্বা এই প্রাণীটিকে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন!
বিজ্ঞানীরা যদি বিলুপ্ত তাসমানিয়ান বাঘকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন তাহলে এটিই হবে ইতিহাসে প্রথম কোনো প্রাণীর 'পুনরুত্থান'! তাই স্বভাবতই এই প্রক্রিয়াটি নিয়ে হইচই তৈরি হয়েছে বৈশ্বিক অঙ্গনে।
কলোসাল বায়োসায়েন্সেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের সঙ্গে যৌথভাবে জিন-সম্পাদনা প্রযুক্তির মাধ্যমে থাইলাসাইন বা তাসমানিয়ান বাঘকে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছে। বিশ্বের অন্য যেকোনো জায়গার চাইতে অস্ট্রেলিয়ায় স্তন্যপায়ী প্রাণী বিলুপ্তির হার বেশি। বিদেশি প্রজাতির আগমন এবং জলবায়ু সংকটের ফলে সৃষ্ট দাবানল এই বিলুপ্তির পেছনে অন্যতম কারণ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাসমানিয়ায় থাইলাসাইন প্রজাতির বিলুপ্তির পরে ছোট আকারের মারসুপিয়ালদের (এক ধরনের স্তন্যপায়ী গোত্রের প্রাণী যারা নিজেদের থলেতে বাচ্চা বহন করে) সংখ্যা আর নির্ণয় করা হয়নি এবং অতিরিক্ত চারণের ফলে পরিবেশগত ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়েছে।
বিলুপ্ত প্রাণী ফিরিয়ে আনার কথা শুনে আপনার মনে হতেই পারে 'জুরাসিক পার্ক' সিনেমার চিত্রনাট্য পড়ছেন! আর আপনার এই ধারণা শতভাগ সঠিক! কারণ বিলুপ্ত প্রাণী ফিরিয়ে আনতে বিজ্ঞানের যে প্রচেষ্টা, এটিই ছিল 'জুরাসিক পার্ক' নির্মাণের মূল অনুপ্রেরণা।
কলোসাল বায়োসায়েন্সেস-এর প্রতিষ্ঠাতা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজননবিদ্যা বিশেষজ্ঞ জর্জ চার্চ ও মার্কিন উদ্যোক্তা বেন লাম। বিলুপ্ত প্রাণী উলি ম্যামথের একটি হাইব্রিড ভার্সন ফিরিয়ে আনতে সর্বশেষ 'জুরাসিক পার্ক' সিনেমার প্রযোজকের কাছ থেকে ৭৫ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছেন তারা।
কলোসাল দাবি করেছে, উলি ম্যামথ দিয়ে তুন্দ্রা অঞ্চলের সঞ্জীবনী শক্তি ফিরিয়ে আনা যেতে পারে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে পারে৷
তবে তাসমানিয়ান বাঘ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আরও প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটি। একই ডিএনএ-বিশিষ্ট মারসুপিয়াল প্রজাতির জীবিত কোনো প্রাণীথেকে স্টেম সেল নিয়ে, জিন-সম্পাদনা প্রযুক্তির মাধ্যমে এই বিলুপ্ত প্রাণীটিকে ফিরিয়ে আনা বা এর খুব কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের প্রাণী নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছেন বিজ্ঞানীরা।
তাসমানিয়ান বাঘ নিয়ে এ গবেষণাটি পরিচালনা করছেন মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যান্ড্রু পাস্ক। তিনি বলেন, "আমার বিশ্বাস, আগামী দশ বছরের মধ্যেই আমরা আমাদের প্রথম থাইলাসাইন-শাবক আনতে পারবো।"
তবে বিলুপ্ত প্রাণী ফিরিয়ে আনতে এ ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার অনেক কারণ রয়েছে। এই যেমন- থাইলাসাইনের যে জিনোম পাওয়া যাচ্ছে তা আসলে অসম্পূর্ণ। এই শূন্যস্থান পূরণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর আগে ১০০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ম্যাক্লিয়ার'স র্যাট (ভারত মহাসাগরে ক্রিসমাস দ্বীপের এক প্রজাতির ইদুর) এর জিনোম উদ্ধার করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা ব্যর্থ হয়েছেন, কারণ এটির ৫% ডিএনএ সম্পূর্ণরূপে উদ্ধার করা অসম্ভব ছিল।
তাছাড়া নতুন আগত বৃহদাকৃতির প্রাণীগুলোর সাথে একই পরিবেশে তাসমানিয়ান বাঘ টিকে থাকতে পারবে কিনা তাও স্পষ্ট নয়।
বিলুপ্ত প্রাণী ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। একবার জিনোমে মানব-সৃষ্ট পরিবর্তন সংঘটিত হলে প্রাকৃতিকভাবে সেখানে আরও কিছু পরিবর্তন ঘটবে। এই পরিবর্তিত জিন কাছাকাছি অন্য প্রজাতির মধ্যেও প্রবাহিত হতে পারে। তাহলে প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে প্রাণীগুলোকে আবারও পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হলো, তাদের পরিণতির জন্য কে দায়ী হবে?
তাই বিজ্ঞানের নজর থাকা উচিৎ বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী টিকিয়ে রাখার দিকে, বিলুপ্ত প্রাণী ফিরিয়ে আনা নয়।
ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রিভাইভ অ্যান্ড রিস্টোর 'এলিজাবেথ অ্যান' নামক একটি ব্লাক-ফুটেড ফেরেটের (বেজি-জাতীয় প্রাণী) ক্লোনিং করেছে, কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলো যে এই প্রজাতিটি হুমকির মুখে। 'এলিজাবেথ অ্যান'কে এমন একটি ফেরেট থেকে ক্লোন করা হয়েছে যার কোনো জীবিত বংশধর নেই, বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা প্রাণীটির জিনপুলে জেনেটিক বৈচিত্র্য নিয়ে আসার মাধ্যমে এই প্রাণীটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিকে বাঁচাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
প্রাণীদের বিবর্তন তাদের আবাসস্থল পরিবর্তনের হারের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। অতীতের বাস্তুতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার পরিবর্তে প্রাণীর প্রজাতি এমনভাবে বৃদ্ধি করা উচিত যেন তারা এরসাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।