একদল তরুণের ফটোগ্রাফার থেকে সমাজসেবক হয়ে ওঠার গল্প
এখন তো শখের ছবিয়াল তো অনেকেই আছেন। যারা ফোন বা ক্যামেরা নিয়ে সাধারণ একটি বিষয়কেও অসাধারণ আঙ্গিকে ফ্রেমবন্দি করেন। এরকম একজন হচ্ছেন 'প্রিন্স ঘোষ'। শখের বশে নিজের হাতে থাকা মোবাইল ফোনটি দিয়ে মাঝে মধ্যেই ছবি তুলতেন তিনি। তার সেই ছবি তোলার শখ যে একদিন শত শত মানুষের জন্যে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াবে তা নিজেও ভাবতে পারেননি। ছবিতোলা প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়ে তার সেই শখকে সমাজ সেবার কাজে লাগান ।
'প্রিন্স ঘোষ' চীনের একটি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস-এ পড়াশোনা করছেন। কিন্তু এর বাইরে সাভার এলাকার সবার কাছে তার পরিচয় হচ্ছে তিনি গণমানুষের সেবাদূত। গত ৪ বছর ধরে ক্ষুধার্থ মানুষের মাঝে দিনে একবেলা খাবার তুলে দিতে কাজ করে যাচ্ছেন দিনরাত। শুরুতে 'ছবিঘর' কেবলমাত্র একটি অনলাইন ফটোগ্রাফি পেজ ছিলো। কিন্তু সেটা ছাপিয়ে এটি এখন একটি সামাজিক সংগঠন। মানব সেবা করাই সংগঠনটির তরুণদের এখন গুরু দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রিন্স ঘোষ বলেন, "২০১৮ সাল থেকে আমাদের ছবিঘর সংগঠনের যাত্রা শুরু হলেও, মাঝে আমি চীনে চলে যাই পড়াশোনার জন্যে। বিশ্বব্যাপী করোনা আঘাত হানলে আমাকে দেশে ফিরে আসতে হয়েছিলো। দেশে ফিরে আসার পর থেকে আমি পুরোদস্তুরে মানুষের জন্যে কিছু করার চেষ্টা করে যেতে থাকি। আর ভিন্নভিন্ন বিষয়কে সামনে রেখে সেগুলো বাস্তবায়নে কাজ করা শুরু করি।
ছবিঘরের যাত্রাশুরু
আগ্রহ ও ভালোলাগা থেকে আশেপাশের নানাকিছু ফ্রেমবন্দি করে নিজের সংরক্ষণে রাখতেন প্রিন্স ঘোষ। তারপর হুট করে একদিন একটি ছবি তোলা প্রতযোগিতায় নাম দিয়ে বসলেন। প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার তিনি তখনো ছিলেন না। কিন্তু ফটোগ্রাফির হাত নিপুণ হওয়ায় কন্টেস্টে জিতে নিলেন দ্বিতীয় বিজয়ীর মুকুট এবং পুরুস্কার স্বরুপ মিললো একটি মোবাইল ফোন। পুরস্কার জেতার পর ছবি তোলার প্রতি তার ইচ্ছাশক্তি আরও প্রবল হয়। তারপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'ছবিঘর' নামের একটি পেজ খোলেন।
সেখানে তার মতো আরও অনেক উৎসাহী ফটোগ্রাফাদের জন্যে পেজটিকে উন্মুক্ত করে দিলেন, ফলে তারাও নিজেদের তোলা ছবিগুলো সেখানে পোস্ট করতে শুরু করে। পেজে সাড়া ভালো পড়ায় সিদ্ধান্ত নিলেন ফ্রিল্যান্সিং ফটোগ্রাফাদের নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করবেন। তারপর ২০১৮ সালে এতে সারা বাংলাদেশ থেকে ৩হাজার ছবি আসে এবং রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ ৮৬ হাজার টাকা জমা পড়ে।
প্রদর্শনী শেষে রেজিষ্ট্রেশনের টাকা থেকে ৭হাজার টাকা খরচা না হয়ে অবশিষ্ট রয়ে যায়। এই টাকাকে নিজের জন্যে ব্যয় না করে আর কি কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে চলতে থাকে পরিকল্পনা। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন সাভার স্মৃতিসৌধের সামনে এই টাকায় একবেলা দরিদ্র মানুষ ও শিশুদের খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু সেটা যেন খাবার নিতে আসা লোকদের নিকট অনুদান স্বরুপ মনে না হয়, তারজন্য জনপ্রতি খাবারের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১টাকা।
একবেলার খাবার পেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে যে হাসি তারা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিল, তা যেন তাদেরকে আরও উদ্যমী করে তোলে। সিদ্ধান্ত নেন তাদের সামান্য এই কাজের মধ্যে দিয়ে আরও মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। প্রবল উৎসাহের সাথে উদ্যোগ নিয়ে ৩বন্ধু ও প্রিন্স ঘোষের ছোট ভাই মিলে গড়ে তোলেন 'ছবিঘর সংগঠন'। তখনও তারা ছবি তুলতেন কিন্তু তা প্রকৃতি বা আশেপাশের দৃশ্যের না, ক্ষুধার্থ মানুষের পেটপুরে ১বেলা খাবার পাওয়ার পর হাসি-আনন্দের ছবি।
ছবিতে সমাজের প্রতিচ্ছবি
এতো কিছুর মাঝেও প্রিন্স ঘোষ তার ছবি তোলার শখকে তখনো ভুলে যাননি। কিন্তু এবার ভিন্নরকম টনক নাড়ানো কিছু ছবি তোলার দিকে আগ্রহী হলেন। যে স্থিরচিত্র কথা না বলেও তুলে ধরতো হাজারো গল্প-কথা।
প্রিন্স ঘোষ একজন কনসেপচুয়াল ফটোগ্রাফার। সমাজের নানা অসঙ্গতি ও সামাজিক অবস্থা তিনি ছবির মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা শুরু করেন।
ফটোগ্রাফার প্রিন্স ঘোষের তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, এক নারীর রক্তাক্ত পায়ের পাশে পুরুষের বেল্ট পড়ে আছে। আর পাশেই ছিলো একটি পড়ে থাকা টেপা পুতুল ও সুপারম্যানের পুতুল। ছবিটি যেন নিরবভাবে বলে দিচ্ছে আমাদের সমাজের ঘৃণ্য এক অবস্থার কথা। যেখানে শিশুরাও রেহাই পায়না ধর্ষণের হাত থেকে এবং ধর্ষক শ্রেণি এই কাজের পর নিজেদের মধ্যে একপ্রকার বীরত্ব অনুভব করে।
'শিশুর কোলে শিশু' এই বার্তাকে সামনে রেখে তিনি তুলে ধরেন সমাজের বাল্য বিয়ের চিত্র। এই ছবিতে একটি কিশোরীর কোলে আছে এক নবজাতক। আর পাশেই পড়ে রয়েছে ভাঙা কিছু হাড়ি-পাতিল। অথচ, এই বয়সে শিশুটির নিজেরই খেলা করার কথা। তার তোলা আরেকটি ছবির গূঢ় অর্থ ছিলো, নারীদের শোষণ-নির্যাতন।
করোনাকালীন মৃত্যু পথযাত্রী ধারণা নিয়ে তোলা ছবিটির বার্তা ছিলো- 'আমরা সবাই যেন প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছি মৃত্যুর পথে'। রাস্তার পাশে বিলবোর্ডে বড় করে লিখে রাখা এম্বুলেন্স ও লাশবাহী গাড়ির ঠিকানা, আর তার পাশ দিয়ে ভাইরাস থেকে বাঁচতে মাস্ক পরে হেঁটে যাচ্ছেন একলোক। কিন্তু কোথায় যাচ্ছেন তিনি? ধীরে ধীরে একটু করে যেন এগিয়ে যাচ্ছেন মৃত্যুর দোরগোড়ায়।
প্রিন্স ঘোষ নিজের ছবি তোলার ব্যাপারে বলেন, "কনসেপচুয়াল ফটোগ্রাফির জন্যে পরিচিতদের মধ্যে থেকে একজনকে মডেল হিসেবে নেওয়া হতো। তারপর যে ধারণাকে সামনে রেখে কাজ করতে চাইতাম তা ফুটিয়ে তুলতে পোশাক, সজ্জা ও স্থান নির্ধারণ করে ছবিগুলো তোলা হয়েছে। আমি আমার ছবির মধ্যে দিয়ে একটি করে বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছি। যা একপ্রকার সামাজিক সচেতনতা বলা যেতে পারে"।
১টাকায় ১বেলার ইচ্ছেপূরণ
ছবিঘর সমাজসেবা মূলক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার আগে কিছু তরুণের উদ্যোগে ১টাকায় ১বেলা দরিদ্র মানুষদের আহার নামে কর্মসূচি নামায় । শুরুতে খাবার বিতরণের এই পরিকল্পনাটি ১দিনের জন্যে করা হলেও, পরে এটি ছবিঘর সংগঠনের জন্যে নিত্যকার দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালে শুরু করা সেই কাজ নিয়মিত চালিয়ে যাচ্ছে এই তরুণেরা।
তবে অর্থের জোগান ও অন্যান্য প্রতিকূলতায় মাসের প্রতিদিন আয়োজন করা সম্ভব না হলেও, সপ্তাহের শুক্রবারে ১টাকায় খাবার ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকান বসে। তবে রমজানের পুরো মাস ধরেই ১টাকার দোকান চালু রাখা হয়েছিল, দরিদ্র মানুষকে সারাদিন পর ১ বেলা ভালো ইফতারের ব্যবস্থা করে দেওয়া জন্যে। এপর্যন্ত ৮হাজারের বেশি লোকের একবেলা আহারের ব্যবস্থা করেছে সংগঠনটির তরুণরা।
নারীদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ
সাভার ও ধামরাইয়ের কিছু স্কুলে নিয়মিত আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ চলছে। আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণগুলোতে অংশ নিচ্ছে শত শত নারী শিক্ষার্থীরা। নির্ভয়, নিরাপদ ও আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রতিটি নারী যেন রাস্তায় চলাচল করতে পারে সে প্রত্যয়ে নারীদের প্রশিক্ষণ দিতে উদ্যোগটি নেয় 'ছবিঘর সংগঠন'।
সংগঠনের সদস্যদের আত্মরক্ষার ওপর প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকায়, স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষকের খোঁজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করলে একজন এগিয়ে আসেন। ঠিক করা হয় স্কুলের নারী শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, যেন কোন মেয়ে রাস্তায় হয়রানির শিকার হলে রুখে দাঁড়াতে পারে। আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়ার আর্জি নিয়ে তারা সাভারের বিভিন্ন স্কুলে স্কুলে গিয়ে হাজির হয়, কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকে প্রথমদিকে অনুমোদন মিলেনি।
হাল ছেড়ে দেননি এই তরুণেরা, পরিচিত একজনের দ্বারা চেষ্টা করে সাভার গার্লস স্কুলে প্রশিক্ষণ দেওয়ার অনুমতি মিলে অবশেষে। প্রাথমিকভাবে ৩০০জন নারীকে নিয়ে ৩দিনের একটি কর্মশালা পরিচালনা করা হয়। এভাবে এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে চলে আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ।
নানারকম প্রাতিষ্ঠানিক ঝামেলা এড়াতে ধামরাইয়ের ইউএনও, শিক্ষা অফিসার থেকে অনুমতি সংগ্রহ করে 'ছবিঘর সংগঠন'। বর্তমানে ব্ল্যাক বেল্ট ধারক ১জন নারী ও ১জন পুরুষ প্রশিক্ষক আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন। ধামরাইতে ১৩০০জন নারী শিক্ষার্থীসহ মোট ৮হাজার নারীরা এখান থেকে আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্স জানান, "নারীদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোর ব্যপারে স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে গেলে তারা অনুমতি দিতে চাইতেন না। এক্ষেত্রে প্রথম থেকেই নারী শিক্ষার্থীরা বেশ আগ্রহী ও উদ্যমী ছিল। কিন্তু বিপত্তি বাধে নারীদের জন্য প্রতিটি স্কুলে সুরক্ষা বাক্স স্থাপন করা নিয়ে।
ছবিঘর সংগঠন থেকে প্রশিক্ষণ দিতে যাওয়া স্কুলগুলিতে একটি করে সুরক্ষা বাক্স স্থাপন করার কাজকে অনেকই বাঁকা চোখে দেখেন। প্রাকৃতিক একটি বিষয়কে এখনও কেন জানি আমরা অনেকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারিনি। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও কুসংস্কার যেন এখনো এইসব ব্যাপারে বেশ কঠোর জায়গা দখল করে আছে"।
"এছাড়াও নারীরা প্রতিনিয়ত সাইবার হয়রানির শিকার হচ্ছে। এ ব্যাপারে তাদেরকে নিয়মিত সহযোগিতা করা হয় আমাদের সংগঠন থেকে। কোন নারী সাইবার হয়রানির কথা জানালে, আমরা পরিচিত পুলিশ ও কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে তা ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেই। কিন্তু আমাদের দেশের আইনী প্রক্রিয়াগুলোর জটিলতার জন্য তা অনেক সময় দ্রুত সমাধান হয়না"।
কৃষকের বাতিঘর
সম্প্রতি কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে নতুন এক উদ্যোগ নিয়েছে 'ছবিঘর সংগঠন'। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩মাসে ৫০জন দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে বীজ, সার, কীটনাশক উপহার দেওয়া হয়। এমনকি কীভাবে ফলন ভালো হবে এই বিষয়ে দেওয়া হয় পরামর্শ। পুরুষ কৃষকদের পাশাপাশি নারীদেরকেও সার, বীজ প্রদান করে সংগঠনের সদস্যরা। বাড়ির পাশে খালি পড়ে থাকা জায়গায় চাষাবাদ করে, সংসারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া।
শিক্ষার্থী কিছু তরুণ এতোসব কাজের জন্যে ফান্ড কোথা থেকে সংগ্রহ করছে তা জানতে চাইলে 'প্রিন্স ঘোষ' বলেন, "ভালো কাজ ও মানুষের জন্যে কাজ করতে গেলে অন্যরাও এগিয়ে আসে। প্রথমদিকে নিজেরা টাকা দিয়ে ও অন্যান্য জায়গা থেকে টাকা তুলে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলাম। তারপর স্থানীয় লোকজন আমাদের কাজে এগিয়ে আসেন, এলাকার চেয়ারম্যানও আমাদের সংগঠনের জন্য ফান্ড দেন। এছাড়া দেশের বাইরে আমাদের কয়েকজন আত্মীয় রয়েছে, তারা নিয়মিত অর্থ প্রদান করে যাচ্ছেন সংগঠনের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে"।
বর্তমানে ১০০জন সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবক কাজ করে যাচ্ছে 'ছবিঘর সংগঠনে'। সংগঠনটির সদস্যরা দৌলতদিয়ায় বাস করা যৌন কর্মীদের সন্তানদের শিক্ষার দায়িত্ব নিতে স্থানীয় সরকারের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা চায় এই শিশুরা যেন আর ৫জন শিশুর মতো স্কুলে যেতে পারে। পিছিয়ে থাকা ও সমাজের আড়ালে বাস করা এই জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তুলতে তাদের পরবর্তী কার্যক্রম বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে ছবিঘর সংগঠনের এই তরুণেরা।