বাংলাদেশ, ভারত, নেপালের সেকেন্ডহ্যান্ড কাপড়ের বিস্তৃতি এখন ইনস্টাগ্রামেও
আনুশা আলমগীর প্রতি ১৫ দিন পরপর অন্তত একবার ঢাকার গলির বাজারগুলোতে ঢুঁ মারেন। ঘুরে ঘুরে এসব বাজারের সেকেন্ডহ্যান্ড পোশাকের স্তূপ ঘাঁটাঘাঁটি করেন। বেছে বেছে ব্যবহৃত টপস, স্কার্ট ও জামা কেনেন। তারপর রিক্সায় করে সেসব নিয়ে বাড়ি ফেরেন। মানুষজন প্রায়ই তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বোধহয় ভাবে, ইতালি, জাপানের মতো দেশগুলো থেকে আসা শত শত পুরনো কাপড় দিয়ে এই মেয়ে করবেটা কী?
আনুশা তার ইনস্টাগ্রাম থ্রিফ্ট স্টোর (সেকেন্ডহ্যান্ড কাপড় ও গৃহস্থালি জিনিস বিক্রির দোকান) কালারস ঢাকা-র মাধ্যমে এসব কাপড় বিক্রি করতেন। তার দোকানের ফলোয়ারের সংখ্যা সাড়ে ৫ হাজারের বেশি। (আনুশা এখন পড়াশোনার জন্য যুক্তরাজ্যে থাকায় থ্রিফ্ট স্টোরটি আপাতত বন্ধ আছে)।
নিজের বই প্রকাশনা ব্যবসার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে ২০১৯ সালের অক্টোবরে কালারস ঢাকা চালু করেন আনুশা। নিজের ওয়্যারড্রোব জিনিস বিক্রি করার এই উদ্যোগ শেষতক লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়। মাসে ২০০ থেকে ২,১০০ ডলার পর্যন্ত আয় হতো তার। আয় নির্ভর করত কত ঘন ঘন পোস্ট করছেন, তার উপর।
মাত্র কয়েক বছর আগেও থ্রিফ্ট স্টোর চালিয়ে লাভ করার কথা চিন্তাও করা যেত না। কেননা দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশেই ব্যবহৃত কাপড় কেনাকে ভালো চোখে দেখা হতো না। সংবাদমাধ্যম রেস্ট অভ ওয়ার্ল্ডকে আনুশা বলেন, 'মধ্যবিত্ত হওয়া বা অন্য মানুষের পোশাক পরার এই ধারণাটিকে ট্যাবু হিসেবে দেখা হয়। এজন্য একে অবজ্ঞা করা হয়।'
কিন্তু চোখ জুড়ানো ভিজ্যুয়াল ও বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে ইনস্টাগ্রাম এই ধারণাটিকে পাল্টে দিয়েছে। সেকেন্ডহ্যান্ড পোশাকের প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ প্রজন্মের ধারণাই বদলে গেছে। তার সুবাদে এ অঞ্চলে দিন দিন বড় হচ্ছে সেকেন্ডহ্যান্ড পোশাকের বাজার। ব্যবহৃত কাপড়কে সস্তা ও পরিবেশগতভাবে টেকসই বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করেন গ্রাহকরা।
গত তিন বছরে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল জুড়ে অসংখ্য ইনস্টাগ্রামভিত্তিক থ্রিফ্ট স্টোর গজিয়ে উঠেছে। এসব দোকান তরুণ ক্রেতাদের মধ্যে সেকেন্ডহ্যান্ড ফ্যাশনের ধারণাটিকে জনপ্রিয় এবং আকাঙ্ক্ষিত করে তুলেছে। অনেক তরুণ উদ্যোক্তার জন্য লাভজনক ব্যবসা হয়ে উঠেছে এসব সাশ্রয়ী দোকান। একজন ভারতীয় থ্রিফ্ট স্টোরের মালিক রেস্ট অফ ওয়ার্ল্ডকে জানিয়েছেন, একটি পোশাক যদি শিপিংসহ ৮৫০ রুপিতে বিক্রি হয়, তবে লাভের মার্জিন ৫০০ রুপি পর্যন্ত হতে পারে।
কালারস ঢাকা থেকে নিয়মিত কেনাকাটা করেন ঢাকার ২৬ বছর বয়সী ডাক্তার শাহ মেহসান হাফিজ। তিনি বলেন, 'আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ও কীভাবে স্টাইল করতে হব, তা জানিয়ে [আনুশা] ছোট নোট দিয়ে দেন। তিনি সবকিছু পরিবেশবান্ধব পার্সেলে প্যাকেজ করেন এবং খুব অল্প সময়ের নোটিশে, সুবিধামতো পাঠান। তার কাছ থেকে যা যা পেয়েছি, সবই আমার পছন্দ হয়েছে।'
তরতর করে বাড়ছে এই ইনস্টাগ্রাম থ্রিফ্ট স্টোরগুলোর জনপ্রিয়তা। দোহোরান নেপাল নামে একটি থ্রিফট স্টোর চালান নেপালের সিলভিনা প্রধান। তার স্টোরের ফলোয়ারসংখ্যা সাড়ে ৮ হাজারের বেশি। সিলভিনার আগে নিজের বেডরুমে বিক্রির জন্য কিনে আনা জামাকাপড় রাখতেন। কিন্তু তার দোকানের জনপ্রিয়তা এত বেড়ে গেছে যে তাকে এখন বাড়ির একটা আলাদা ঘর দখল করতে হয়েছে ব্যবসা চালানোর জন্য। ঘরটিকে তিনি গুদাম ও স্টুডিও হিসেবে ব্যবহার করবেন।
সিলভিনা আশা করছেন তার ব্যবসায়িক ইনভেন্টরি সক্ষমতা ৫০০ থেকে ৫ হাজার পিস ওয়েস্টার্ন পোশাক ও ভিনটেজ শাড়িতে পৌঁছবে। এই সমস্ত কাপড়ই সেকেন্ডহ্যান্ড।
সিলভিনার দোকানে এখন দুজন খণ্ডকালীন কর্মী আছে। একজন ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে লেনদেন করেন ও হিসাবরক্ষণের কাজ করেন। অপরজন কনটেন্ট প্ল্যানিং এবং তৈরি করেন।
সিলভিনা বলেন, 'নেপালের মানুষ এখনও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কেনাকাটা করতে চায় না। পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে তাদের কাছে বেশি সহজ মনে হয়।'
দোহোরান নেপালের জন্য ওয়েবসাইট তৈরি করছে সিলভিনার দল। তবে দোকানটি ইনস্টাগ্রামভিত্তিক বিক্রিতেই বেশি মন দেবে বলে জানালেন তিনি।
ছোট আকারের রিল ভিডিও দিয়ে ইনফ্লুয়েন্সারে পরিণত হয়েছেন দিল্লির ইয়াশনা মালিক ও ইশিতা বাজাজ। এই দুজনের অ্যাকাউন্ট রিভাইভাল পাইলের ফলোয়ারের সংখ্যা ১৫ হাজার ৮০০-র বেশি। ইয়ারা স্থানীয় কারখানা ও রপ্তানির জন্য রাখা কাপড় থেকে প্রত্যাখ্যাত কাপড়গুলো সংগ্রহ করে এনে বিক্রি করেন তারা।
আইনের শিক্ষার্থী ইয়াশনা ও ইশিতা কোভিড লকডাউনের সময় রিভাইভাল পাইল গড়ে তোলেন। তারা এখন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থোপার্জন করেন এই থ্রিফট স্টোর থেকে।
ইয়াশনা ও ইশিতা বলেন, তারা পশমার্কের মতো প্ল্যাটফর্মের চেয়ে ইনস্টাগ্রাম বেশি পছন্দ করেন, কারণ এই সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্ক গ্রাহকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগের সুযোগ করে দেয়।
ইশিতা বলেন, যেসব তরুণ-তরুণী থ্রিফ্ট স্টোর নির্মাতাদের মেসেজ দেন, তারা মাঝেমধ্যে নিজেদের পোশাকের স্টাইল সম্পর্কেও পরামর্শ চান। ইয়াশনা ও ইশিতার বিশ্বাস, ইনস্টাগ্রাম থ্রিফটিং ফ্যাশনের বিপণনকে গণতান্ত্রিক করেছে, যেহেতু ভারতের সব জায়গায় বৈচিত্র্যপূর্ণ বাজারে প্রবেশের সুযোগ নেই।
থ্রিফট স্টোরের বিক্রেতারা ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে নিজেদের ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নেন। আনুশা বলেন, 'এই ক্রেতাদের অনেকেই অল্পবয়সী। আর তারা এখনও নিজস্ব সত্তাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
'ওদেরকে যেনতেনভাবে প্রলুব্ধ করা উচিত নয়। ক্রিয়েটর হিসেবে... বাচ্চাগুলো আপনার ব্র্যান্ডের জন্য অর্থ ব্যয় করছে—এই বিষয়টিকে আপনার অগ্রাধিকার দিতে হবে। নিজের শক্তির জায়গাটিকে আপনার বুঝতে হবে।'
ক্রেতারা ইনস্টাগ্রামে মন্তব্য ও মেসেজের মাধ্যমে আইটেম বুক করেন। এরপর দোকানের মালিকরা স্থানীয় ডেলিভারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে প্যাকেজ পাঠান। বাংলাদেশ ও নেপালে সাধারণত ক্যাশ অন ডেলিভারি পদ্ধতিতে বেশিরভাগ সময় মূল্য পরিশোধ করা হয়। আর ভারতে সাধারণত ডিজিটাল পেমেন্ট বেশি জনপ্রিয়।
আনুশা বলেন, '[বাংলাদেশে] ছোট বাচ্চাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। আমি জানতাম ইনস্টাগ্রাম এমন একটি জায়গা যেখানে মানুষ সবকিছু তাত্ক্ষণিকভাবে শেয়ার ও লাইক করতে পারে। আগে থেকেই কিছু বিল্ট-ইন অডিয়েন্স ছিল যারা আমার জিনিসগুলো দেখবে, কারণ অ্যালগরিদম শেষ পর্যন্ত আমার ফলোয়ারদের কাছে কালারস ঢাকাকে প্রমোট করবে।'
কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মকে স্টোরফ্রন্ট হিসেবে ব্যবহার করার সীমাবদ্ধতাও আছে।
মাঝে মাঝে ইনস্টাগ্রামের অ্যালগরিদম বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কোনো দোকানমালিক যদি অনেকগুলো 'ড্রপস' পোস্ট করেন—পূর্বঘোষিত লিমিটেড এডিশনের পোশাক রিলিজ—ইনস্টাগ্রাম সেই পোস্টগুলোকে স্প্যাম হিসাবে গণ্য করে, কিংবা অস্পষ্ট কমিউনিটি গাইডলাইনের জন্য সেগুলোকে ব্লক করে দেয়। পোস্ট সরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে থ্রিফ্ট স্টোরের পরিকল্পনা ব্যাহত হয়। ত্রুটি ও ব্যর্থ 'ড্রপস'-এর অর্থ হলো ক্রেতারা অর্ডার বুক করতে পারেন না। এতে ফলোয়ার কমে যেতে পারে।
রেস্ট অভ ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যেসব ইনস্টাগ্রাম থ্রিফ্ট স্টোর মালিক কথা বলেছেন, তাদের অর্ধেকই বলেছেন যে তারা দিনে ৩০ বারের বেশি পোস্ট করলে গাইডলাইন লঙ্ঘনের সতর্কতা পেয়েছেন।
৩৩ হাজারের বেশি ফলোয়ার নিয়ে একটি থ্রিফ্ট সেল অ্যাকাউন্ট চালান মেঘা লুথরা। মেঘা জানান, তিনি তার পেজে প্রতিদিন ২৫টি আইটেম পোস্ট করেন এবং বাকিগুলো স্টোরিতে দেখান। স্টোরিগুলোতে মেঘা একটি কোয়েশ্চন বক্স যুক্ত করে দেন। যারা আইটেমটি দেখে বুক করতে চান তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রিপ্লাই দিতে পারেন।
নেপালের আরেক থ্রিফট স্টোর মালিক মনীষ জাং থাপা। তার দোকানের নাম অ্যান্ডিডোট। তিনি সেকেন্ডহ্যান্ড পোশাক বিক্রির পাশাপাশি ভাড়াও দেন। তিনি বলেন, 'আপনি যদি মনে করেন বিপুলসংখ্যক ক্রেতা পেয়ে যাবেন, তাহলে ইনস্টাগ্রাম আপনার জন্য সঠিক জায়গা না।'
২০২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতে ইনস্টাগ্রামে শপিং ফিচার ছিল না। এর ফলে থ্রিফট শপ মালিকদের সরাসরি মেসেজ ও কমেন্টের মাধ্যমে পণ্যের বুকিং নিতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে ভারতে শপিং ফিচার যোগ করবে কি না, এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি ইনস্টাগ্রাম।
আনুশা আলমগীরের ইচ্ছা একটা ফিজিক্যাল কনসেপ্ট স্টোর খুলবেন। তিনি দেখেছেন বাংলাদেশের কিছু থ্রিফ্ট স্টোর মালিক পোশাক বিক্রির জন্য ইনস্টাগ্রাম থেকে টিকটক লাইভ স্ট্রিমিংয়ে চলে গেছেন।
আনুশা বলেন, ইনস্টাগ্রামের তুলনায় টিকটক অনেক বেশি দ্রুতগতিসম্পন্ন ও ঝামেলামুক্ত। এছাড়া মানুষের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য ক্রিয়েটরদের প্রতিদিনই ব্যবসার প্রচারণা চালাতে হয়।
- সূত্র: রেস্ট অভ ওয়ার্ল্ড