জোনাকির সৌরভ: নাসরিন জামিরের দেশীয় পারফিউম ব্র্যান্ড
মানুষের হৃদয়ে দোলা দিয়ে যাওয়া স্মৃতির একটা বড় অংশ জুড়ে গন্ধের বাস। কোনো একটা নির্দিষ্ট ঘ্রাণ হঠাৎ করেই মনে করিয়ে দিতে পারে প্রিয় কোনো মুহূর্তের। "জোনাকির 'ফ্রিসিয়া নাইটস' যেমন আমাকে পূর্ণিমার চাঁদ আর রবীন্দ্র সংগীতের কথা মনে করায়"- পারফিউমের সাথে নিজের স্মৃতিকে জুড়ে বলছিলেন নাসরিন জামির। বাংলাদেশের প্রথম ফাইন পারফিউমের ব্র্যান্ড "জোনাকি বাই নাসরিন জামির"-এর উদ্যোক্তা।
জোনাকির কথা মনে হলেই কল্পনায় ভাসে আঁধার ঝোপে মিটিমিটি জ্বলা ঝাঁকঝাঁক আলোর ছবি। শহরতলী বা মফস্বলে যাদের বেড়ে ওঠা তাদের শৈশবের একটা বড় অংশজুড়ে আছে জোনাকির স্মৃতি। ব্যতিক্রম নন নাসরিন জামিরও। পাহাড়, জঙ্গল, জলাশয়ঘেঁষা চট্টগ্রামের বাড়িতে কেটেছে তার শৈশব-কৈশোর। নাসরিন বলেন, "ছোটবেলা থেকেই আমার এক্সপেরিয়েন্স ছিল বাগান করার। আমার বাবা-মা খুব বাগান পছন্দ করতেন। তাদের এমন চিন্তা ছিল যে দরকার হলে খাব না, কিন্তু বাগান করতেই হবে। আমাদের সেই বাগানে অনেক জোনাকি দেখেছি। আমার মেমোরিতে জোনাকি আছে ঝাঁকে ঝাঁকে ফুলের মতো। বাগানে ছিল বিচিত্র সব দেশি-বিদেশি ফুল। সেই ফুলের গন্ধের সাথে জোনাকির আলোর স্মৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। সেই স্মৃতির পাতা থেকেই পারফিউম ব্র্যান্ডের নাম দিয়েছি জোনাকি।"
কিন্তু পারফিউমের জগতে বিদেশি সব নামের ভিড়ে আলোর পোকা জোনাকির নামে দেশি ব্র্যান্ডের নাম রাখা তো ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারতো! জবাবে নাসরিন জানান, "আমার কাছে একবারও ঝুঁকির মনে হয়নি এটা। অনেক বছর বিদেশে থাকলেও আমি কিন্তু মনেপ্রাণে খুবই বাঙালি! বাংলা ভাষায় জোনাকি মানে আঁধারের বাতি। তাই আমাদের ট্যাগলাইন হলো 'Joy of light'। রবীন্দ্রনাথের গানেও সে জায়গা করে নিয়েছে স্বাধীনচেতা ছোট প্রাণী হিসেবে। আমি নিজেও খুব স্বাধীনচেতা মেয়ে। তাই নিজের ইন্সপিরেশন খুঁজে পেয়েছি এই নামে। আসলে যদি কাজের পেছনে ভালো একটা গল্প থাকে তাহলে একটু দেরীতে হলেও মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। জোনাকির এই গল্পের মাধ্যমে আমরা অনেক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারব বলে বিশ্বাস করি আমি।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষে কানাডায় গিয়ে পড়েছেন ইন্টেরিয়র ডিজাইন নিয়ে। নামী-দামী অসংখ্য হোটেল, কর্পোরেট অফিস, বিলাসবহুল বাড়ির অন্দর সাজিয়েছেন তিনি। বহু বছর ধরে ইন্টেরিয়র ডিজাইনার, ফার্নিচার ডিজাইনার হিসেবে সফল নাসরিন জামির নিজের পারফিউম ব্র্যান্ড শুরু করার পরিকল্পনা করেন ২০১৭ সালে। নানা ধরনের ঘ্রাণ নিয়ে নাসরিনের আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই। ব্যবসার ক্ষেত্রে পারফিউমের জগত সম্প্রসারণ করার পেছনে তার অনুপ্রেরণায় ছিল শ্যানেল, ডিওরের মতো বিশ্বখ্যাত পারফিউম ব্র্যান্ড।
"শুরুতে বাংলাদেশেই পারফিউম বানানোর চেষ্টা করেছিলাম আমি। প্রথমেই গেছি মিটফোর্ডে। ওখানে লাইন ধরে আতরের দোকান। সবার সাথে কথা বলেছি, কতো স্যাম্পল কালেক্ট করেছি। কীভাবে বানায় বুঝতে চেষ্টা করেছি। তখন তো এতো নলেজ ছিল না। তারপর দেখলাম পারফিউম একটা সিরিয়াস সাবজেক্ট। এটা কী করে তৈরি হয় জানতে তখন আমি অনলাইন ক্লাস শুরু করলাম। সিঙ্গাপুর, হংকং, ফ্রান্সের মতো অনেক জায়গার অনলাইন ক্লাস এটেন্ড করেছি। আমার রিসার্চ পিরিয়ড ছিল পুরো ২০১৮ সাল। এক বছর সব ধরনের ফ্রেগরেন্স কী করে তৈরি করা হয়, কী কী ফুল দিয়ে বানানো হয় ইত্যাদি নিয়ে অনেক লেখাপড়া করেছি। এরপর ২০১৯ এ ঠিক করেছি কোথায় আমাদের প্রোডাকশন হবে। যে ফ্যাক্টরিটা মালয়শিয়াতে আমাদের পারফিউম বানাচ্ছে তারা ওয়ার্ল্ড ক্লাস ফ্যাক্টরি। পারফিউম করতে গেলে বিশেষজ্ঞ কেমিস্ট লাগে, উন্নতমানের ল্যাব লাগে। আমাদের বাংলাদেশে যা এখনও নেই," জোনাকির শুরুর গল্প বলতে গিয়ে জানান নাসরিন জামির।
২০২০ সালে ৫টি ভিন্ন ফ্রেগরেন্স রেঞ্জ নিয়ে বাজারে আসে জোনাকি ফ্রেগরেন্স। যার মধ্যে তিনটি মেয়েদের জন্য, আর দুইটি রেঞ্জ ছেলেদের জন্য। মেয়েদের জন্য বানানো তিনটি ফ্রেগরেন্স রেঞ্জ নিয়ে নাসরিনের ভাষ্য, "'ফ্রিসিয়া নাইট' হলো হালকা পারফিউম। ফ্রিসিয়া, গোলাপ, শাপলা, কস্তুরী-র মতো উপাদান আছে এতে। খুব স্ট্রং না বলে সারাদিনের জন্য ব্যবহার করা যায় এটা। বাংলাদেশের সাদা ফুলগুলোর কথা মনে করিয়ে দেবে এর ঘ্রাণ। ফ্লোরাল আর ফ্রেশ সেন্ট টাইপ এটার।
'নেরোলি ব্লোসোম' হলো সিট্রাস আর ফ্লোরাল ফ্রেগরেন্স মিলে। বাংলাদেশে তো এখন গরমকালটাই বেশি থাকে, এখানের ওয়েদারের জন্য ফ্রেশ একটা পারফিউম এটা। লেবু গাছ আর ফুল গাছ ঘেরা কোনো বাগানের মধ্যে বসে থাকার মতো আবহ পাওয়া যায় নেরোলি ব্লোসোমের ঘ্রাণে। 'ওরিয়েন্টাল জেসমিন'- এ আছে জেসমিন আর গোলাপ। অনেকটাই বেলি ফুলের মতো গন্ধ এটার। আমরা বাঙালিরা বেলি ফুল ছাড়া বর্ষার কথা তো চিন্তাও করতে পারিনা। উৎসব-পার্বণ, বিয়ে সব অকেশনে যেমন বেলি ফুল মানিয়ে যায় তেমনি ওরিয়েন্টাল জেসমিনও যেকোনো অকশনের সাথে যায়। সবচেয়ে বেশিক্ষণ এটার ঘ্রাণ থাকে। সেন্ট টাইপ হলো ফ্লোরাল আর উডি।"
ছেলেদের জন্য আছে 'অ্যামেরেট্টো' আর 'স্যান্টাল তাবাক'। নাসরিন বলেন, "ছেলদের পারফিউমের জন্য আমার অনেক স্টাডি করতে হয়েছে। অ্যামেরেট্টো আমরা বানিয়েছি ক্যাজুয়াল ওয়্যারের জন্য। সারাদিন ব্যবহারের মতো লাইভলি আর রোমান্টিক সেন্ট এটা। সমুদ্রিক আবহ আছে এই পারফিউমটায়। অন্যদিকে স্যান্টাল তাবাকে চন্দন কাঠের একটা সুগন্ধি আছে, তামাকের মতোও গন্ধ আছে, একই সাথে ল্যাভেন্ডার আর মাস্কও আছে। জঙ্গলের মতো আবহ পাওয়া যায় এতে। এটা আমাদের হাইয়েস্ট সেলিং পারফিউম।"
জোনাকি ফ্রেগরেন্সের সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত সাকি জানান, পারফিউমের বেশিরভাগ ক্রেতা পুরুষ। দুই ধরনের প্যাকেজিং-এ পাওয়া যায় জোনাকির পারফিউমগুলো। ৫ মিলির প্যাকেজিং এর দাম প্রতিটি ৩০০ টাকা আর ৫০ মিলি প্যাকেটের পারফিউমের মূল্য ২৮০০ টাকা। ৫ থেকে ৮ ঘন্টা সময় জুড়ে গন্ধ থাকে এই পারফিউমগুলোর। জোনাকির নিজস্ব ফেসবুক পেইজ, ওয়েবসাইট ছাড়াও এর ফ্রেগরেন্সগুলো পাওয়া যায় পারফিউম বাংলাদেশ, ঢালি, ইউনিমার্ট, আলমাস-এর মতো দোকানগুলোতে।
দেশে ফ্রেগরেন্স ব্র্যান্ড নিয়ে উদ্যোগে প্রতিবন্ধকতার কথা জানতে চাইলে আক্ষেপের সুরে নাসরিন জামির বলেন, "আমি কিন্তু কোনো ইনভেস্টর নেই নাই। আমার একটা ছোট মিনিমান সেভিং থেকেই এই উদ্যোগটার শুরু। অনেক ব্যাংকে গেছি লোনের জন্য। সব ব্যাংকে চায় হাজব্যান্ডের গ্যারেন্টি, ভাইয়ের গ্যারেন্টি। আমি যে এন্ট্রাপ্রেনার, আমি যে সাহস করে কাজটা করতে চাইছি সেটা তাদের কাছে মূখ্য ছিল না। এতগুলো ব্যাংকে ঘুরার পরে একটা ব্যাংক আমার উপর বিশ্বাস করে, আমার প্রয়োজন অনুযায়ী লোন দিতে রাজি হয়েছিল। এন্টাপ্রেনার আমি, সাহস আমার, তাহলে এত লোককে টানাহেঁচড়া কেন! এটা আমার একটা বিরাট অবজেকশন। মেয়েদের বড় কাজের সুযোগ দিতে হবে তো!"
জোনাকি ফ্রেগরেন্সের আড়াই বছরের পথচলায় গ্রাহকদের কাছে থেকে সন্তোষজনক সাড়া পেয়েছেন নাসরিন জামির। তার ভাষায়, "টাকা-পয়সা হয়তো কম আসছে। তবু নিজের পছন্দের জায়গা নিয়ে কাজ করতে পারছি বলে খুব খুশি আমি। দেশের বাইরে থাকা প্রবাসী বাঙালিরাও জোনাকি ব্র্যান্ডের উপর ভরসা করছেন। জোনাকি নামটা তাদের আপনবোধ করাতে পারছে।" ২০২১ সাল থেকে জোনাকি ব্র্যান্ডের অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রীও বাজারে আনছেন নাসরিন জামির। বর্তমানে এই তালিকায় আছে জোনাকির নিজস্ব লিপস্টিক, কমপেক্ট পাউডার, আইল্যাশ ও জেল আইলাইনার। টেক্সটাইল ডিজাইনার হিসেবে জোনাকি ফ্যাশন ব্র্যান্ড শুরু করার কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন নাসরিন।
আঁধারের বাতি জোনাকির প্রতি ভালোবাসা থেকে প্রকৃতিতে জোনাকি বাঁচিয়ে রাখার সচেতনতা বাড়াতে প্রতিষ্ঠা করেছেন জোনাকি ফাউন্ডেশন। জোনাকি ব্র্যান্ডের লভ্যাংশ থেকে ৫ শতাংশ যায় এই জোনাকি ফাউন্ডেশনের কাজে।
বিশ্বমানের পারফিউম ব্র্যান্ড হিসেবে জোনাকিকে গড়ে তুলতে আশাবাদী নাসরিন জামির বলেন, "আমি আশা করি বাংলাদেশেও একদিন না একদিন উন্নতমানের পারফিউম বানানোর মতো ল্যাবের ব্যবস্থা হবেই। দেশে একটা কেমিক্যাল ল্যাব হবে, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি হবে, সেখানে আমরা কাজ করতে পারব সে স্বপ্ন দেখি।"