একটি বিয়ে এবং বোমা, একটি চিঠি ও এক অচিন্তনীয় খুনি

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি। সদ্য বিয়ে করেছেন ভারতের উড়িষ্যার পাটনাগড়ের বাসিন্দা সৌম্য সেখর সাহু ও রিমা সাহু। দুচোখে ভবিষ্যৎ জীবনের রঙিন সব স্বপ্ন।
উপহারের বাক্সে মৃত্যু
বিয়ের পাঁচ দিন পর নবদম্পতির কাছে এল একটি পার্সেল। বাক্সের ওপরে সাঁটানো স্টিকারে লেখা, ওটা এসেছে ২৩০ কিলোমিটার দূরের রায়পুর শহরের এসকে শর্মার কাছ থেকে।
রান্নাঘরে গিয়ে বাক্সটি খুললেন পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সৌম্য। ভেতর থেকে বেরোল সবুজ কাগজে মোড়ানো একটি পার্সেল। একটা সাদা সুতো বেরিয়ে এসেছে পার্সেলটি থেকে। এ সময় সৌম্যর ৮৫ বছর বয়সি দাদি জিমামনি সাহু পেছন থেকে এগিয়ে এলেন পার্সেলটিতে কী আছে দেখবার জন্য।
সৌম্য তার স্ত্রীকে বললেন, কেউ সম্ভবত তাদের সারপ্রাইজ গিফট পাঠিয়েছে। যদিও এসকে শর্মা নামের কাউকে তারা কেউই চিনতেন না।
যাহোক, পার্সেল খোলার জন্য সাদা সুতোটি ধরে টান দিলেন সৌম্য। পরক্ষণেই একটা আলোর ঝলকানি...তারপর বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল রান্নাঘর। রক্তাক্ত সৌম্য, রিমা ও জিমামনি লুটিয়ে পড়লেন মেঝেতে। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল গোটা রান্নাঘর, জানালা ভেঙে উড়ে গিয়ে পড়ল পাশের মাঠে।
আগুন ধরে গেল জিমামনির গায়ে। জ্ঞান হারাতে হারাতে সৌম্য বলছিলেন, 'বাঁচাও। আমি বোধহয় মরে যাচ্ছি।'
এ-ই ছিল স্বামীর মুখ থেকে রিমার শোনা শেষ কথা।
রিমার হাত-মুখ পুড়ে যায়। ফুসফুস ভরে যাচ্ছিল ধোঁয়ায়। ঝাপসা হয়ে আসছিল দৃষ্টি। তবু প্রাণপণে হামাগুড়ি দিয়ে বেডরুমে গিয়ে ফোনটা হাতে নিলেন শাশুড়িকে কল করার জন্য। কিন্তু ফোন করার আগেই জ্ঞান হারালেন।
প্রতিবেশীরা এসে উদ্ধার করে তিনজনকে হাসপাতাল নিয়ে যান। হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান জিমামনি, হাসপাতালে পৌঁছার পর মৃত্যু হয় সৌম্যর। প্রাণে বাঁচেন শুধু রিমা।
আততায়ী কে?
এরপর কেটে গেল পুরো একটা মাস। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের হোতা কে, কারণ কী—এসব সম্পর্কে কোনো সূত্রই পাচ্ছিল না পুলিশ।
রিমার বাবা সুদাম চরণ সাহু বিবিসিকে বলেন, 'আমরা সাধারণ মানুষ। সাদাসিধে আমাদের জীবনযাপন। আমাদের কোনো শত্রু নেই। আমার মেয়েরও কোনো শত্রু নেই। আমার জামাতারও কোনো শত্রু ছিল না। ...এ কাজ কে করতে পারে, সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই।'

সুদাম চরণ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। রিমা আসলে তার ছোট ভাইয়ের মেয়ে। পরপর দুই ছেলে হওয়ার পর তিনি ভাইয়ের মেয়েকে দত্তক নেন। হাসিখুশি, উচ্ছল স্বভাবের রিমা পড়াশোনা করেন ওড়িয়া ভাষার ওপর।
আর সৌম্য সেখরের বাবা-মা দুজনেই ছিলেন কলেজ শিক্ষক। তার বাবা পড়াতেন প্রাণিবিদ্যা।
সৌম্য ও রিমার বিয়ে হয়েছিল পারিবারিকভাবে। বিয়ের এক বছরের কিছু বেশি সময় আগে তাদের মধ্যে বাকদান সম্পন্ন হয়।
রিমা স্বামীর মৃত্যুর খবর জানতে পারেন তিন সপ্তাহ পর—হাসপাতালে শুয়ে—পুরোনো পত্রিকা পড়ে। পরিবারের কেউ তাকে খবরটি জানানোর সাহস পায়নি। খবরটা পড়েই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
অথই জলে পুলিশ
উপহারের বাক্সে বোমা পুরে এরকম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কেঁপে ওঠে গোটা ভারত।
কিছুতেই কেসটির কূলকিনারা পাচ্ছিল না পুলিশ।
একমাত্র সূত্র ছিল মারা যাওয়ার আগে সৌম্যর কাছে আসা একটি ফোনকল। তিনি তখন চাকরিসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে থাকেন।
ওই সময়ের কথা স্মরণ করে রিমা বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, এক বছর আগে তার সঙ্গে কথা বলার সময় সৌম্যর কাছে একটি ফোনকল আসে। পরে রিমাকে সৌম্য জানান, তাকে এক লোক ফোন দিয়ে হুমকি দিয়েছে তিনি যেন কিছুতেই রিমাকে বিয়ে না করেন। বিয়ে করলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে বলেও সৌম্যকে হুমকি দেয় সে। লোকটি নিজেকে রিমার প্রেমিক দাবি করে।
তবে এরপর আর কোনো হুমকি দেয়া ফোনকল আসেনি। পরে তারা ব্যাপারটা ভুলে যান।
পুলিশ শুধু একটা ব্যাপারই নিশ্চিতভাবে জানতে পারে—উপহারের পার্সেলটি এসেছিল রায়পুর থেকে, ভুয়া নামে। খুনি ৪০০ রুপি ডেলিভারি চার্জ দিয়ে খুব সতর্কতার সঙ্গে কুরিয়ার কোম্পানি বাছাই করে। কুরিয়ার অফিসে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না। পার্সেলটিও স্ক্যান করা হয়নি।
এরপর পার্সেলটি তিনটি বাসে ৬৫০ কিলোমিটার ভ্রমণ করে, চারজোড়া হাত পেরিয়ে অবশেষে ২০ ফেব্রুয়ারি পাটনাগড়ে পৌঁছে। ডেলিভারিম্যান ওই দিনই সন্ধ্যায় সৌম্যর বাড়িতে যায় পার্সেল পৌঁছে দিতে। কিন্তু গিয়ে দেখে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে, তাই ফিরে আসে। এর তিন দিন পর সে সৌম্যর বাড়িতে পার্সেল দিয়ে আসে।
ব্যস, এছাড়া আর কোনো তথ্যই পুলিশ নিশ্চিত করে জানতে পারছিল না। পরের কয়েক মাসে দুই পরিবারের শতাধিক আত্মীয় ও বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্ত কর্মকর্তারা। হাজার হাজার মোবাইল ফোনের রেকর্ড সংগ্রহ করেন, সৌম্য ও রিমার ল্যাপটপ-মোবাইল পরীক্ষা করেন। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না।

যে ছেলে নিজেকে রিমার প্রেমিক দাবি করে সৌম্যকে হুমকি দিয়েছিল তাকেও খুঁজে বের করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। কিন্তু দেখা গেল ওটা নেহাত ব্যর্থ অনুরাগীর নিষ্ফল তর্জনগর্জন ছিল। তাই তাকেও ছেড়ে দেয়া হয়।
এল উড়োচিঠি, জোড়া লাগাল রহস্যের ছেঁড়া সুতো
অবশেষে মৃতপ্রায় মামলা প্রাণ ফিরে পায় এক উড়োচিঠির কল্যাণে।
হত্যাকাণ্ডের প্রায় দেড় মাস পর, এপ্রিলের প্রথমদিকে উড়িষ্যার বালানগির জেলার পুলিশ চিফের কাছে একটি চিঠি আসে। ওটার ওপরে প্রিন্ট করে লেখা ছিল—'গুরুত্বপূর্ণ চিঠি'। জানানো হয়, 'বিশেষ এক বার্তাবাহক' ওই চিঠিখানা প্রেরকের হয়ে পুলিশের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।
ইংরেজিতে লেখা ১৩০ শব্দের ওই অদ্ভুত চিঠিখানায় প্রেরকের নাম-ঠিকানা ছিল না।
ওই বেনামি চিঠিতে বলা হয়, বোমাঅলা পার্সেলটি পাঠানো হয়েছিল এসকে সিনহা নামে, আরকে শর্মা নামে নয়। ওতে আরও বলা হয়, 'এই প্রকল্পটি সম্পন্ন করেছে তিনজন ব্যক্তি' এবং তারা 'এখন পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে'।
উড়োচিঠিতে লেখা হয়, ওই বোমা পাঠানোর কারণ ছিল 'প্রতারণা' ও টাকা। প্রথম কারণটি কোনো ক্ষুব্ধ প্রেমিকের দিকে ইঙ্গিত করে, আর দ্বিতীয় কারণ আঙুল তোলে সম্পত্তি-সংক্রান্ত বিবাদের দিকে।
চিঠির প্রেরক লেখে, '[সৌম্যর] গোটা পরিবারকে খুন করলেও আমাদের ক্ষতিপূরণ হবে না'।
সবশেষে সে লেখে, পুলিশের উচিত 'চুপ থাকা' এবং 'নির্দোষ মানুষকে হেনস্তা, সন্দেহ ও অবান্তর প্রশ্ন না করা'।
পুলিশ যখন কিছু করতে পারছিল না তখন সংবাদমাধ্যম ও জনগণের চাপে সরকার কেসটি এলিট ক্রাইম ব্রাঞ্চের কাছে হস্তান্তর করে।
কেসের দায়িত্ব পান ক্রাইম ব্রাঞ্চ চিফ অরুণ বোথরা। পুলিশে যোগ দেয়ার আগে তিনি ছিলেন সাংবাদিক। ৩০০ কিলোমিটার দূরে, উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বরে বসে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে বেনামি চিঠিখানার ছবি পান।
অরুণ বোথরা বিবিসিকে বলেন, 'সারাদিন, সারা রাত ধরে আমি চিঠিটা পড়লাম। অন্তত কয়েকশোবার পড়েছি ওটা। অনেক কিছুই জানতে পারলাম চিঠিখানা থেকে।
'এটুকু স্পষ্ট যে, চিঠিটা যে পাঠিয়েছে, সে অপরাধ সম্পর্কে আমাদের চেয়ে বেশি জানে। তবে সে আবার এ-ও লিখে দিয়েছে যে, চিঠিটা সে বার্তাবাহকের মাধ্যমে পাঠাচ্ছে। এর মাধ্যমে লোকটা আমাদের বোঝাতে চেয়েছে যে অপরাধটা স্থানীয় কেউ করেনি।
'সে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, পরিকল্পনাটা তিনজন মানুষ মিলে বাস্তবায়ন করেছে। লোকটা চেয়েছে আমরা যেন তাকে গুরুত্ব দিই। আমাদের করা একটা ভুলের দিকে আঙুল তুলে লোকটা নিজের ভুয়া পরিচয় আরেকটু হলেই ফাঁস করে দিচ্ছিল।'
কেসের নথিপত্র ঘেঁটে অরুণ বোথরা দেখেন পার্সেলের রসিদে লেখা নাম উদ্ধারে পুলিশ ভুল করে ফেলেছে। ওই অস্পষ্ট, তাড়াহুড়ায় লেখা নামটার সঙ্গে এসকে শর্মা-র মিল পেলেন না তিনি।
অরুণ বলেন, 'লেখাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে বুঝবেন, নামটা খুব সম্ভব এসকে সিনহা বা এসকে সিং। শেষের ওই প্যাঁচটা দেখুন। অথচ পুলিশ, মিডিয়া, হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া সবাই বারবার বলছিল, প্রেরকের নাম এসকে শর্মা। আর আমরা যেহেতু জানতাম লোকটা ছদ্মনাম ব্যবহার করেছে, তাই এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাইনি।
'আমার কেন যেন শুরু থেকেই মনে হচ্ছিল, চিঠিটা পাঠিয়েছে হত্যাকারী নিজেই। নইলে সে কীভাবে জানল যে পার্সেলটা এসকে সিনহা পাঠিয়েছে?'
এই বেনামি চিঠিখানাই শেষতক তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দিল।
লেখার ধরন ধরিয়ে দিল খুনিকে
ফরেনসিকের বিজ্ঞানীরা জানালেন, চিঠিতে তারা কয়েকটি অস্পষ্ট আঙুলের ছাপ পেয়েছেন। যদিও ওগুলো থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না।
এরপর তারা চিঠির খামটি গবেষণাগারে পাঠানো হয় পরীক্ষা করে দেখবার জন্য। প্রেরক থুতু দিয়ে খামের মুখ আটকে থাকলে পরীক্ষায় তার জেনেটিক প্রোফাইল পাওয়া যাবে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হলো না।
এরপর তদন্তকারীরা চিঠিটি দুই পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠান। পরিবারের সদস্যদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তারা কাউকে সন্দেহ করেন কি না।
নিহত সৌম্যর মা—স্থানীয় এক কলেজের শিক্ষক—চিঠিখানা অনেকবার পড়েন।
অবশেষে তিনি জানান, চিঠিটি তার এক সহকর্মীর লেখা হতে পারে। ওই সহকর্মী কলেজের ইংরেজি শিক্ষক।

সৌম্যর মা বলেন, তার ওই সহকর্মী এবং চিঠির প্রেরকের লেখা ও শব্দচয়ন একই ধরনের।
এছাড়া আরেকটা ইন্টারেস্টিং তথ্য দেন সৌম্যর মা। তিনি জানান, তার কলেজের ওই ইংরেজি শিক্ষক প্রায়ই 'প্রকল্প সম্পন্ন করা' কথাটি ব্যবহার করেন।
এবার আশার আলো দেখতে পেলেন তদন্তকারীরা। ডেকে পাঠালেন ওই ইংরেজি শিক্ষককে।
কর্মস্থলের দ্বন্দ্ব, আহত অহম
ওই ইংরেজি শিক্ষকের নাম পুঞ্জি লাল মেহের। বয়স ৪৯। বিস্ফোরণের এক সপ্তাহ পরই তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তার কথাবার্তা বা কাজকর্মে তখন সন্দেহ করার মতো কিছুই পাওয়া যায়নি।
সৌম্যর মা পুলিশকে জানিয়েছিলেন, এক বছর আগে পুঞ্জি লাল মেহেরকে সরিয়ে তাকে অধ্যক্ষ করা হয়। এরপর থেকে তিনি প্রায়ই সৌম্যর মাকে বিরক্ত করতেন।
জানা যায়, পুঞ্জি লাল মেহের ও সৌম্যর মা—দুজনে প্রকাশ্যে একে অপরকে অপমান করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত পুঞ্জি লাল নিজের নিয়তি মেনে নিয়েছিলেন।
পুলিশ পুঞ্জি লালকে সন্দেহ করার মতো কিছুই পায়নি। তারা ভেবেছিল, দুজনের রেষারেষি কর্মস্থলের সাধারণ দ্বন্দ্বের বাইরে অন্য কিছু নয়।
পুঞ্জি লাল দেখতে ফিটফাট ভদ্রলোক। ফেসবুকে আপলোড করা একটি ছবিতে দেখা যায়, ফর্মাল স্যুট ও ব্লেজার পরে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে সোনালি রঙের ঘড়ি, আঙুলে সোনার আংটি, গলায় চকচকে টাই, পায়ে শ্যু। আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, মোটরসাইকেলে বসে আছেন। পরনে কমলা শার্ট, চোখে চশমা।
টুইটারে তিনি মানবতাবাদী। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির একটি টুইটে লিখেছেন—'একটাই ধর্ম থাকা উচিত—মানবতার ধর্ম।'
পুঞ্জি লাল ১৯৯৬ সালে কলেজ শিক্ষকতায় যোগ দেন। ২০১৪ সালে অধ্যক্ষ হন।
সৌম্যর মায়ের বক্তব্য শোনার পর অরুণ বোথরার পরামর্শে তদন্তকারীরা ফের পুঞ্জি লালকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
জিজ্ঞাসাবাদে পুঞ্জি লাল পুলিশকে জানান, কদিন আগে সন্ধ্যায় যখন হাঁটতে বেরোন, তখন একজন লোক তাকে থামায়। লোকটি তার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলে, বালানগির শহরে গিয়ে ওটা পুলিশের হাতে পৌঁছে দিতে হবে; তা নাহলে পুঞ্জি লালের ক্ষতি করবে।

অরুণ বোথরা বলন, 'এটাই একজন সন্দেহভাজনের মুখ থেকে শোনা সবচেয়ে অবিশ্বাস্য গল্প।'
এরপর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে উদ্ঘাটন হয় পুরো রহস্য।
আসল কাহিনি
জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে, পুঞ্জি লালই নাটের গুরু। অত্যন্ত সুচারুরূপে পুরো হত্যাকাণ্ডের আয়োজনটি করেন তিনি।
পুঞ্জি লাল জানান, ২০১৭ সালের অক্টোবরে দিওয়ালি উৎসবের সময় তিনি আতশবাজি ও পটকা কিনে জমাতে শুরু করেন। কিনে আনা আতশবাজি থেকে গানপাউডার বের করে নেন। তারপর বোমা বানাতে শুরু করেন সেগুলো দিয়ে। বোমা বানাতে মাস দুয়েক লেগে যায়। এরপর বোমাটিকে একটা কার্ডবোর্ডের বাক্সে পুরে বাক্সটি উপহারের কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে দেন।
তারপর ফেব্রুয়ারির এক সকালে কলেজে গিয়ে একটা ক্লাস নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন পুঞ্জি লাল। এরপর বোমার বাক্স নিয়ে মোটরসাইকেলে চেপে চলে যান রেলস্টেশনে। ডাটসান সেডান বাড়িতে রেখে যান।
মোবাইল ফোনটাও বাড়িতে রেখে আসেন। উদ্দেশ্য, তিনি যে সারাক্ষণ বাড়িতেই ছিলেন, এরকম অ্যালিবাই তৈরি করা।
এরপর টিকিট না কেটেই ট্রেনে চেপে বসেন পুঞ্জি লাল। আড়াই ঘণ্টা পর এসে নামেন রায়পুর স্টেশনে। সিসিটিভি ক্যামেরায় যেন ধরা না পড়েন, সেজন্য টিকিটও কাটেননি।
পুলিশের ধারণা, রায়পুরে নেমে পুঞ্জি লাল প্রথমে একটা সাইকেল রিক্সা নেন। তারপর ওঠেন একটা টুক-টুকে।
প্রথমে একটা কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসের সামনে থেমে রিক্সাচালককে দিয়ে পার্সেলটি ভেতরে পাঠান। কিন্তু একজন কর্মী পার্সেলে কী আছে জানতে চাইলে পুঞ্জি লাল ভয় পেয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে কুরিয়ার অফিসে ঢুকে পার্সেলটি ফিরিয়ে আনেন।
এরপর আরেকটি কুরিয়ার অফিসে যান পুঞ্জি লাল। সেখানে বলেন, বাক্সের ভেতরে 'গিফটের জিনিস, মিষ্টি' আছে। ওই অফিস থেকে পার্সেলটা পাঠিয়ে সন্ধ্যার ট্রেনে বাড়ি ফেরেন তিনি।
এর পরের কয়েকদিনে বোমাভর্তি পার্সেলটি তিনটি বাসে চেপে ৬৫০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে, চারজোড়া হাত ঘুরে, ২০ ফেব্রুয়ারি পাটনাগড়ে পৌঁছায়।
এর তিন দিন পর সৌম্য সেখর সাহুর বাড়িতে বিস্ফোরিত হয় বোমাটি।
সৌম্য ও রিমার বিয়েতে গিয়েছিলেন পুঞ্জি লাল মেহের। গিয়েছিলেন সৌম্যর শেষকৃত্যেও।

পুলিশকে পুঞ্জি লাল বলেন, 'প্রচণ্ড রাগ আর ঘৃণায় আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। [সৌম্যর মায়ের কাছে] অপমানিত হওয়ার ব্যাপারটি কিছুতেই হজম করতে পারছিলাম না।'
এ জবানবন্দির পর পুঞ্জি লাল মেহেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এভাবেই একটি 'পারফেক্ট ক্রাইম' সম্পন্ন করার পরও স্রেফ একটি বেনামি চিঠিই কাল হয়ে দাঁড়াল অপরাধীর জন্য। স্রেফ কয়েকটি শব্দচয়ন ধরিয়ে দিল তাকে।
- সূত্র: বিবিসি থেকে অনূদিত