গাছের ফেরিওয়ালাদের হাত ধরে যেভাবে অনলাইনে বিতরণ-বিক্রি জনপ্রিয় হচ্ছে

ইট-পাথরে বন্দী শহরে এক ফালি শান্তির সুবাতাস এনে দিতে যে উপাদানটি সবচেয়ে বেশি কাজ করে সেটি হলো গাছ। শুধু অক্সিজেনের উৎস হিসেবেই নয়, শহুরে যান্ত্রিকতা ভুলে ঘরোয়া নান্দনিকতা বৃদ্ধিতেও গাছের জুড়ি মেলা ভার। এই গাছ নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলা যায় বৃক্ষের ফেরিওয়ালার মতো অক্সিজেন মানুষের দ্বারে পৌঁছে দিচ্ছেন।
উদ্যোক্তাদের মধ্যে কেউ কাজ করছেন শখের বশে আবার কেউবা গাছ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে আগানোর চিন্তাভাবনা করে যাচ্ছেন। কেউ কাজ শিখেছেন গুরুর কাছ থেকে, কেউবা বাজার গবেষণা করে গ্রাহক কী চায় সে অনুসারে ব্যবসায় পরিকল্পনা করে কাজ করছেন। উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেই অনলাইন মাধ্যমকে ব্যবহার করে মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন, ছড়িয়ে দিচ্ছেন শান্তি।
চিত্রা এক্সপ্রেস থেকে সাবরীলের 'চিত্রা-বৃক্ষ হাট'
'প্রচুর গাছ দিয়ে অফিস না সাজিয়ে কম গাছ দিয়ে ডেকোরেটিভ ওয়েতে সাজান, যাতে অফিস দেখতে আকর্ষণীয় লাগে', বলছিলেন চিত্রা-বৃক্ষ হাট এর উদ্যোক্তা সাবরীল রহমান। মূলত কম সামগ্রী দিয়ে আকর্ষণীয়ভাবে কীভাবে বাসা কিংবা অফিস সাজানো যায় তা নিয়েই কাজ করে চিত্রা-বৃক্ষ হাট। এখানে শুধু গাছ বা সিরামিকের টবই নয় বরং মাটির টব ও দেয়ালে ঝোলানো ধাতব সামগ্রীর মাধ্যমে গাছের ব্যবহার ছড়িয়ে দেয়ার দিকেও লক্ষ্য রাখেন তারা।

সাবরীলের গাছের জগতে আসার পথটাও বেশ চমকপ্রদ। বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করে একসময় চাকরি নেন বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডে। করোনা মহামারির শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে হয়ে যাওয়ার জোগাড় হলে সাবরীল এই কোম্পানির আওতায় চারটি 'প্রমোশনাল ব্যবসা' শুরু করার পরিকল্পনা করেন। তার মধ্যে একটি পরিকল্পনা ছিল গাছ নিয়ে কাজ করার।
গাছ নিয়ে ব্যবসায় করা হবে এটা শুরুর দিকে কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরদের পছন্দের ছিল না। অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে নিজ উদ্যোগেই ব্যবসায় শুরু করেন সাবরীল। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেলিভারির কাজ করতো দেখে শুরুর দিকে প্রমোশনাল বিজনেস ব্র্যান্ডের নাম ছিলো চিত্রা এক্সপ্রেস। সেটারই প্রমোশনাল ক্যাম্পেইন হিসেবে শুরু করা হয় চিত্রা-বৃক্ষ হাট। বাজারে গাছের চাহিদা কেমন এবং গ্রাহকরা গাছের ব্যবসায়কে কীভাবে নিচ্ছে তা জানার জন্য প্রথমে ছয় মাসের টার্গেট নেওয়া হয়। ছয় মাস বাজার গবেষণার পর দেখা গেলো বেশ ভালোই সাড়া পাওয়া যাচ্ছে গ্রাহকদের থেকে।
বাজারে গাছের উপর কমার্শিয়ালি ভালো কোনো দোকান না থাকায় সাবরীলের মাথায় আসে অফিসিয়াল দোকান দেওয়ার কথা। পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণ হিসেবে কাজ শুরু হওয়ায় প্রাথমিকভাবে তেমন কোনো বিনিয়োগই এই ব্যবসায়ে ছিল না; অফিসের বোর্ড অব ডিরেক্টররা কেবল চার মাসের জন্য অফিসের কিছু অংশ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল। এছাড়াও গাছ সরবরাহের জন্য কিছু সাপ্লায়ারদের শুরু থেকে ব্যবসায়ে যুক্ত করে নেওয়া হয়। তাদের মাধ্যমেই ব্যবসায়ের কাজ শুরু হয়।
যশোর, আশুলিয়া, কাপাসিয়া, গাজীপুর থেকে মূলত সরবরাহকারীরা চারা সংগ্রহ করে থাকে। গাছ ছাড়াও চিত্রা-বৃক্ষ হাটে পাওয়া যাবে সার, মাটির তৈরি সামগ্রী, ঘর সাজানোর বিভিন্ন ধাতব সামগ্রী। সাবরীলের তত্ত্বাবধানে দুইজন কুমোর কাজ করে, যারা মূলত মাটির টব ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরির কাজ করে।

বর্তমানে চিত্রা-বৃক্ষ হাটে দুই শতাধিক গাছ রয়েছে। যার মধ্যে বেশি আছে সেমি ইনডোর প্ল্যান্ট, অল্প কিছু ইনডোর প্ল্যান্ট, সাকুলেন্ট আছে। আউটডোর প্ল্যান্টের মধ্যে আছে ফলজ গাছ, ফুল গাছ আছে।
চিত্রা-বৃক্ষ হাট থেকে সাবরীল ও তার দলের মাসিক আয় পাঁচ লক্ষ টাকার কাছাকাছি। শুরু থেকে সাবরীল ও তার দল যেভাবে পরিকল্পনা করে কাজ শুরু করে, তাদের আশা ছিলো আয় আরো বেশি হবে। শুরু থেকে ১০ জন মিলে দল আকারে কাজ করলেও বর্তমানে তা ৮ জনে ঠেকেছে।
ফেসবুক, ইনস্ট্রাগ্রাম, ওয়েবসাইটে সমানতালে ব্যবসা করে যাচ্ছে চিত্রা-বৃক্ষ হাট। তবে বর্তমানে চিত্রা-বৃক্ষ হাটের উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেলিভারি ব্যবস্থা। সমগ্র ঢাকাকে ৬টি ভাগে ভাগ করে ডেলিভারির কাজ করা হয়। পিকাপ ভ্যান একেকদিন একেক এলাকায় গিয়ে পণ্য সরবরাহ করে থাকে। ডেলিভারি ব্যবস্থা নিয়ে সাবরীল বলেন, 'মিরপুরে যেমন আমরা সবসময় বুধবারে ডেলিভারি দেই। এটার কারণে যেটা হয়, যিনি বুধবার সকালে অর্ডার করেন তিনি পরের বুধবারে গাছ হাতে পান। এটা অনেক গ্রাহক পছন্দ করেন না। এতে অনেক অর্ডার ক্যান্সেল হয়'। পরিবহন ব্যবস্থা কম থাকার কারণে সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। তাই বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে প্রচুর অর্ডার আসলেও সেগুলো সবসময় গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।
২০২০ সালের আগস্ট মাসে শুরু করা চিত্রা-বৃক্ষ হাট আর কিছুদিন পরেই দুই বছর পূর্ণ করবে। বর্তমানে সাবরীলের চিত্রা-বৃক্ষ হাট গাছ ও অন্যান্য সামগ্রী বিক্রির পাশাপাশি বাংলাদেশের আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে কীভাবে দেশের বাইরে থেকে আনা গাছের পরিচর্যা করতে হয় তা সহ আরো বিভিন্ন গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাবরীলের সঙ্গে এ কাজে যুক্ত আছেন বাংলাদেশ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। এ গবেষণা আরো সময়সাপেক্ষ ও এর জন্য আরো অনেক ফান্ডিং প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সাবরীল।
একাকিত্ব ঘোচানোর বন্ধু গাছই এখন আসিফের জীবিকার উৎস
ক্যাকটাস লাভার হিসেবে বগুড়ার আসিফ এখন 'আসিফ দ্যা ক্যাকটো বয়' হিসেবেই অধিক পরিচিত। ছোটবেলা থেকে গাছ ভালোবাসলেও গাছ নিয়ে যে ব্যবসায় করে উদ্যোক্তা বনে যাবেন এমন আশা তার ছিল না। যাত্রা শুরু শখ থেকে হলেও তার জীবনে একাকিত্ব ঘোচানোর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে গাছ।
ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন সময়ে যখন বাবা মারা যায়, তখন অনেকটাই যখন দিশেহারা আসিফ। সে সময় দুই একটা গাছ লাগানো শুরু করেছিলো মন ভালো করার জন্য। তারপর শখের বশেই দুটো থেকে পাঁচটা, পাঁচটা থেকে দশটা করে গাছের সংখ্যা বেড়ে যায় আসিফের বাসায়।
কিন্তু শখ তো শুধু শখ নয়, শখ পূরণের জন্য প্রয়োজন হয় অর্থ। অর্থ উপার্জনের জন্য গাছ নিয়ে ব্যবসায় করার প্রাথমিক পরিকল্পনা করে বসেন আসিফ। এ প্রেক্ষিতে আসিফ বলেন, 'আমি যদি দশটা গাছ কিনে নিয়ে এসে বিক্রি করি, তাহলে লাভে অন্তত দুইটা তিনটা গাছ থাকবে। এভাবে ধীরে ধীরে বাড়ছে। আমি নিজেও বুঝতে পারিনি, গাছ নিয়ে যে বিজনেস করবো এরকম কোনো পরিকল্পনা প্রথমে ছিলো না'।

টিউশনির টাকাই আসিফের ব্যবসায় শুরু করার প্রাথমিক পুঁজি। আসিফের ভাষ্যমতে, টিউশনির টাকার পুরোটাই তিনি গাছের পেছনে ব্যয় করতেন। তাছাড়া বাড়ি বগুড়ায় হওয়ায় আশপাশ থেকেই চারা সংগ্রহ করতেন। প্রথম দিকে মহাস্থানগড়ের দিকের কিছু বড় নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করতেন। ধীরে ধীরে ঢাকা, চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে ইন্ডিয়া, থাইল্যান্ড থেকেও চারা সংগ্রহ শুরু করেন তিনি।
করোনা মহামারিতে অন্যান্য উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় তুলনামূলক ভালো চললেও ভালো চলেনি আসিফের। আসিফ বলেন, 'করোনার সময় বিজনেস আমাদের খারাপই গিয়েছে, কারণ আমরা তো ঢাকার বাইরের। ঢাকার বাইরে যারা ছিলো তাদের জন্য ঢাকায় গাছ পাঠানো কঠিন ছিল। আমরা এত দূর থেকে ডেলিভারি দিতে পারছিলাম না। এজন্য করোনায় খুব একটা সুবিধা হয়নি'।
তবে বর্তমানে মাসিক ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা আয়ের সুযোগ হয় এই তরুণের।
একা হাতেই পুরো ব্যবসায় সামলাতে হয় আসিফকে। তাই কম জায়গায় করা যায় এমন গাছই আসিফের ভাণ্ডারে বেশি। আসিফের বাগানে ক্যাকটাস, সাকুল্যান্ট, কাঁটামুকুট, এডেনিয়াম , বাগানবিলাস, বনসাই , পাতাবাহার, স্নেক প্লান্ট, ক্যালাডিয়ামসহ নানাজাতের গাছ রয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই ইনডোর প্ল্যান্ট।
অনলাইনে মাধ্যমে গাছ বিক্রির ক্ষেত্র হিসেবে আসিফ ফেসবুকই বেছে নিয়েছেন। ফেসবুক পেজ ছাড়াও তথ্যমূলক ভিডিওর জন্য 'আসিফ দ্যা ক্যাকটো বয়' ইউটিউব চ্যানেল সাড়া ফেলেছে। এছাড়াও ক্যাকটাস, সাকুল্যান্ট ও বিরলগাছ কেন্দ্রিক দেশের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আসিফ ২০১৭ থেকে বাংলাদেশ ক্যাকটাস লাভারস সোসাইটি নামে গ্রুপ খোলেন, আর সাধারণ গাছের জন্য খুলেছেন বাংলাদেশ প্লান্ট লাভারস সোসাইটি।
এছাড়াও যমুনা নদীর পাড়ের অসহায় মানুষদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন পারুল ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের আওতায় টিউবয়েল স্থাপন, গর্ভবতী নারীদের সাহায্য, শিক্ষাবৃত্তির আয়োজন করা হয়।
তবে গাছের নেশাকে পেশা হিসেবে ভাবতে নারাজ আসিফ। আসিফের আশঙ্কা তিনি যদি শখকে পেশার পর্যায়ে নিয়ে যান, তবে গাছের প্রতি সেই ভালোবাসা থাকবে না। তাই ভালোবাসার সাথেই তিনি গাছ নিয়ে থাকতে চান।
চাকরি খুঁজতে গিয়ে উদ্যোক্তা টাঙ্গাইলের মীম
'প্রত্যেকটা মানুষই একটা বয়সের পর নিজে কিছু করতে চায়। ওভাবে আমার কিছু হচ্ছিলো না, আমি তো মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। একটা চাকরি করা দরকার ভাবনা থেকে এক বাসায় যাই চাকরি সংক্রান্ত কথা বলতে। যাই হোক সেই বাড়িতে চাকরি হয়নি কিন্তু ঐ বাড়িতে অনেক গাছ দেখি। তখন মনে হলো চাকরি যখন হলো না, আপাতত একটু গাছ নিয়ে থাকি। ওই বাড়ি থেকে কিছু গাছ সাথে করে নিয়ে আসি', বলছিলেন টাঙ্গাইলের পুর্তলিকা ফুল ব্যবসায়ী মীম।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে 'পর্তুলিকা সমাহার' পেজ ও গ্রুপের মাধ্যমে ব্যবসায়ের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
চাকরি খুঁজতে গিয়ে উদ্যোক্তা বনে যাবেন এমন কিছু কল্পনাতেও ছিলো না মীম আক্তারের। ছোটবেলা থেকেই ছিলো গাছের সাথে সখ্যতা। যেখানেই যেতেন সেখান থেকে ছোট ছোট গাছের চারা বীজ নিয়ে এসে সাজাতেন নিজের আঙ্গিনা। লাল, হলুদ পর্তুলিকা ফুল নিজের রঙিন আঙ্গিনা সাজাতে সাজাতে একসময় মীমের মনে হলো শখ থেকে ব্যবসায় শুরু করাই যায়। সময়টা ছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস; প্রাথমিক পুঁজি হিসেবে নিজের জমানো ২০০-৩০০ টাকা দিয়েই শুরু করেন ব্যবসায়। গাছ ব্যবসায় জগতে নতুন হওয়ায় থিতু হতেও বেশ সময় লাগে। সবমিলিয়ে পরিপূর্ণভাবে বিক্রির কাজ শুরু করেন ২০২১ সালে।

গুছিয়ে ব্যবসায় শুরু করার পরেই আসে সফলতা। করোনা মহামারির সময়ে ৫ মাসে চারা বিক্রি করে আয় করেন এক লাখ টাকা। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় মীমের। ভাবতে থাকেন ব্যবসা কীভাবে বড় করা যায়। অনার্স পড়া অবস্থায় ব্যবসায় শুরু করার কারণে শুরুর দিকে পরিবারের সহায়তা না পেলেও সে সময় এগিয়ে আসেন মীমের হবু স্বামী। একে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তার ওপর পাড়া-প্রতিবেশীদের বাঁকা চোখে তাকানোও কোনো অংশে কম ছিলো না। তা সত্ত্বেও সমাজের চোখ রাঙানোকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যান মীম।
২০২১ সালে লাখ খানেক টাকা আয় করলেও সে সুখ বেশিদিন সয়নি। আকস্মিক বন্যা এসে সব তছনছ করে দেয়। কিন্তু হাল ছাড়েননি মীম। ২০২২ সালে ক্ষতি কাটিয়ে সাড়ে তিন মাসে বিক্রি করেন ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার চারা। সাড়ে তিন মাসের মধ্যে এক সপ্তাহেই ২৬ হাজার টাকার মতো আয় করেন। এটা শুধুই পুর্তলিকা ফুলের চারা বিক্রি করে আয় করেছেন। এ বছরে বিনিয়োগও খুব বেশি ছিল না। হাজার টাকা বিনিয়োগ করেই তিন মাসে লাখ টাকার উপরে বিক্রি করেছেন মীম। তবে সব মাসেই সমান আয় থাকে না। কিছু কিছু মাসে দেখা যায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকাও আয় হয় তার।

পুর্তলিকার ক্ষেত্রে যেহেতু একটি গাছ থেকেই আরেকটি গাছ হয়ে যায় বাগান তৈরি হয়ে যায় তাই নিয়মিত চারা কিনতে হয় না মীমের। তার উপর নিজের বাড়ির পাশে জমি থাকায় মাটিও ছিলো সহজলভ্য । বর্তমানে মীম আক্তারের বাগানের প্রায় ৮০ জাতের পুর্তলিকা গাছ আছে। এছাড়াও আছে প্রায় ৫০ জাতের লিলি, ক্যাকটাস, সাকুল্যান্ট গাছ।
বর্তমানে মীমের পুর্তলিকা ফুল গাছকে কেন্দ্র করে একাধিক গ্রুপ রয়েছে। 'পুর্তলিকা সমাহার' ও 'পুর্তলিকা মেলা' গ্রুপে রয়েছে যথাক্রমে ১ লাখ ৪৫ হাজার ও ৫৭ হাজারের কিছু বেশি সদস্য।
সবুজালয়ের সবুজ গল্প
'যে যেটা ভালো পারে, তার সেখানেই যাওয়া উচিত'- বন্ধুর এই একটি কথা সোনিয়া নাজনীনকে জীবন সম্পর্কে ভাবনাই বদলে দেয়। নিজের পায়ের দাঁড়াতে হবে, নিজে কিছু করতে হবে এমন উদ্যম থেকে তিনি এগিয়েছেন সামনের দিকে। গাছের শখ অনেকদিনের হওয়ায় নিজের বারান্দাতেই নানা রকমের গাছ লাগাতেন তিনি। এক সময় মনে হলো গাছকেই তিনি আয়ের উৎস বানাতে পারেন। তাই নিজের ভাণ্ডার থেকেই প্রথম প্রথম বিক্রির কাজ শুরু করেন তিনি। তাই চাকরির সুযোগ পেয়েও গাছের প্রতি ভালোবাসা থেকে চাকরি করেননি তিনি। ইচ্ছে ছিল পুরোদমে ব্যবসায় করবেন।
চট্টগ্রামের মেয়ে সোনিয়া নাজনীনের 'সবুজালয়' এর যাত্রা শুরু হয় ২০২০ সালে। প্রথম দিকে অল্প অল্প করে শুরু করলেও একসময় বাইরে থেকে গাছ ও অন্যান্য সামগ্রী কেনার উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করেন প্রায় ৩০-৪০ হাজার টাকা। নিজে উৎপাদন করা ছাড়াও যারা দেশের বাইরে থেকে চারা আমদানি করেন তাদের থেকেই মূলত চারা কেনেন সোনিয়া। স্থানীয় নার্সারির পাশাপাশি কোথাও ঘুরতে গেলে সেখান থেকেও চারা সংগ্রহ করেন তিনি।

প্রতি মাসে আয় কেমন হয় প্রশ্নের উত্তরে সোনিয়া বলেন, 'আমি যখন অনেক ভালো সময় দিতে পারি, ভালো প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারি তখন দেখা যায় তিন লাখ টাকাও বিক্রি হয়। আবার অনেক সময় এক লাখ টাকারও বিক্রি হয় আবার পঞ্চাশ হাজার টাকারও বিক্রি হয়। আবার যদি সময় কম দেই তখন দেখা যায় বিশ-ত্রিশ হাজার টাকারও সেল হয়'। সোনিয়ার মতে, মাসের শুরুতে বিক্রি ভালোই হয় মাসের শেষ সময়ের তুলনায়। গাছ প্যাকেজিং করা থেকে ডেলিভারি করা সব কাজ একা হাতেই করতে হয় সোনিয়াকে। করোনা মহামারীর সময় ঝুঁকি নিয়ে কুরিয়ারে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতে হয়েছে তাকে।
মূলত ইনডোর প্ল্যান্ট নিয়েই বেশি কাজ করেন সোনিয়া। এছাড়াও তার ভাণ্ডারে আছে দেশের বাইরে থেকে আসা সাকুল্যান্ট, ক্যাকটাস, অর্কিড ইত্যাদি। সোনিয়ার গাছের ব্যবসায়ের পেছনে আসার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে 'রিকল গ্রিন' এর প্রতিষ্ঠাতা রাশেদুল ইসলাম। রিকল গ্রিনকে দেখে সোনিয়ার স্বপ্ন তিনিও একসময় প্রতিষ্ঠানের আওতায় তার ব্যবসায়কে নিয়ে আসবেন।

গাছের পাশাপাশি টব, সার এবং আনুষঙ্গিক যা যা আছে সবকিছুই বিক্রি করেন সোনিয়া তার ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ সবুজালয়ের মাধ্যমে। সোনিয়ার কাজ দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার বন্ধুরাও গাছ বিক্রির কাজ শুরু করেছে। এখন যেহেতু পুরো কাজ সোনিয়ার বাড়ি থেকেই করতে হয়, তাই একদিন তার গাছের জন্য আলাদা শপ তৈরি থাকবে এমন স্বপ্নই দেখেন সোনিয়া।
নেশাকে পেশা করেছেন 'মা নার্সারি বিডি'র কামরুল হাসান
২০১৮ সালের মে মাসের দিকে নিজের জন্য শখের বশে গাছ কিনে তা নিয়ে ব্যবসায় শুরু করেন 'মা নার্সারি বিডি' এর প্রতিষ্ঠাতা কামরুল হাসান। প্রাথমিকভাবে ১৬০ টাকা বিনিয়োগ করে কামরুলের ব্যবসায়ের এখন মাসিক টার্নওভার দেড় লাখ টাকা।
তিন বছর আগে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে পরিপূর্ণভাবে ব্যবসায়ে মনোযোগ দিয়েছেন কামরুল হাসান। যশোর, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, আশুলিয়া সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে গাছের চারা সংগ্রহ করেন তিনি। বাসার ছাদ, ব্যালকনিতে এসব গাছ সাজিয়ে রেখে তিনি বিক্রির কাজ করেন।
বর্তমানে কামরুলের বাগানে দামী গাছের মধ্যে রয়েছে এগ্লোনিমা, ব্ল্যাক ভেলভেট, সিলভার ড্রাগন, আলকুশি ইত্যাদি। এছাড়াও আছে মানিপ্ল্যান্ট, বিভিন্ন রকম বনসাই, এরোমেটিক জুঁই, অপরাজিতা, নয়নতারা প্রভৃতি গাছ। তবে মূলত ইনডোর প্ল্যান্ট নিয়ে ব্যবসায়ের কাজ করেন তিনি। গাছের পাশাপাশি টব, ডিজাইনার স্ট্যান্ড নিয়েও তিনি কাজ করে থাকেন।

শুরু থেকেই অনলাইনকে ভিত্তি করেই 'মা নার্সারি বিডি'র কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তবে কেউ চাইলে সরাসরি এসেও গাছ কিনতে পারে এমন সুযোগও রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠাতা কামরুল হাসান। বর্তমানে তিনিই মূল ব্যবসায় দেখাশোনা করেন তবে অনেকসময় তার স্ত্রীও সাহায্য করেন। বর্তমানে ফেসবুকের মাধ্যমে কাজ করলেও অদূর ভবিষ্যতে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ব্যবসায় পরিচালনার ইচ্ছা কামরুলের।
শখ থেকে ব্যবসায় শুরু করলেও কীভাবে গাছের ব্যবসায় করতে হয় তা নিয়ে শুরুতে পরিপূর্ণ ধারণা ছিলো না। ২৩ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন গুরু থেকেই তিনি সব কাজ হাতেকলমে শিখেছেন। এমনকি এখনো গুরুর থেকেই কাজ শেখেন এবং যখনই সুযোগ পান তার সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। কামরুল মনে করেন শেখার কোনো শেষ নেই, কোনো বয়সও নেই। তাই তিনি এখনো শেখার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
উৎসব উপলক্ষ্যে 'মা নার্সারি বিডি' অবশ্য কোনো অফার বা প্যাকেজের আয়োজন করে না। তবে কামরুলের ইচ্ছা ভবিষ্যতে উৎসবকে কেন্দ্র করে আলাদা প্যাকেজ বা সেল আয়োজন করার। তিনি বলেছেন, 'ভ্রাম্যমাণ নার্সারি করার চিন্তাভাবনা আমরা করছি। পহেলা বৈশাখে, ভালোবাসা দিবসে, ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বর বড় বড় উৎসবগুলোতে ভ্রাম্যমাণ গাছের দোকান পিকাপ ভ্যানে করে বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারে। সুন্দর প্লেস দেখে আমরা এরকম একটা কিছু করার পরিকল্পনা করছি'।

কামরুলের ব্যবসায় দেখে আশেপাশের লোকজন উদ্বুদ্ধ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি জানান, 'আমি চারজনকে নিয়েছিলাম ডেলিভারি ম্যান হিসেবে। এর মধ্যে তিনজন ইতোমধ্যে একই ব্যবসায় করছে। ডেলিভারিম্যান হিসেবে থাকাকালীন আমি তাদেরকে অল্প কাজ শিখিয়েছিলাম। আমার টার্গেট ছিলো তাদেরকে ভালোভাবে কাজ শেখাবো, কিন্তু তারা পুরোপুরি কাজ শেখার আগেই চলে গিয়ে নিজেদের ব্যবসা শুরু করেছে'।
প্রত্যেকটা বাড়িতে যাতে গাছ থাকে এমনটাই ইচ্ছা কামরুলের। বড় বড় বিল্ডিং করতে করতে গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তাই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য সবার মাঝে গাছ ছড়িয়ে দিতে চান তিনি।
তবে এই ব্যবসায় নিয়ে জনসাধারণের প্রতি কিছু্টা ক্ষোভও রয়েছে কামরুলের। তার ভাষ্যমতে, এই নার্সারির ব্যবসায়কে অনেকেই ভালো দৃষ্টিতে দেখে না। গাছের ব্যবসায় করে যে ব্যক্তি আয়ের উৎস খুঁজে পায় তা অন্যান্য মানুষ কমই বুঝতে চায়। তাই কিঞ্চিত অবহেলা, উপেক্ষার দৃষ্টিও থাকে নার্সারি ব্যবসায়ীদের প্রতি। কোনো কাজকে যেন ছোট করে না দেখা হয় এমন কামনাই করেন ব্যবসায়ী কামরুল।
গাছকে ভালোবেসে কামরুল এই ব্যবসায়েই থাকতে চান। ব্যবসায়কে বড় করারও অনেক চিন্তাভাবনা আছে। ইচ্ছে আছে এবছর থেকে দেশের বাইরে গাছ ও অন্যান্য সামগ্রী পাঠানোর। এভাবেই এগিয়ে যেতে চান তিনি।
গাছের পাশাপাশি সৌন্দর্যবর্ধক সামগ্রী নিয়ে সজীবের 'নিউ গার্ডেন আপ'
'সবার বারান্দায় গাছ থাকবে'- এমন স্বপ্ন নিয়ে করোনা মহামারীতে শখের বশেই কাজ শুরু করেছেন ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল সজীব। শুধু গাছই নয়, গাছের পাশাপাশি তিনি কাজ করেন সিরামিকের টব, পট, গাছ রাখার ডিজাইনার স্ট্যান্ড, সৌন্দর্যবর্ধক বিভিন্ন রকমের পাথর নিয়ে। রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব সামগ্রী বিক্রির পেজ, যার নাম 'নিউ গার্ডেন আপ'।
যাত্রা শুরুর কথা জানতে চাইলে সজীব বলেন, করোনার সময় যখন অফিস ছুটি ছিলো তখন অবসরে বিভিন্ন নার্সারীতে গিয়ে গাছ দেখতেন। সেখান থেকে অল্প বিস্তর গাছ কিনে নিজের ঘর সাজাতেন। গাছের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি 'ইনডোর প্ল্যান্ট বাংলাদেশ' নামে একটি গ্রুপ খোলেন। তখনো তিনি গাছের ব্যবসায় করবেন এমনটা ভাবেননি। নিজের ভালো লাগা থেকেই গ্রুপে নানা রকমের গাছের ছবি দিতেন। একপর্যায়ে গ্রুপের সদস্যরা সেসব গাছের দাম জিজ্ঞাসা করতে শুরু করেন। এরপর সজীব চিন্তাভাবনা করে ব্যবসায় শুরু করেন এবং গাছ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া শুরু করেন।

প্রথমদিকে ইনডোর প্ল্যান্ট নিয়ে কাজ শুরু করলেও ধীরে ধীরে সিরামিকের টব, ট্রে এর কালেকশন বাড়ানো শুরু করেন তিনি। সিরামিকের টব সহ অন্যান্য সামগ্রী বিক্রি করার কাজ শুরু করার পর দেখলেন যে এসব সামগ্রীর ভীষণ চাহিদা; গাছের চেয়েও প্রায় দশগুণ বেশি বিক্রি হচ্ছে সিরামিকের টব ও অন্যান্য সামগ্রী।
শুরুতে দেড়-দুই হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসায় শুরু করলেও বর্তমানে তার মূলধন চার লক্ষ টাকার কাছাকাছি। 'নিউ গার্ডেন আপ' একটি অনলাইন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান যেখান থেকে বর্তমানে সজীবের মাসিক মুনাফা ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা। এ প্রেক্ষাপটে সজীব বলেন, 'চাকরির পাশাপাশি করি তো, ফুলটাইম কাজ করলে ডাবলের বেশি আয় থাকবে আরকি'।
যশোরের ছেলে সজীব যারা থাইল্যান্ড, জার্মান থেকে গাছ আমদানি করে তাদের থেকেই গাছ সংগ্রহ করে থাকেন। বর্তমানে সজীবের কাছে সিরামিকের পট, ট্রে, ডিজাইনার স্ট্যান্ড থাকলেও নানা রকমের ইনডোর প্ল্যান্টও পাওয়া যাবে। তার ভাণ্ডারে আছে ১৫ থেকে ২০ জাতের মানিপ্ল্যান্ট, ৮ থেকে ১০ জাতের সেন্সিবেরিয়া, বনসাই, জি জি প্ল্যান্ট, এগ্লোনিমা, ক্যাকটাস, সাকুলেন্ট, লাকি ব্যাম্বো ইত্যাদি গাছ।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির এ সময়ে সবার মাঝে গাছ ছড়িয়ে দিতে চান সজীব। সিরামিকের টবের চাহিদা এখন শুধু শহরেই নয় গ্রামেও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান তিনি। এছাড়াও সজীবের ভাণ্ডার থেকে যারা নিয়মিত গাছ কেনেন তাদেরকে অনেকসময় গাছ উপহার দিয়ে উদ্দীপনা বাড়াতেও কাজ করেন তিনি।
সিরামিকের টবের শপ বাংলাদেশে তেমন একটা না থাকায় সজীবের স্বপ্ন তিনি এসব সামগ্রীর দোকান খুলবেন এবং অদূর ভবিষ্যতে এই ব্যবসাকে আরো বড় করবেন।
উদ্যোক্তাগণ নিজেরাই সফলতার সাথে কাজ করে জায়গা তৈরি করে নিচ্ছেন। অদূর ভবিষ্যতে তাদের দেখে অন্যরা অনুপ্রাণিত হয়ে গাছের ব্যবসায়ে এগিয়ে আসবেন এমনটাই কামনা সবার।