আরোগ্যের উপায় যখন সম্মোহন!

সম্মোহন। শব্দটি শোনামাত্রই কি মনে একটু ভয়ের অনুভূতি তৈরি হয় না? গল্প-উপন্যাসে সম্মোহন নিয়ে কত কাহিনী হয়ে গেছে, সম্মোহনের জোরে গোয়েন্দার কাছে গড়গড় করে সব স্বীকার করে নিচ্ছে অপরাধী, কখনো অবাস্তব সব কাজও করে ফেলছে কোনো চরিত্র স্রেফ সম্মোহিত অবস্থায় থাকার কারণে।
আবার কখনো কখনো ভিলেইনের সম্মোহনকে আরও বেশি মানসিক শক্তির জোরে ব্যর্থ করে দিচ্ছে নায়ক, কোনো কোনো সাহিত্যে দেখা যাচ্ছে সম্মোহন আগাগোড়া ভুয়া একটি বিদ্যা, কারও সম্মোহন বিদ্যার হাটে হাঁড়ি ফাটাচ্ছেন প্রোটাগনিস্ট।
এভাবে মানসিক এই বিশেষ অবস্থাকে সাহিত্য বা সিনেমার জগতে দেখানো হলেও বাস্তবে সম্মোহন বা হিপনোসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষকে চারপাশের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নতুন একটি কৃত্রিম বাস্তবতার অনুভূতি প্রদান করা সম্ভব।
সম্মোহন একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রপঞ্চ। প্রাথমিকভাবে এটিকে স্রেফ একটি মনস্তাত্ত্বিক দশা বলে মনে হলেও আজকাল রোগীর চিকিৎসার জন্যও সম্মোহন পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব প্রায়ই সম্মোহিত হয়ে যেতেন। মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের লেখা শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত থেকে জানা যায়, ভক্তদের সাথে কথা বলার মাঝখানেও সহসা সম্মোহিত হয়ে পড়তেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তার এই অবস্থাকে সমাধি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
কেউ যদি সম্মোহিত হয়ে সমাধি দশায় পৌঁছান, তখন তাকে নতুন একটি পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করলে, সেই পরিস্থিতিই সম্মোহিত ব্যক্তির জন্য বাস্তব হয়ে দাঁড়ায়। আর চিকিৎসাবিজ্ঞানে সম্মোহনকে এভাবে ব্যবহার করেই রোগীর আরোগ্যলাভের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
ধরা যাক, কোনো নারী প্রসব বেদনায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। তখন যদি তাকে সম্মোহিত করে বলা হয়, তিনি কোনো ব্যথা অনুভব করছেন না, তখন তিনি সে কথাটিই মেনে নেবেন। প্রকৃত ব্যথা একইভাবে বিদ্যমান থাকলেও তিনি আর সে ব্যথা উপলব্ধি নাও করতে পারেন।
সম্মোহন যে কার্যকর তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে বিজ্ঞানীদের কাছে। ব্যথা, উদ্বিগ্নতা, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি), প্রসব বেদনা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ও অন্যান্য অনেক সমস্যার ক্ষেত্রে ব্যক্তির ওপর সম্মোহনবিদ্যার প্রয়োগ ঘটিয়ে তাকে আরাম দেওয়া যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্মোহন-চিকিৎসা আর্থিক, ফলপ্রসূতা, সাইড-ইফেক্ট ইত্যাদি দিক থেকে মূলধারার চিকিৎসার চেয়েও বেশি ফলপ্রদ বলে প্রতীয়মান হয়।
তবে কয়েকদশক ধরে মনস্তাত্ত্বিক এ চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে গবেষণা ও এর কার্যপ্রণালী নিয়ে মানুষের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে বোঝাপড়া তৈরি হলেও, ক্লিনিক্যাল হিপনোসিস এখনো বেশিদূর এগোতে পারেনি।
সূচনার কথা
কয়েকশতক ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে সম্মোহনবিদ্যার চর্চা দেখা যায়। আফ্রিকা থেকে সাইবেরিয়া; কোরিয়া, জাপান থেকে উত্তর আমেরিকার আদিবাসী; এসব অঞ্চলের সংস্কৃতিতে সম্মোহন চর্চার নিদর্শন পাওয়া যায়।
পশ্চিমের দুনিয়ায় ১৮ শতকে প্রথম হিপনোসিসের খবর পাওয়া যায়। ১৭৭৫ সালে ফ্রাঞ্জ মেসমার নামের জার্মান এক চিকিৎসক আবিষ্কার করেন, রোগীর ওপর মনোযোগ দিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখে তিনি রোগীকে মাঝেমধ্যে সমাধির পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারতেন। তার এ আবিষ্কারেে কারণে তিনি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
১৯ শতকে মেসমারের আবিষ্কৃত এ বশীকরণ বিদ্যা হিপনোসিস নামে পরিচিতি লাভ করে। ওই সময় সম্মোহনকে আরেকটি কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে মানুষ। অনেক দক্ষ হিপনোটিস্ট ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে সম্মোহনের খেলা দেখাতে শুরু করেন। ১৮৮০-এর দশকে সম্মোহন নিয়ে মানুষের মধ্যে জল্পনাকল্পনা বেড়ে যায়। ও সময় এটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে অনেক দেশ আইন তৈরি করতেও শুরু করে।
ওই সময়টুকুতেই হিপনোসিসের কারণে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন, অনেকে প্রতারণার শিকার হন। অনেক অকাল্টিস্ট, ওঝা নিজেদের স্বার্থে সম্মোহনকে ব্যবহার করতে শুরু করে। এর ফলে ডাক্তারদের চিকিৎসাক্ষেত্রে সম্মোহন ব্যবহারের যাবতীয় প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়।
তখন অনেক চিকিৎসক দাবি করেন, কেবল চিকিৎসক ছাড়া অন্য মানুষদের সম্মোহনচর্চা করা উচিত নয়। প্রায় এক শতকের বেশি সময় পরে আজকের দিনেও একই চিন্তাধারাই বজায় আছে। সম্মোহন বিশেষজ্ঞ, অ্যাকাডেমিক গবেষক, ও চিকিৎসাক্ষেত্রে সম্মোহনচর্চাকারী সবাই এখনো মনে করেন সাধারণ মানুষের সম্মোহন চর্চা করাটা বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ।
সম্মোহন যে সবার ক্ষেত্রে কাজ করে তাও নয়। কেউ কেউ সম্মোহনের ফলে গভীর অনুভূতি, ভ্রম ইত্যাদি অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। আবার এমনও আছে যে অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও কাউকে সম্মোহিত করা যাচ্ছে না।
কেবল ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষ উচ্চমাত্রায় সম্মোহিত হতে পারেন। সম্মোহনের দুনিয়ায় এরা 'হাই' (high) নামে পরিচিত। মধ্যবর্তী স্তরে যারা আছেন, তারা কিছুটা সম্মোহিত হন, আবার অনেকক্ষেত্রে তাদেরকে পুরোপুরিভাবে সম্মোহিত করা যায় না। বাকি ১০-১৫ শতাংশ মানুষ 'লো' (low) হিসেবে পরিচিত। এরা সহজ কিছু সম্মোহন শব্দে বশীভূত হন, আবার এমনও হতে পারে তাদেরকে হিপনোটাইজ করা একেবারে অসম্ভব।
তবে ব্যক্তি সম্মোহন মাত্রার যে স্তরেই থাকুন না কেন, সারাজীবন তিনি ওই একই স্তরেই থাকবেন। অর্থাৎ জীবনের বিভিন্ন সময়ে এসে তার সম্মোহিত হওয়ার ক্ষমতা কম-বেশি কখনো হবে না।
সম্মোহিত মস্তিষ্ক
স্ট্রুপ ইফেক্ট খেলায় কোনো ব্যক্তিতে একটি রঙের নাম অন্য রঙে লিখে সেই রঙের কথা বলার পরীক্ষা নেওয়া হয়। এ খেলায় শব্দে কী লেখা আছে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং ওই শব্দটি কোন রঙে লেখা আছে সেটা বলতে হয়। সাধারণত মানুষ প্রায়ই ভুল করে আসল রঙটির কথা বলতে গিয়ে।
একজন সম্মোহিত ব্যক্তিকে যখন বলা হয় যে তিনি আর পড়তে পারবেন না, তখন তার কাছে যেকোনো বর্ণ অর্থহীন কিছু আকৃতিতে রূপান্তরিত হয়। তাই স্ট্রুপ ইফেক্ট খেলায় কোনো রংয়ের নাম ভিন্ন রঙ দিয়ে লিখলেও তিনি সহজে খেলায় অভীষ্ট উত্তর দিতে পারেন। কারণ তার কাছে অক্ষরগুলোর কোনো অর্থ বহন করে না।
কোনো ব্যক্তি সম্মোহিত হলে তার মস্তিষ্কের ভেতর যে ধরনের জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া চলে, তিনি যদি সম্মোহিত না হয়েও হওয়ার ভান করেন তাহলে তার মস্তিষ্কে ভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়া দেখা যায়। এটি বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
গবেষণাগার থেকে ক্লিনিক
অ্যাকাডেমিক বিভিন্ন গবেষণায় জানার চেষ্টা করা হচ্ছে সম্মোহন কেন হয়, এটি কীভাবে কাজ করে। অন্যদিকে চিকিৎসাক্ষেত্রে সম্মোহনবিদ্যার প্রভাব যাচাই করা হচ্ছে রোগীদের সুস্থ করে দেওয়ার জন্য।
হিপনোসিসের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল মেডিকেল ব্যবহার হলো এটি ব্যবহার করে ঔষধ ছাড়াই রোগীর বেদনা কমানো। এ সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণার তথ্য ব্যবহার করে করা গবেষণায় (মেটা-অ্যানালাইসিস) স্থিতিশীল ফলাফল দেখা গিয়েছে।
বিশ্বের অনেক মানুষ বিভিন্ন ধরনের ক্রনিক পেইনে ভুগে থাকেন। যে ব্যথা তিন মাসের বেশি সময় অবস্থান করে, সেটিই ক্রনিক পেইন। সচরাচর ঔষধ খেয়ে এ ধরনের ব্যথা সহজে দূর করা যায় না। এছাড়া ঔষধের ফলে তৈরি হয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। তবে দেখা গেছে, সম্মোহনের মাধ্যমে এ ধরনের ক্রনিক পেইনের তীব্রতা ও দৈনন্দিন জীবনে এগুলো ঘটার আশঙ্কা কমানো সম্ভব।
তারপরও কেন চিকিৎসাক্ষেত্রে সম্মোহনের ব্যবহার বাড়ছে না? এর একটি কারণ হচ্ছে, মানুষের মধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে নানা ভুল ধারণা রয়েছে।
কেউ কেউ মনে করেন, সম্মোহনের আশ্রয় নিলে যিনি সম্মোহন করাচ্ছেন তিনি চাইলে ব্যক্তিকে দিয়ে নিজের ইচ্ছামতো যেকোনো কিছু করিয়ে নিতে পারবেন। তবে এ দাবির পক্ষে বিশেষ কোনো প্রমাণ নেই।
তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা ও চিকিৎসাক্ষেত্রের বাইরে কেউ চাইলে সম্মোহনকে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে পারবে। অনেক ঘটনা আছে যেসব ক্ষেত্রে মানুষ ক্ষতিকর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সম্মোহনের চর্চা করেছে।
সম্মোহনের ব্যবহার ও অপব্যবহার
সম্মোহনবিদ্যা ব্যবহার করে চুরি বা ডাকাতির ঘটনা অনেক রয়েছে। দোকানে ঢুকে দোকানদারকে মুহূর্তের মধ্যে অল্পসময়ের জন্য মোহাবিষ্ট করে দোকানের সর্বস্ব ফাঁকা করে দেওয়ার ঘটনার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়।
অনেক সময় পেশাদার হিপনোটিস্টরাও ক্লায়েন্টদের সাথে সম্মোহন ব্যবহার করে জালিয়াতি করেন। অনেকে নারী ক্লায়েন্টকে সম্মোহিত করে তাদের শ্লীলতাহানি করেন।
তাহলে কেউ যদি সম্মোহনের মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ করতে চান তাহলে তাকে কী করতে হবে? এক্ষেত্রে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে- কেউ যদি আপনাাকে সম্মোহন ছাড়া সুস্থ করে তুলতে না পারে, তাহলে তাদের উচিত নয় সম্মোহনশক্তি ব্যবহার করে আপনার চিকিৎসা করা।
তাই প্রয়োজনে কেবল পুরোদস্তুর পেশাদার হিপনোটিস্টদেরই শরণাপন্ন হতে হবে। এরা হতে পারেন চিকিৎসক, মনস্তাত্ত্বিক, নার্স, পেশাদার থেরাপিস্ট পা ফিজিওথেরাপিস্ট। এরকম কোনো ব্যক্তি থেকে সম্মোহন গ্রহণ করতে হবে যিনি অন্য আরেকটি পেশাদার সংস্থার কাছে জবাবদিহির অধীনে থাকবেন।
তবে আরেকটি ব্যাপারও মাথায় রাখতে হবে। 'ডক্টর' বা 'সাইকিয়াট্রিস্ট'-এর মতো 'হিপনোটিস্ট' বা 'হিপনোথেরাপিস্ট' কোনো প্রতিষ্ঠিত উপাধি নয়। তাই এমন কোনো ব্যক্তির কাছ থেকেই সম্মোহনের জন্য যেতে হবে যার স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান ও যোগ্যতা রয়েছে।
বিবিসি ফিউচার থেকে সংক্ষেপে অনূদিত।