'দ্য বুকসেলার অব কাবুল' বিখ্যাত বইয়ের সেই বিক্রেতা এখন লন্ডনে আশ্রয়প্রার্থী

নরওয়েজিয়ান সাংবাদিক ও লেখক অসনে সিয়েরস্তার লেখা আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার বই 'দ্য বুকসেলার অব কাবুল' এর প্রধান চরিত্র হয়ে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেছিলেন আফগানিস্তানের শাহ মুহম্মদ রইস। আফগানিস্তানের দীর্ঘমেয়াদি দমন-নিপীড়ণমূলক শাসনব্যবস্থায় থেকেও নিজ দেশেই টিকে ছিলেন তিনি। কিন্তু আজ দুই দশক পর রইসের ঠাঁই হয়েছে লন্ডনের মাটিতে, হোম অফিস হোস্টেলে। আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের হাত থেকে পালিয়ে এখন যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজছেন তিনি।
গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যে পা রাখেন ৬৯ বছর বয়সী শাহ মুহম্মদ রইস এবং বিমানবন্দরে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। বর্তমানে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল থেকে আসা অন্যান্য আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে বাস করছেন এবং তার আবেদন কার্যকরী হওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
"তালেবানের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে যুক্তরাজ্যই ছিল আমার কাছে একমাত্র জায়গা", সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন রইস।
তালেবানরা আফগানিস্তান দখল করার পর শাহ মুহম্মদ রইসের পরিবারের সদস্যরা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছেন। তার ৯ সন্তান ও ৪ নাতি-নাতনি একেকজন একেক জায়গায় বাস করছেন। তবে কাবুলে রইসের বইয়ের দোকানটি এখনো চালু রয়েছে, যেটির সাথে এবার যুক্ত হয়েছে অনলাইন বইয়ের দোকান। গর্বভরে নিজের বিজনেস কার্ড এগিয়ে দেন রইস; সেখানে লেখা- 'শাহ এম বুক কোম্পানি, মুদ্রণকারী, প্রকাশক ও বই বিক্রেতা, শাহ মুহম্মদ রইস (ব্যবস্থাপনা পরিচালক)।'

স্বাধীনভাবে বইয়ের ব্যবসা পরিচালনা করা বেশ কঠিন। তাই ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ও পাঁচ দশকের বিক্ষুব্ধ সময়ের সাক্ষী এই বইয়ের দোকানটি এখন তালেবান শাসনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে রইসের।
"এখন খুব কম মানুষই বই কেনে", দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন শাহ মুহম্মদ রইস। তালেবান শাসনের অনেকগুলো কুফলের মধ্যে একটি হলো দেশের অসংখ্য বুদ্ধিজীবির নির্বাসন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রভাবে যতদিন ছিল আফগানিস্তান, তখন মূলত এই বুদ্ধিজীবি শ্রেণীই ছিল তার বইয়ের ক্রেতা।
তবুও হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন রইস। তিনি বলেন, "যতদিন সম্ভব আমি আমার বইয়ের দোকান চালু রাখবো। হয়তো তালেবানরা একদিন দোকানটা ভেঙ্গে দিবে বা নিষিদ্ধ করবে।"
নিজ মাতৃভূমির অনেক উত্থান-পতন দেখেছেন শাহ মুহম্মদ রইস। আফগানিস্তানে সোভিয়েত শাসনের সময় দুই বার কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে। প্রথমবার কারাবন্দী হন ১৯৭৯ সালে এবং ছাড়া পাওয়ার দেড় বছর পর আবার। কারাগারে থাকার সময় নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলে জানান রইস। ঘুমাতে না দেওয়া, এমনকি প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে ফেলে রাখার মতো নির্যাতনও চালানো হয় তার উপর।
৯/১১ এর সময় আফগানিস্তানে ভ্রমণ করেছিলেন নরওয়েজিয়ান সাংবাদিক অসনে সিয়েরস্তা। ফিরে এসে আফগানিস্তানের বই বিক্রেতা রইস, তার দুই স্ত্রী ও পরিবারের নিবিড় চিত্র তুলে ধরেন তার বইয়ে। রইসের পরিবারের সাথে দীর্ঘ পাঁচ মাস ঘনিষ্টভাবে কাটিয়েছিলেন সিয়েরস্তা। এই সময়ে আফগানিস্তান ও রইস পরিবারের জীবন নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে বইটিতে।

২০০২ সালে 'দ্য বুকসেলার অব কাবুল' প্রকাশিত হওয়ার পর বিখ্যাত বনে যান রইস। আন্তর্জাতিক বাজারে বেস্টসেলার হিসেবে জায়গা করে নেয় বইটি এবং অনূদিত হয় ১২টি ভাষায়। যদিও বইটিতে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে দাবি করে লেখকের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেন রইস। কিছুদিন আইনি লড়াই চলার পর নরওয়ের আদালত এই অভিযোগ খারিজ করে দেন এবং জানান, লেখক অসনে সিয়েরস্তা নির্দোষ, তিনি রইস পরিবারের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করেননি এবং বইটিতে কোনো ভুল তথ্য নেই।
বলে রাখা ভালো, শাহ মুহম্মদ রইসের বইয়ের দোকানটি ব্যাপক খ্যাতিলাভ করার আরও একটি কারণ হলো, তার দোকানে রয়েছে আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় বইয়ের সংগ্রহ। এই দোকানে এক ছাদের তলায় মিলবে সব ধরনের বই। তবে যেকোনো দিন হামলা হতে পারে এই আশঙ্কায় মেডিসিন, ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইসহ বিরল বইগুলো যত্ন করে গোপন স্থানে লুকিয়ে রেখেছেন রইস।
ছয়টি ভাষায় কথা বলতে পারদর্শী রইস দুঃখ প্রকাশ করে জানান, তিনি রুশ ভাষাও জানতেন, কিন্তু এখন তা ভুলে গেছেন। তিনি বলেন, "ইরান আর পাকিস্তানের কিছু বই গোপন জায়গায় যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছি আমি।"
কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্স ডিগ্রি নেওয়ার পর রইস সিদ্ধান্ত নিলেন, ইঞ্জিনিয়ারিং দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই তিনি বইয়ের প্রতি নিজের প্যাশনকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন।

আফগান বইয়ের বিচিত্র ও বিপুল ভাণ্ডারের পাশাপাশি তলস্তয়, বালজাক, হেমিংওয়ে এবং ১৩ শতকের বিখ্যাত ফার্সি কবি রুমির লেখা ভালোবাসেন রইস। "শেকসপিয়ারের ওথেলো ফার্সিতে পড়তে ভালো লাগে আমার", বলেন রইস।
"২০০২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আমি ইউরোপিয়ান ও মার্কিন সাহিত্যের ১৫ হাজারেরও বেশি কপি বই বিক্রি করেছি", যোগ করলেন রইস।
তিনি বলেন, "মোল্লা ওমর ও অন্যান্য জিহাদী সংবাদপত্রের ডিক্রি সংগ্রহ করায় সোভিয়েতরা আমাকে কারাগারে পাঠিতেছিল। আমি বিচারককে বলেছিলাম, আফগান জিহাদ নিয়ে গবেষণা করতে চাইলে- নিজেদের শত্রুকে বুঝতে চাইলে কাল এই সংবাদপত্রগুলোই আমাদের প্রয়োজন হবে।"
সুসময়ে রইসের বইয়ের দোকান ছিল রমরমা। বুদ্ধিজীবিদের আড্ডার মূল কেন্দ্র ছিল এই দোকান। মেঝেতে বিছানো ম্যাট্রেসে বসে, ভালো একটা রেডিও ছেড়ে দিয়ে সবাই আন্তর্জাতিক সংবাদ শুনতেন এবং দিনের বাকি সময়ে চলতো রাজনীতি-দর্শন নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক।
কিন্তু আফগানিস্তানে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাথে সাথে শাহ মুহম্মদ রইসের ভাগ্যও হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন মনে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের জবাব পেতে। কিন্তু একজন বইপ্রেমী হিসেবে রইসের জন্য দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এখন আর চোখে ভালো দেখতে পান না তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও, কাজ নিয়ে রইসের আগ্রহ-উত্তেজনা আগের মতোই আছে।
শাহ মুহম্মদ রইস বলেন, "আমাকে যদি যুক্তরাজ্যে কাজ করতে দেওয়া হয় তাহলে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে একটা আফগান রিডিং রুম খুলতে চাই আমি। আফগানিস্তানের ভূমি, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের উপর একটি বই লিখছি আমি। আমি চাই এখানে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইরানের মতো দেশের মানুষদের জন্য একটা মাল্টিকালচারাল, মাল্টি-ল্যাঙ্গুয়েজ বইয়ের দোকান থাকুক। আপাতত এটাই আমার স্বপ্ন।"
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান