ডিজিটাল স্মৃতিভ্রংশ: স্মার্টফোন কি আপনার স্মৃতিশক্তিকে ধ্বংস করছে?
আমাদের সঙ্গে যখন স্মার্টফোন থাকে, তখন আমরা বলতে গেলে পুরো বিশ্বটাকেই যেন হাতের মুঠোয় পেয়ে যাই। আজকালকার স্মার্টফোনগুলো অবিশ্বাস্যরকম শক্তিশালী। তাই 'ওকে গুগল' বলে দুই কোরিয়ার মধ্যবর্তী গ্রামটির নাম যখন মুহূর্তের মধ্যে জানা যায়, তাহলে আর কষ্ট করে কেনইবা কাউকে সিধু জ্যাঠা হতে হবে?
পকেটে এত স্মৃতি নিয়ে চলার কারণে তাহলে কি আমাদের মাথার ভেতরকার স্মৃতিক্ষমতা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে? আমরা কি আমাদের ফোনের ওপর এতই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি যে, পরেরদিন সকালবেলা উঠে কোন কাজটি আগে করব সেটা জানার জন্যও ফোনের টু-ডু লিস্টের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে?
আমাদের ফোন আর মস্তিষ্ক একত্রিত হয়ে একটি জটিল মিথস্ক্রিয় সৃষ্টি করে। সেই ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকেই আমাদের জীবনে 'স্মার্টফোনিফিকেশন' বা স্মার্টফোনের সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারিতে এ প্রক্রিয়া আরও দ্রুতি পেয়েছে।
দীর্ঘকালীন চাপ, আইসোলেশন, ক্লান্তিভাব মানুষের স্মৃতিক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে। ২০২১ সালে ক্যাথেরিন লাভডে নামক একজন গবেষক এ নিয়ে একটি গবেষণা করেন। তার গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ৮০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন তাদের স্মৃতিশক্তি মহামারির পর আরও খারাপ হয়েছে।
আমাদের স্মৃতির কিছু অংশ আমরা যদি বাহ্যিক কোনো ডিভাইসে স্থানান্তর করি, তাহলে কী ঘটবে? আমরা কী স্মার্টফোনের ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে গেছি যে ভবিষ্যতে এ ফোনই ঠিক করে দেবে আমাদের মস্তিষ্ক বা স্মৃতি কীভাবে কাজ করবে?
এ নিয়ে অবশ্য স্নায়ুবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইউনিভার্সিটি অভ সাসেক্সের কগনিটিভ নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক ক্রিস বার্ড বলেন, 'আমরা সবসময়ই বাহ্যিক ডিভাইসে স্মৃতির স্থানান্তর করেছি। এই যেমন, স্মার্টফোন আসার আগে আমরা নোট লিখে রাখতাম।'
তিনি বলেন, 'আমাদের মেমোরি প্রসেসের ক্ষেত্রে বাহ্যিক ডিভাইস ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমরা এখন আগের চেয়ে এ কাজটা বেশি করছি। এতে করে আমাদের পক্ষে অন্য কাজে মনোযোগ দেওয়া, ফোকাস করা বেশি সহজ হচ্ছে।' এ বিজ্ঞানী আরও মনে করেন, আমরা যেসব কাজের রিমাইন্ডারের জন্য ফোন ব্যবহার করি, সচরাচর সেগুলো মনে রাখা বেশিরভাগ মানব মস্তিষ্কের জন্য একটু কঠিন।
মনট্রিলের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অলিভার হার্ড এ ব্যাপারে আরেকটু বেশি সতর্ক। 'আপনি যদি মনে রাখার চেষ্টা বন্ধ করে দিন, তাহলে আপনার স্মৃতি আরও দুর্বল হবে। এতে করে আপনি আরও বেশি ডিভাইস ব্যবহার করবেন।' তিনি মনে করেন, আমরা স্মার্টফোনের কল্যাণে যেসে সুবিধা পাচ্ছি, তার খেসারত হিসেবে আমাদের স্মৃতিশক্তির ক্ষমতা কমিয়ে ফেলতে হচ্ছে।
হার্ড বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে জিপিএস ব্যবহার করলে মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটারের ঘনত্ব কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাধারণত একটি স্থানের মানচিত্র মনে রাখতে মস্তিষ্ককে যে পরিমাণ জটিল কাজ করতে হয়, স্মার্টফোনের কারণে তার সিকিভাগও করতে হয় না। মানচিত্র পড়া ও বোঝা একটি কঠিন কাজ, তাই আমরা সহজেই এগুলোকে স্মার্টফোনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা নির্ভার থাকি। কিন্তু কঠিন কাজ করতে পারাটা আমাদের জন্যই ভালো। কারণ এতে করে মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে, এর কগনিটিভ প্রক্রিয়া চালু থাকে। আর এ ধরনের সক্রিয়ভাব সামগ্রিকভাবে মস্তিষ্কের অন্য সব কগনিটিভ কার্যক্রমকেও প্রভাবিত করে।
হার্ডের কাছে আপাতত তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও তিনি বিশ্বাস করেন, মস্তিষ্কের কাজকে এভাবে কমিয়ে ফেলার খেসারত হতে পারে ডিমেনশিয়া তথা স্মৃতিভ্রংশের ব্যাপক বৃদ্ধি। মানুষ নিজের মননকে যত কম ব্যবহার করে, ততই এপিসোডিক মেমোরি, কগনিটিভ ফ্লেক্সিবিলিটির মতো জটিল কাজগুলো করার জন্য মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় সিস্টেমের ব্যবহার কম হয়।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে স্মৃতিভ্রংশের ঘটনা খুব কমই দেখা যায়। কারণ তারা বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তাদের মননকে ব্যবহার করেন।
স্মার্টফোন আমাদের সামনে যেমন জ্ঞানের নতুন একটি দুনিয়া খুলে দিতে পারে, ঠিক তেমনিভাবে এটির কারণেই আমরা বর্তমানের অনেক কিছুই আর উপভোগ করতে পারি না। সুন্দর একটি বিকেলে বাইরে হাঁটতে না গিয়ে স্মার্টফোনে পড়ে থাকা, বা বন্ধুদের সঙ্গে খাবার সময় খাওয়ায় মনোযোগ না দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় খাবারের ফিল্টার করা ছবি আপলোডে ব্যস্ত থাকা; এগুলো বর্তমান থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কয়েকটি উদাহরণ।
আমরা যখন কোনো ঘটনাকে এভাবে এড়িয়ে যাই, তখন ভবিষ্যতে ওই ঘটনার স্মৃতি সঠিকভাবে স্মরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আর এতে করে আমাদের নতুন আইডিয়া ও সৃজনশীল হওয়ার ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
ক্যাথেরিন প্রাইস নামক একজন বিজ্ঞান লেখকের ভাষ্যে, 'আমাদের মস্তিষ্ক একসঙ্গে একাধিক কাজ করতে পারে না। আমাদের মনে হতে পারে মাল্টিটাস্কিং সম্ভব। কিন্তু আপনি যখন লন্ড্রি করছেন, তখন হয়তো রেডিও শুনতে পারবেন। কারণ রেডিও শোনার ক্ষেত্রে আপনার কোনো জ্ঞান কাজে লাগাতে হচ্ছে না। কিন্তু আপনি যদি ফোনে মনোযোগ দেন, তখন আপনার মনোযোগ আর অন্য কোথাও থাকে না। আপনি কোনো কাজে মনোযোগ ব্যবহার না করলে, সে কাজের স্মৃতি আপনার মস্তিষ্কে জমা হবে না।'
এ নিয়ে ২০১০ সালে একটি গবেষণা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্যামব্রিজের স্নায়ুবিজ্ঞানী বারবারা সাহাকিয়ান, 'তিনটি দলকে বই পড়তে দেওয়া হয়। পড়া শুরু আগে একটি দল টেক্সট মেসেজ পায়। আরেক দল পায় পড়ার মাঝখানে। শেষ দলকে কোনো মেসেজ পাঠানো হয়নি। পড়া শেষ হলে তাদেরকে যখন কী পড়েছে তা নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলো, দেখা গেল যারা মেসেজ পেয়েছিল, তারা মনে করতে পারেনি তারা কী পড়ছিল।'
ক্যাথরিন প্রাইস বিশ্বাস করেন না স্মার্টফোন আমাদেরকে অন্য কাজে মনোযোগ বেশি দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। তিনি প্রশ্ন রাখেন, বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনের যদি টুইটার থাকত তাহলে কি তিনি তার অত সব আবিষ্কার করতে পারতেন কিনা।
প্রাইস মনে করেন, মাত্রাতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহার আমাদের অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ হওয়ার পথকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইনসাইট বা অন্তর্দৃষ্টি হচ্ছে দুটি বিসদৃশ বস্তুকে মনোগত দিক থেকে সংযুক্ত করতে পারার ক্ষমতা। কিন্তু কাউকে অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ হতে হলে তাকে সৃজনশীলও হতে হয় বলে জানান প্রাইস। বারবার মনোযোগ বিঘ্নিত হলে তার ফলে স্মৃতিতে তথ্য জমা করার কাজটি কঠিন হয়ে যায় বলে সহমত হয়েছেন মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক ও দ্য ডিসট্র্যাক্টেড মাইন্ড: অ্যানসিয়েন্ট ব্রেইনস গ্রন্থের লেখক ল্যারি রসেন।
অলিভার হার্ড মনে করেন, ফোন আমাদের জৈবিকভাবে শোষণ করে। তিনি বলেন, একটা সময় আমরা মস্তিষ্ককে ব্যবহার করতাম নিজেদের বাঁচার তাগিদে। আদিম মানুষেরা একটি ডাল ভাঙার শব্দ শুনলেও বিপদের আশঙ্কায় সতর্ক হয়ে যেত। আজ এত বছর পরেও আমাদের মস্তিষ্ক একই আছে। কিন্তু এখন ডাল ভাঙার আওয়াজের বদলে আমরা শুনতে পাই ফোনের নোটিফিকেশনের আওয়াজ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজার শিশুকে নিয়ে একটি গবেষণা বর্তমানে চলমান রয়েছে। এ গবেষণা থেকে জানা গেছে, যেসব শিশু প্রযুক্তি বেশি ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্কের কর্টেক্স অনেক পাতলা, যেটা তাদের বৃদ্ধ বয়সে হওয়ার কথা ছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্টিকাল পাতলা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি স্বাভাবিক, এমনকি শেষ বয়সে এসে পারকিন্স, আলঝেইমার, মাইগ্রেন ইত্যাদি রোগ হওয়ার পেছনে এর সম্পর্ক রয়েছে।
আজকাল স্মার্টফোন ছাড়া চলা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু যদি স্মার্টফোন ব্যবহার নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্নতা তৈরি হয়, তাহলে কী করা উচিত?
ল্যারি রসেন তার বইয়ে কিছু কৌশলের কথা বলেছেন। এর একটি হচ্ছে 'টেক ব্রেক'। প্রতি ১৫ মিনিট পরপর এক মিনিটের জন্য ফোন ব্যবহার করা। এ এক মিনিটই হচ্ছে টেক ব্রেক। এভাবে ১৫ মিনিটকে ক্রমে বাড়িয়ে তা যদি ৬০ মিনিট পর্যন্ত নেওয়া যায়, তাহলে তাকে সাফল্য হিসেবে দেখছেন এ লেখক।
তবে সব মিলিয়ে স্মার্টফোনের ব্যবহারটা নিজের কাছে। কেউ চাইলে প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে স্মার্টফোন ব্যবহার ধীরে ধীরে কমিয়ে জীবনকে আরেকটু উপভোগ করতে পারেন।
সূত্র: দ্য অবজার্ভার