‘লাশ হয়েই বেঁচে আছি’
মহামারিকালে চাকরি হারিয়েছেন বাংলাদেশের অসংখ্য তৈরি পোশাক শিল্প শ্রমিক। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ লেবার স্টাডিস এর তথ্যানুযায়ী গত এক বছরে চাকরি হারিয়েছেন ৩ লাখ ২৪ হাজার ৬৮৪ জন শ্রমিক। অন্য কোনরকম আর্থিক সংস্থান না হওয়ায় বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এসব শ্রমিকেরা।
এই প্রজেক্টে থাকছে এরকমই নয়জন তৈরি পোশাক শ্রমিকের গল্প যারা নিজেদের চাকরি হারিয়েছেন।
তাজরিনা আক্তারের বয়স ২০ বছর। ২০১৬ সাল থেকেই তিনি তৈরি পোশাক শ্রমিক হিসেবে কাজ করে আসছেন। শ্বাশুড়ি ও এক ছেলেসন্তানসহ চারজনের সংসার তার।
তাজরিনা কাজ করতেন অ্যাপ্লেন গার্মেন্টসে। তাজরিনার স্বামীও এজকজন গার্মেন্টকর্মী। কোভিড-১৯ এর সময় তিনি ও তার স্বামী দুজনেই চাকরি হারান। তাজরিনার স্বামী একটি নতুন চাকরি পেলেও তার উপার্জনে তাদের সংসার চলে না। তাজরিনা জানালেন তার শ্বাশুড়ির শরীরে নানারকম রোগ বাসা বেঁধেছে কিন্তু তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা তার চিকিৎসা করানো।
১৫ বছর ধরে তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে আসছেন ৩৪ বছয় বয়সী রেহানা খাতুন। যখন তিনি গার্মেন্টস এ কাজ শুরু করেন তখন ছিলেন সদ্য বিবাহিতা এক নারী। বর্তমানে দুই সন্তান নিয়ে রেহানা নিজের স্বামী সঙ্গে থাকেন। তার বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে এবং ছোট ছেলে পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে।
রেহানা কাজ করতেন আন্ধো গার্মেন্ট এ। দিনমজুর স্বামীর স্বল্প আয়ে চলতো না তাদের সংসার। রেহানাই নিজের সন্তানদের পড়ালেখার খরচ বহন করতেন। করোনাকালে চাকরি হারিয়েছেন রেহানাও।
নিজের বর্তমান অবস্থা জানিয়ে রেহানা বলেন, "গত নয় মাস ধরে আমি বাসা ভাড়া দিতে পারিনা। আমার স্বামী দিনে ৩০০ টাকা আয় করে, কিন্তু সে প্রতিদিন কাজ পায় না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আমার পার্স চেক করেন, দেখবেন একটা টাকাও নাই।"
দুই সন্তানের জননী চাঁদনী (২৫) সাত বছর ধরে তৈরি পোশাক শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত ছিল। বর্তমানে চাঁদনী একজন ডিভোর্সি।
চাঁদনী কাজ করতেন আল-মুসলিম গার্মেন্টস লিমিটেডে। চাঁদনীর মা-বাবা মারা গেছেন বছর দুয়েক আগে। নিজের তিন সদস্যের পরিবার চাঁদনীকে একাই চালাতে হয়।
"আমার বাচ্চারা খেলনার জন্যে কান্নাকাটি করে। তাদের দোষ দেইনা আমি, তারা দেখে যে অন্য সব বাচ্চারা নানা খেলনা দিয়ে খেলে। ওরা তো মাসুম বাচ্চা, ওরা কীভাবে আমার কষ্ট বুঝবে! আমার তিন বোন আছে কিন্তু কোন ভাই নাই যে আমি কারো কাছে যাবো", বললেন চাঁদনী।
স্বপ্না বেগমের বয়স ৩৮ বছর। জীবনের বড় একটা সময় ধরে তিনি তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন। ২০ বছর ধরে তিনি তৈরি পোশাককর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। তার দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসারে থাকে এবং ছোট মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে।
স্বপ্না নিউএজ গার্মেন্টস লিমিটেড নামের একটি গার্মেন্টে কাজ করতেন। স্বপ্নার স্বামী পেশায় একজন ফেরিওয়ালা। কোভিড-১৯ এর করাল থাবা কেড়ে নিয়েছে স্বপ্না বেগমের আর্থিক অবলম্বনের একমাত্র উৎস তার চাকরিটি।
স্বপ্না বেগম জানালেন, চাকরি হারানোর পর তিনি কাঁথা সেলাই করার কাজ নেন কারণ তিনি তার ছেলের সংসারে বোঝা হতে চাননি। কিন্তু কাঁথা সেলাই করে তিনি খুবই কম টাকা পান। তাই স্বপ্না বেগমকে এখন টিকে থাকার জন্যে সংগ্রাম করতে হয়।
সাত বছর আগে নাটোর থেকে নিজের স্বামীর সাথে টঙ্গিতে আসেন ডলি আক্তার (২৭)। গত ছয় বছর ধরে তিনি এখানেই গার্মেন্টকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। স্বামী , কন্যা ও শ্বাশুড়ি নিয়ে তিন সদস্য রয়েছে তার পরিবারে।
ডলি ও তার স্বামী দুজনেই ছিলেন তৈরি পোশাক কর্মী। করোনাকালে চাকরি হারিয়েছেন দুজনেই। বাধ্য হয়ে ডলি নিজের মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছেন নাটোরে তার শ্বাশুড়ির কাছে।
ডলি আক্তার জানালেন, "আমি আর আমার স্বামী দুজনেই অনেক চেষ্টা করছি আরেকটা চাকরি পাওয়ার। কিন্তু পরিস্থিতি দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। আমাদের অন্য কোন সাপোর্টও নাই। আমরা এইখানে শুধুই গার্মেন্টসকর্মী। আমরা জ্যান্ত লাশের মতই বেঁচে আছি।"
হাসিনা বেগমের বয়স ২৯ বছর। নয় বছর ধরে তিনি গার্মেন্টসকর্মী হিসেবে কাজ করেন। হাসিনার স্বামী স্থানীয় বাস ড্রাইভার এবং মাদকাসক্ত। ভালোবেসে বিয়ে করলেও হাসিনার স্বামী এখন তার কোনো খোঁজখবর রাখে না। নিজের মা-বাবার সঙ্গেও হাসিনার নেই কোন যোগাযোগ।
করোনায় চাকরি হারানোর আগে হাসিনা কাজ করতেন স্টার-ফাইভ গার্মেন্টসে। হাসিনা বলেন, "করোনা আল্লাহর দেয়া একটা গজব। আল্লাহ তার বান্দাদের পরীক্ষা করতে চান সবসময়। কিন্তু আমি বুঝিনা আল্লাহ কেন আমাদের এত কঠিন বিপদের মধ্যে ফেললেন?"
৩৮ বছর বয়সী আমিনা বেগম গত দশ বছর যাবত তৈরি পোশাক শ্রমিক হিসেবে কাজ করে আসছেন। তার স্বামী একজন রিকশাচালক। হাসিনার দুই সন্তান রয়েছে এবং তারা দুজনেই কোরানে হাফেজ। কোভিড-১৯ এর আগে হাসিনার জীবন ছিল সহজ-স্বাভাবিক। কিন্তু মহামারির কবলে পড়ে তিনিও চাকরি হারান। ফলে তিনি আর নিজের সংসারে কোন আর্থিক অবদান রাখতে পারছেন না। স্বামীর সামান্য আয় তাদের বেঁচে থাকার জন্যে যথেষ্ট নয় বলে জানালেন আমিনা।
আমিনা ইন্টার-ফাইভ গার্মেন্টস লিমিটেডে কাজ করতেন। লকডাউনে নিজের ভাইদের কাছ থেকে টাকা ধার করে বাসাভাড়া দিয়েছেন আমিনা। সন্তানদের মাদ্রাসায় কিছু টাকা কম রাখা হচ্ছে আপাতত। কিন্তু তারপর কি হবে? উত্তর জানা নেই আমিনার।
২৯ বছর বয়সী নয়ন বালা গত চার বছর ধরে তৈরি পোশাক কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। মহামারিতে চাকরি হারানোর আগে তিনি কাজ করতেন পানোরামা অ্যাপারেলস লিমিটেডে। নয়নবালার স্বামীও একজন গার্মেন্টকর্মী। তাদের দুই সন্তান রয়েছে।
গতবছরের মার্চে লকডাউন ঘোষণার পর নয়নবালা নিজের গ্রামে ছিলেন। কিন্তু ফিরে এসেও তিনি তার কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পারেননি কারণ তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়।
নয়নবালা জানান, "আমার কাছে শুধু আমার ফ্যাক্টরির আইডি কার্ড ছিল। আমি বেতন চাইলে তারা আমাকে বেতনও দেয়নি। তারা বলে যে আবার ফ্যাক্টরি খুললে তারা আমাকে আবার চাকরি করার সুযোগ দিবে।"
কুলসুম বেগম (৩৫) বিগত ছয় বছর ধরে একজন তৈরি পোশাক কর্মী। তিনসন্তানসহ মোট আট সদস্যের পরিবার তার। কুলসুমের স্বামী একজন কাঠমিস্ত্রী।
কুলসুম কাজ করতেন আলিফ গার্মেন্টসে। করোনা মহামারির সময় ছাটাইয়ের কবলে পড়েন তিনিও। চাকরি হারিয়ে এত বড় পরিবার চালাতে কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন কুলসুম। কুলসুমের কাছে তার চাকরিটা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস।
- ফিচারটি ইংরেজিতে পড়ুন: We are alive as living dead!
- অনুবাদ: খুশনূর বাশার জয়া