‘ফর্সা হওয়ার উন্মাদনা’ ভারতে নীরব এক মহামারি
অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া একটি মেসেজ, সোমা বণিককে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তার কিশোরী বয়সের 'ভয়াবহ স্মৃতিতে'। সেই অপরিচিতা ছিলেন জ্যানেট জেমস। ২০১৮ সালের জুনে, এক বিকেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম 'কোরা'তে সোমার সঙ্গে যুক্ত তিনি। সোমার প্রতি জ্যানেটের প্রথম বার্তাটি ছিল, "আপনার সাহায্য প্রয়োজন আমার।"
দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে রঙ ফর্সাকারী স্টেরয়েড বেটামেথাসোনযুক্ত ক্রিম ব্যবহার করে আসছিলেন সোমা বণিক। সেই ক্রিম ব্যবহারের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা লিখে নিজের স্কিন কেয়ার ব্লগে পোস্ট করেছিলেন তিনি। তার অভিজ্ঞতা পড়ে রীতিমত ধাক্কা খেয়েছিলেন জ্যানেট। নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যাওয়ায়, পরবর্তী নির্দেশনা চেয়ে সোমার কাছে একটি জরুরি বার্তা পাঠিয়েছিলেন তিনি।
রঙ ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহারের ভয়াবহ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথা জানিয়েছেন, কোলকাতায় বসবাসকারী সরকারি চাকরিজীবী সোমা বণিক (৩৩)। ব্লগ পোস্টে তিনি লিখেছেন, "যখনই আমি এটি ব্যবহার করা বন্ধ করতাম, আমার মুখে চুলকানি শুরু হতো, পাশাপাশি ছোট ফোস্কাও দেখা দিতো।"
বেটামেথাসোন এক ধরনের শক্তিশালী কর্টিকোস্টেরয়েড ওষুধ, যা সাধারণত সোরিয়াসিস ও একজিমাসহ ত্বকের চিকিত্সায় ব্যবহৃত হয়। তবে, এর সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে একটি হলো ত্বককে ফর্সা করা।
বেটামেথাসোনযুক্তন ক্রিমগুলো অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু ভারতে কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়াই ব্যবহার করা হচ্ছে বেটামেথাসোন ও অন্যান্য কর্টিকোস্টেরয়েডযুক্ত ক্রিম। বেশিরভাগ নারীরাই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা না করে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করছেন এসব পণ্য।
২০০৩ সালে যখন সোমার বয়স সবে ১৪, তখন একজন প্রতিবেশী তার মাকে বলেছিলেন, তার মেয়ে একটি নতুন ক্রিম ব্যবহার করে 'উপকৃত' হয়েছে; তার মেয়ের ত্বকের রঙ 'উজ্জ্বল' হয়েছে।
নতুন সেই ক্রিম ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে সোমার মাকে তিনি বলেছিলেন, "আপনার মেয়েও ফর্সা হবে।"
প্রতিবেশীর পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। মায়ের পরামর্শে টিউব ভর্তি ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার করতে লাগলেন সোমা।
স্কুলের বন্ধুরা প্রথম দিকে তার 'ফর্সা ত্বকের' প্রশংসা করলেও, স্টেরয়েড ক্রিম ব্যবহারের দুই মাসের মধ্যেই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলেন সোমা। রোদে বের হলেই ত্বকে পুড়ে যাওয়ার মতো যন্ত্রণা অনুভব করতে শুরু করলেন তিনি। সাময়িকভাবে এই যন্ত্রণাকে ফর্সা হওয়ারই একটি ধাপ মনে করেছিলেন সোমা। কারণ কথায় আছে, 'কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মেলে না'।
কিন্তু এক সকালে ক্রিম লাগাতে ভুলে যান তিনি। এর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তার ত্বকে একটি ফোঁড়া দেখা দেয়। ক্রিম লাগানোর পর দ্রুত তা চলে গেলেও, মুখে সারাক্ষণ চুলকানোর অনুভূতি হতে থাকে। এর কিছু দিনের মধ্যেই তিনি লক্ষ্য করলেন মুখে ব্রণ উঠছে; এক বছরের মধ্যেই তার সারা মুখে আবারও ফোঁড়া উঠতে থাকে এবং সেইসঙ্গে চুল গজাতে শুরু করে।
স্টেরয়েড ক্রিমের প্রতি আসক্তি
সিএনএন একাধিক ভারতীয় চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জেনেছে, অতিরিক্ত বা দীর্ঘ সময় ধরে স্টেরয়েডযুক্ত ক্রিম ব্যবহারের কারণে চুলকানি, ব্রণ ও মুখে চুল গজানোর মতো সমস্যাগুলো দেখা দেয়। এটাকে চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় 'টপিকাল স্টেরয়েড ড্যামেজড/ডিপেনডেন্ট ফেস (টিএসডিএফ)' বলা হয়ে থাকে।
টপিকাল কর্টিকোস্টেরয়েড যেমন- বেটামেথাসোন, ত্বকের প্রদাহ রোধসহ বেশ কিছু চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। তবে সেটি কেবল অল্প সময়ের জন্য; এবং এটি অবশ্যই একজন ডাক্তার, বিশেষ করে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ব্যবহার করা উচিত।
এ ধরনের পণ্যের ব্যবহার হাইপোপিগমেন্টেশনের (ত্বক ফর্সাকরণ) সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। যদিও এটি বেশিরভাগ নারীরা পছন্দ করেন, কিন্তু এই প্রবণতা বেটামেথাসোনযুক্তন ওষুধের অপব্যবহারের দিকে নিয়ে যায়। ফলস্বরূপ এর ওপর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে।
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ ডার্মাটোলজিস্ট, ভেনরিওলজিস্ট অ্যান্ড লেপ্রোলজিস্টস (আইএডিভিএল)-এর প্রধান ড. রাজেথা ডেমিসেটির মতে, একবার ত্বক স্টেরয়েড ক্রিমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে, এটি ব্যবহার বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ক্রিম ব্যবহার না করলেই মুখে ব্রণ, ফুসকুড়ি ও ত্বকে পুড়ে যাওয়ার মতো যন্ত্রণা হতে পারে। মূলত এ কারণেই বেশিরভাগ নারীরা লাগাতার এইসব ক্রিম ব্যবহার করে থাকেন।
২০১৮ সালে এই ওষুধ ব্যবহারের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা সত্ত্বেও ভারতে অবাধে এর ব্যবহার চলছে বলে জানান চর্মরোগ বিশেষজ্ঞরা।
২০১৭ সালে আইএডিভিএল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের বৈধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া স্টেরয়েড স্কিন ক্রিম বিক্রি নিষিদ্ধ করতে দিল্লি হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করা হয়। পিটিশনে বলা হয়, কর্টিকোস্টেরয়েডের অনিয়ন্ত্রিত বিক্রয় 'লক্ষ লক্ষ ভারতীয়দের স্বাস্থ্যের উপর গুরুতর বিরূপ প্রভাব' ফেলছে। সেই মামলার রায় এখনও দেয়নি আদালত।
তবে, ২০১৮ সালের মার্চে সরকারের পক্ষ থেকে একটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেটামেথাসোন সহ ১৪ টি টপিকাল স্টেরয়েড ক্রিমকে 'শিডিউল এইচ' ওষুধের তালিকাভুক্ত করে, যার মাধ্যমে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া এটি কেনা-বেচা নিষিদ্ধ করা হয়।
অথচ এই পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের বিক্রি কমেনি ভারতে।
'নীরব এক মহামারি'
ভারতের মতো বিশাল ঘনবসতি পূর্ণ দেশে স্টেরয়েড ক্রিমের অপব্যবহারের একটি পূর্ণ চিত্র উদ্ধার করা বেশ কঠিন।
তবুও, ভারতীয় নারীরা যে অজ্ঞতাবশত স্বাচ্ছন্দ্যে এই ক্রিম ব্যবহার করে চলেছেন এবং নিজেদের পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের ক্রিম ব্যবহারে উৎসাহিত করছেন তা সহজেই বোঝা যায়। এছাড়া, ভারতজুড়ে টিভি চ্যানেলগুলোতেও রঙ ফর্সাকারী পণ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় নিয়মিত; এর মাধ্যমেই নারীরা ও তাদের পরিবার প্রভাবিত হচ্ছেন এসব ক্রিম ব্যবহারে।
সাম্প্রতিক পুরো ভারত ঘুরে উত্তরের দিল্লি শহর, পূর্বে কলকাতা, পশ্চিমে আহমেদাবাদ ও দক্ষিণ ভারতের হায়দ্রাবাদের ১৬ টি ফার্মেসি থেকে সিএনএন চার ধরনের টপিকাল স্টেরয়েড ক্রিম কিনতে সক্ষম হয়েছে।
সিএনএন যেসব ফার্মেসিতে গিয়েছিল সেগুলোর মধ্যে মাত্র একটি ফার্মেসি থেকে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন চাওয়া হয়েছিল ওষুধ বিক্রির আগে। অন্যদেরকে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এই ওষুধ বিক্রির কারণ জানতে চাইলে, তারা সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যান।
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ শ্যাম ভার্মা দীর্ঘ দিন ধরে স্টেরয়েড অপব্যবহারের উপর কাজ করছেন। তিনি ভারতজুড়ে এই ওষুধের অপব্যবহারের সঙ্গে সম্মত হয়ে সিএনএনকে বলেন, সমস্যাটি কেবল ফার্মাসিউটিক্যাল লবির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
"এছাড়াও কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মাদক নিয়ন্ত্রণ দপ্তরগুলোর আইনটি কার্যকর করার ইচ্ছাশক্তি ও জনবলের অভাব রয়েছে বলে মনে হচ্ছে", তিনি আরও যোগ করেন।
তবে, এ ব্যাপারে ভারতের ফার্মেসি কাউন্সিল কর্তৃপক্ষের মন্তব্য জানতে চাইলে সিএনএনের অনুরোধে কোনো সাড়া দেননি তারা।
'যোগ্য বর পেতে হলে, কনেকে ফর্সা হতে হবে'
ভারতে কর্টিকোস্টেরয়েডের ব্যাপক অপব্যবহারের মূলে রয়েছে একটি রক্ষণশীল ধারণা। অধিকাংশ ভারতীয়রা মনে করেন, গায়ের রঙ ফর্সা হলে বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের যোগ্য বর খুঁজে পেতে সুবিধা হয়, পাশাপাশি কালো বর্ণের মেয়ের তুলনায় ফর্সা বর্ণের মেয়ের সঙ্গে যৌতুকও কম দিলে চলে।
২০১৪ সালে দিল্লির গুরুগ্রামে আত্মহত্যা করেছিলেন এক নারী। কারণ তার শরীরের রঙ নিয়ে কটূক্তি করতেন তার স্বামী। এতে অতিষ্ট হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
এর একবছর পর কলকাতার এক স্কুলশিক্ষক নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। হাসপাতালে মারা যাওয়ার আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, তার শরীরের রঙের কারণে অবিরাম অপমান সহ্য করে আসছলেন তিনি। প্রতিনিয়িত তাকে বলা হতো, গায়ের রঙের কারণে কেউ তাকে বিয়ে করবেন না। এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে তিনিও আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
চারপাশের পরিস্থিতি বিবেচনায় সোমা বণিকের মা ২০ বছর আগে প্রতিবেশীর পরামর্শ আমলে নিয়েছিলেন। সোমা বলেন, "আমাদের দেশে সৌন্দর্য পরিমাপ করা হয় অন্যায্য পন্থায়। আমি বিশ্বাস করি আমার মা আমাকে ফর্সা বানাতে চেয়েছিলেন যেন আমি সমাজে স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা পাই।"
'একটি সতর্কতামূলক গল্প'
সোমার মুখে টপিকাল কর্টিকোস্টেরয়েডের ব্যবহার বন্ধ করতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ ছয় বছর। ক্রিমের ব্যবহার বন্ধে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
সোমার ভাষায়, "একদিন সকালে আমি ঘুম থেকে উঠে সিদ্ধান্ত নিলাম, ক্রিমটি আর ব্যবহার করবো না; সব ধরনের পরিণতির জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম।"
ক্রিমের ব্যবহার বন্ধের পর তার চেহারায় নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে থাকে। এমনকি মানুষ তার চেহারা নিয়ে হাসাহাসিও করতো।
সোমা বলেন, "এতে আমার আত্মবিশ্বাস কমে গিয়েছিল। আমার মনে আছে, একজন সহপাঠী বলেছিল আমার চেহারা শূকরের চেয়েও খারাপ; তার এই কথা অনেক দিন ধরে আমার মাথায় ছিল। পুনরায় আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে কয়েক বছর সময় লেগেছিল আমার।"
দীর্ঘ দিনের প্রচেষ্টায় ব্রণ, ফুসকুড়ি ও পুড়ে যাওয়ার অনুভূতি বন্ধ হলেও, মুখে চুল গজানো বন্ধ হয়নি সোমার। এটি মেনে নিয়েই সামনের দিনগুলো চলতে হবে তাকে।
সোমার সাহায্যে জ্যানেটও তার ত্বকের সমস্যাগুলোর সমাধান পেয়ে যান। পুড়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি, ব্রণ, কিংবা ফুসকুড়ি থেকে কীভাবে মুক্তি মিলবে সেসব তিনি জেনেছেন সোমার কাছ থেকে।
সোমা জানান, জ্যানেট সেই সাড়ে ৬ লাখ নারীদের মধ্যে একজন, যারা এখন পর্যন্ত তার স্কিন কেয়ার ব্লক থেকে পরামর্শ পেয়েছেন।
তার অভিজ্ঞতা আমাদের সমাজকে একটি সতর্কতামূলক গল্প শুনিয়ে গেলো।
সোমা বলেন, "টপিক্যাল স্টেরয়েড আপনার মুখে কী ঘটাতে পারে তার এক জীবন্ত উদাহরণ আমি। আপনারা শুনছেন তো?"
সূত্র: সিএনএন