৫০ বছর ধরে ৩০০ ধানবীজ সংগ্রহ করেছেন রাজশাহীর কৃষক ইউসুফ মোল্লা
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার খিতাপচর গ্রামের কৃষক ইসলাম মোহাম্মদ। তিনি রাজশাহীর ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে ৬০ জাতের ধানবীজ সংগ্রহ করে তার জমিতে আবাদ করছেন। তিনি এই প্রতিবেদককে মোবাইল ফোনে জানান, ধানের আদি বীজ রক্ষা ও এর চাষকে অব্যাহত রাখতে আমরা কাজ করছি। আমি যেমন ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে বিলুপ্ত জাতের ধানের বীজ সংগ্রহ করেছি একইভাবে আমি নিজেও ১০/১২টি আমাদের স্থানীয় আদি ধান বীজ তাকে সরবরাহ করেছি। কারণ আমরা চাই মাঠে ধানবীজ সুপ্ত অবস্থায় টিকিয়ে রাখতে। এটাকে আমরা আন্দোলন হিসেবে নিয়েছি। যাতে আমাদের মাটির আদি বীজ হারিয়ে না যায়।
ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে ২৬ জাতের ধান বীজ নিয়ে চাষাবাদ করেছেন রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সৈয়দপুর গ্রামের কৃষক খন্দকার আবদুল মুকিদ। তিনি জানান, আমি মোট ৩৫ বিঘা জমিতে ধান চাষাবাদ করি। এর মধ্যে ১৫ বিঘা জমিতে ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে নিয়ে আসা বিলুপ্ত জাতের ধান বীজের চাষাবাদ করেছি। ওইসব ধানের ফলন কম। কোনোটাতে পেয়েছি আট মণ, কোনোটাতে পাঁচ মণ, কোনোটাতে সাত মণ করে। বীজ রেখে দিয়েছি যেন আগামী বছর আবার চারা করে চাষাবাদ করা যায়। এই ধান চাষাবাদের একটাই লক্ষ্য আদি ধানবীজ রক্ষা করা।
শুধু তারাই নন, ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে বীজ নিয়ে চাষাবাদ করছেন কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, নরসিংদী, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, নীলফামারী, বগুড়া, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও নওগাঁসহ দেশের বিভিন্ন জেলার হাজারখানেক কৃষক। তবে কৃষকদের ধানবীজ দেয়ার ক্ষেত্রে তার শর্ত একটাই, যে পরিমাণ ধানবীজ তার কাছ থেকে নেওয়া হবে তার দ্বিগুণ পরিমাণ ধানবীজ তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
সংগ্রহকৃত ধান বীজ টিকিয়ে রাখার জন্য ইউসুফ মোল্লা নিজেও তার দেড় বিঘা জমিতে অল্প অল্প করে প্রতিবছর ৯৬ জাতের ধান চাষাবাদ করেন। তার কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করে চাষাবাদ করছেন রাজশাহী তানোরের জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষক নূর মোহাম্মদ। তিনি জানান, ইউসুফ মোল্লার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান ধান বীজ সংগ্রহ করা। যখন যেখানে এর খোঁজ পান সেখানেই তিনি ছুটে যান। তার চেষ্টায় দেশের একমাত্র বীজ ব্যাংক স্থাপিত হয়েছে। তার কাছ থেকে আমি নিজেও কিছু বিলুপ্ত জাতের বীজ নিয়ে এসেছি।
ইউসুফ মোল্লার সংগৃহিত ধানবীজ নিয়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট গবেষণা করছে। তার ধানবীজ নিয়ে দেশের অনেক জাদুঘরে রাখা হয়েছে।
ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১০০, গাজীপুরের ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ১৪০, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট ঈশ্বরদী ২৯, দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৭ ও রাজশাহী ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ৪০ জাতের ধান বীজ নিয়ে গবেষণা করছে। এর মধ্যে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ তার কাছ থেকে ৩০০ জাতের ধানবীজ নিয়ে একটি আলাদা মিউজিয়াম করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু সেতু আঞ্চলিক জাদুঘরে প্রদর্শনীর জন্য সংরক্ষিত আছে তার কাছ থেকে নেয়া ১৪০ জাতের ধানবীজ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরুল মতিন এ প্রসঙ্গে জানান, আমি ইউসুফ মোল্লার কাছ থেকে প্রায় ১০০ জাতের ধানবীজ নিয়ে এসেছি। সেখান থেকে আমি গবেষণা করে দেখছি, সেই ধানবীজ থেকে কীভাবে আমরা উপকার পেতে পারি। কীভাবে ধানবীজের সংকরায়ন করে খরা সহিষ্ণু জাত আবিষ্কার করা যায় সে বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম দুবইল। ওই গ্রামের বাসিন্দা ইউসুফ আলী মোল্লা। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও মনের বয়স বাড়েনি এতটুকু। এই বয়সে এখনো ছুটে বেড়ান বিলুপ্ত জাতের ধান বীজ সংগ্রহে। দেশের যে প্রান্তেই খবর পান বিলুপ্ত জাতের ধান সংগ্রহে ছুটে যান তিনি। এভাবেই সংগ্রহ করেছেন দেশীয় বিলুপ্ত জাতের ৩০০'র মতো ধান বীজ। শুধু সংগ্রহই করেননি সেই ধান দিয়ে তৈরি করেছেন দেশের একমাত্র 'ধানবীজ ব্যাংক' ও 'ধানবীজ লাইব্রেরি'।
ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগের পাশাপাশি কৃষকদের মাঝে তিনি সেই বীজ বিতরণ করেছেন। এছাড়া প্রতিবছর ডিসেম্বরে প্রায় আড়াই শতাধিক কৃষকদের নিয়ে জাঁকজমকভাবে উদযাপন করেন নতুন ধান ঘরে তোলার উৎসব 'নবান্ন উৎসব'। ধানবীজ ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষকদের দেন সম্মাননা পুরষ্কারও। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি নিজেও পেয়েছেন জাতীয় পরিবেশ পদক। তার কাছ থেকে সংগ্রহকৃত বিলুপ্ত জাতের ধান নিয়ে দেশের নামকরা গবেষণা সংস্থা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা গবেষণা করছেন ।
শনিবার (১১ জানুয়ারি) তানোর উপজেলা থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে দুবইল গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে দেশের একমাত্র ধানবীজ ব্যাংক 'বরেন্দ্র ধানবীজ ব্যাংক'। সেখানে স্থাপিত পাকা তিনটি কক্ষের মধ্যে একটি রুমে তৈরি করা হয়েছে ধানবীজ ব্যাংক। ধানবীজ ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, রুমের একদিকের দেয়াল জুড়ে তিন তাকে সারি সারি কাঁচের বয়ামে শোভা পাচ্ছে নানা জাতের ধান বীজ। কোনো বয়াম ভর্তি, আবার কোনো বয়ামে রয়েছে বিভিন্ন জাতের অল্পকিছু বীজ। বয়ামের গায়ে সাদা কাগজে নাম লেখা আছে প্রত্যেকটি ধানবীজের নাম। সতিন, ঝিঙ্গাসাইল, দাত খানি, রাঁধুনী পাগলা, বাদশা ভোগ, চিনি শংকর, সিব জটা, বান কলম, ঝগড়া সাইল, রানার সাইল, অহনাসহ নাম না জানা নানা জাতের দুষ্প্রাপ্য সব ধানবীজ।
কিভাবে এত এত দুস্প্রাপ্য সব জাতের ধান বীজ সংগ্রহ করেছেন জানতে চাইলে এ প্রতিবেদককে ইউসুফ আলী মোল্লা জানান, গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমি তিল তিল করে এই ধান বীজের সংগ্রহের যুদ্ধ শুরু করেছি। এক একটি বীজ সংগ্রহ করার জন্য আমাকে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। কথা প্রসঙ্গে তিনি আরও জানান, আমার কাছে এমনও ধানবীজ রয়েছে যার বয়স ১০০ বছর পার হয়ে গেছে। যেমন সোনাকাঠি নামের একটি ধানবীজ রয়েছে যেটি বাংলা ১৩৩৪ সালের দিকে পাওয়া যেত। বর্তমানে আমার কাছে এই জাতের ৩০০ ধানবীজ রয়েছে। যার মধ্যে ১৫০ জাতের বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি ১৫০ জাতের এখনো অঙ্কুরোদগম হয়। আমি নিজেও এ বছর দেড়বিঘা জমিতে ৯৬ জাতের ধান চাষাবাদ করেছি।
শুরুর কথা
১৯৬৮ সালে বিয়ের পর ইউসুফ মোল্লা দেখতে পান একের পর এক নতুন ধান আবিষ্কৃত হচ্ছে। কৃষকরা তখন ঐতিহ্যবাহী দেশি ধানের আবাদ বাদ দিয়ে অধিক ফসল প্রাপ্তির আশায় উদ্ভাবিত নতুন ধানের চাষাবাদে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তখন তার মনে শঙ্কা জাগে এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় আসবে যখন হয়তো গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নানা জাতের এধরনের ধানের বীজ আর পাওয়া যাবে না। তখন তিনি দেশীয় এসব ধানবীজ সংগ্রহের পণ করেন। প্রথমে মাটির হাঁড়িতে পরে কাচের বয়ামে তা সংগ্রহ করতে শুরু করেন। তবে তাকে তখন এ কাজে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন সোহেল রানা নামে তার এক বন্ধু। তার বন্ধুই তাকে শিখিয়েছেন কীভাবে বীজ সংগ্রহ করতে হয়, কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয়।
আর্থিক সংকট ও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি মাত্র ৬০ জাতের বিলুপ্ত ধানবীজ সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। এসময় তিনি পরিবেশবাদী গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজ (বারসিক)'র সঙ্গে পরিচয় হবার পর থেকেই তারা তাকে এ কাজে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে আসছেন। কোথাও বিলুপ্ত জাতের ধানবীজের সন্ধান পেলে তারাই সেসব বীজ সংগ্রহের যাবতীয় অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেন। তাদের সহযোগিতায় ২০১৫ সালে দুবইলে প্রতিষ্ঠিত হয় 'বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক' ও তালন্দ আনন্দমোহন উচ্চবিদ্যালয়ে স্থাপিত হয় 'ধানের বীজের লাইব্রেরি'। ইউসুফ মোল্লা ও বারসিকের দাবি, এই ধানবীজ ব্যাংক ও লাইব্রেরি দেশের মধ্যে প্রথম।
ইউসুফ মোল্লা জানান, ১৯৬৭ সাল থেকেই উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল ইরি-৮ ধানের আবাদ শুরু হয়। কৃষকরা তখন দেশি জাতের ধান বাদ দিয়ে উদ্ভাবিত নতুন ধানের চাষ শুরু করে। এরপর এলো ইরি-২০। তখন কৃষকরা ইরি-২০ ধান চাষাবাদ করতে শুরু করেন। এসব দেখেই আমার মনে হয়েছিল এভাবে চলতে থাকলে একসময় দেশি ধানের কথা কৃষকরা ভুলে যাবে এবং পরবর্তীতে তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আমি নিজেও কৃষক পরিবারের সন্তান। বাবাকে যেসব ধান চাষাবাদ করতে দেখেছি কয়েক বছরের ব্যবধানে দেখলাম সেইসব ধান আর কেউ চাষ করছে না। এসব দেখেই আমার ভেতরে ইচ্ছা জাগে বিলুপ্ত জাতের ধান বীজ সংগ্রহের। ধান বীজ সংগ্রহে ঘুরে বেরিয়েছি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। এভাবেই রংপুরে গিয়ে পেয়েছি 'কালো বকরি' ও 'সাদা বকরি' নামের ধানবীজ। আমার কাছে এমন ধানের বীজও আছে যার চালও কালো, ভাতও কালো হয়।
বারসিকের বরেন্দ্র অঞ্চলের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী শহিদুল ইসলাম জানান, জলবায়ুবান্ধব ও পরিবেশ সহনশীল স্থানীয় যেসব ধানের জাত রয়েছে সেসব রক্ষায়ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এগিয়ে আসা উচিত। কারণ এইসব ধানের জাত যেমন আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য ও বৈচিত্র্যতা ধরে রাখে ঠিক একইভাবে সুস্বাদু খাবারের জোগানও দেয়। শুধু উৎপাদনের কথা বিবেচনা না করে ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্যও ধানের এইসব জাতের সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্বও সরকারের নেয়া উচিত।
ধানবীজ সংরক্ষণের বিষয়ে ইউসুফ মোল্লা জানান, ধানবীজ ব্যাংকে যেসব বীজ রয়েছে সেসব অঙ্কুরোদগমন হয় না। সেসব শুধু পরিদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। তবে আমার কাছে যে ৩০০ জাতের ধানবীজ রয়েছে তার মধ্যে ১৫০ জাতের অঙ্কুরোদগমন হয়। সেসব ধানবীজ বস্তায় যত্ন করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে ১৫০ জাতের ধানের মধ্যে আমি ২৫ জাতের ধানবীজ চাষাবাদ করছি। বাকি জাতের ধানবীজ আমার কৃষকদের মধ্যে সমপরিমাণ ধানবীজ দেয়ার শর্তে চাষাবাদ করার জন্য বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে। তারা ধানবীজ বপন করে চাষাবাদ করে। চাষাবাদ করার পর আমাকে আবার তারা সমপরিমাণ ধানবীজ সরবরাহ করে। এভাবেই প্রধানত ধানবীজ সংরক্ষণ করা হয়।
তবে বয়ামের বীজগুলো যাতে পচে না যায় সেজন্য প্রতিবছর একবার করে রোদে দিয়ে শুকিয়ে নিতে হয় জানিয়ে তিনি জানান,বয়ামের বীজগুলো ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু সেতু আঞ্চলিক জাদুঘর কর্তৃপক্ষ বীজ সংরক্ষণের জন্য মেডিসিন পাঠাতে চেয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে এখনো তা তিনি পাঠাতে পারেন নি।
ইউসুফ আলী মোল্লা জানান, আমি তো আর চিরদিন বেঁচে থাকব না। তাই আমি চেষ্টা করছি এমন কৃষক তৈরি করতে যারা আমার অবর্তমানে ধানবীজ ব্যাংক দেখাশোনা করবে এবং সারাদেশের কৃষকদের মধ্যে এই ধান বীজের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে। কষ্টকর হলেও এই করোনাকালেও ধান বীজের সংগ্রহ ও সরবরাহের ব্যাপারে আমি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করছি এবং তাদের সাথে দেখাসাক্ষাত করার কাজটি করে যাচ্ছি।