৪৫ কেজি ওজনের কাতলের দাম ৮০ হাজার টাকা!

বোয়াল, আইড়, বাঘাইড়, চিতল, কাতলা, বাউশ, কালাবাউশ, রুই ছোট-বড় নানা আকারের মাছ। কোনটার আকার ৪৫ কেজি, কোনটা ১০ কেজি। নানা জাত আর আকারের মাছের সমারোহ নিয়ে মৌলভীবাজারের শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর পাড়ে শুরু হয়েছে প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা। প্রতি বাংলা সালের পৌষ মাসের শেষ দিনে পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে এই মেলা বসে মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জের মিলনস্থল মৌলভীবাজারের শেরপুরে।
সোমবার বিকেল থেকে সিলেট বিভাগের হাইল হাওর, কাউয়াদীঘি হাওর, বড় হাওর, হাকালুকি, টাঙ্গুয়া, কুশিয়ারা নদী, সুরমা ও মনু নদীসহ সিলেট অঞ্চলের প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছ নিয়ে আসতে শুরু করেছেন মৎস্য ব্যবসায়ীরা। ১৫ জানুয়ারি ভোরে শেষ হবে মেলায় আনুষ্ঠানিকতা। মাছের মেলার সঙ্গে সঙ্গে এখানে বসেছে নানা ধরনের হস্তশিল্প ও গ্রামীণ খাবারের মেলা।

সরজমিনে মেলায় প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে মাছ আর মাছ, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাছ নিয়ে যেমন বিক্রেতারা এসেছেন তেমনি এসেছেন পাইকারেরা ও খুচরা ক্রেতারা। একসঙ্গে বড় আকারের বিভিন্ন জাতের এত মাছ দেখার সুযোগ হাতছাড়া না করতে আসেন অনেক দর্শকও। তারা ঘুরে ঘুরে মাছ দেখেন, দাম জানতে চান। ক্রেতা ও দর্শকরা সবাই সিলেট অঞ্চলের হলেও বিক্রেতাদের বড় একটি অংশ এসেছেন দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে।
কক্সবাজার থেকে ১০টি বড় আকারের সামুদ্রিক মাছ নিয়ে মেলায় এসেছেন আব্দুল জব্বার। তিনি জানান, মেলার আয়োজনকে ঘিরে গত ১৫ দিন ধরে তিনি বিভিন্ন সাইজের মাছ সংগ্রহ করে মেলাতে নিয়ে এসেছেন। প্রথম দিনে বিক্রি ভাল না হলেও শেষ মুহূর্তে বিক্রি বাড়বে বলে আশা করছেন তিনি।
এক ব্যবসায়ী ৪৫ কেজি ওজনের একটি কাতল মাছের দাম হাঁকছেন ৮০ হাজার টাকা। মাছটি মেলায় নিয়ে এসেছেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বরুণা এলাকার আবুল হাসান। তার দাবি এটাই মেলার সবচেয়ে বড় মাছ। এটি তিনদিন আগে কুশিয়ারা নদী থেকে ধরা হয়েছে। তিনি জানান, এই বছর মেলায় ৮ লাখ টাকার মাছ তিনি নিয়ে এসেছেন। এখন পর্যন্ত ২ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করেছেন। ধারণা করছেন বাকি মাছও বিক্রি হয়ে যাবে।

৩২ কেজি ওজনের একটি বাঘ মাছ মেলায় নিয়ে এসেছেন নাসির আহমদ, তিনি এ মাছটির দাম হাঁকছেন ৬০ হাজার টাকা।
স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান জানান, মাছের মেলা এ অঞ্চলের একটি ঐতিহ্য। মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকাটি উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। বৃহত্তর সিলেটের মধ্যে মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের বিভিন্ন হাওর-নদীর মাছ ছাড়াও খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানের মাছ আসে। তিনি এই ঐতিহ্যের সঙ্গী হতে ১৫ বছর যাবত মেলায় মাছ নিয়ে আসেন।
মেলায় মাছ ক্রয় বিক্রয়ের পাশাপাশি বড় একটি সংখ্যা উৎসুক দর্শক এসেছেন মাছ দেখতে। তারা ঘুরে ঘুরে মেলার মাছ দেখেন আর একটু পর পর মেলা থেকে নাড়ু, সন্দেশ খাচ্ছেন আবার কেউ কেউ দল বেঁধে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন। শিশুদের জন্য আছে নাগর দোলাসহ বিভিন্ন ধরনের খেলনার মেলা।
মেলায় ঘুরতে আসা সিলেটের জনি পাল তিনি জানান, মাছ কিনতে নয় দেখতে এসেছি। এতো মাছ এক সঙ্গে দেখার জন্য প্রতি বছর অপেক্ষা করি। আমরা ৭/৮ জন বন্ধুবান্ধব মিলে মেলা দেখতে এসেছি।
স্থানীয় বাসিন্দা মতিন মিয়া জানান, মেলা উপলক্ষে মাছ ব্যবসায়ীরা সপ্তাহ থেকে ১৫ দিন আগে থেকে বড় বড় মাছ সংগ্রহ করতে থাকেন তারা। সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা মেলায় এসে আড়ত থেকে ছোট বড় অনেক জাতের মাছ কিনে নিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েন।
তিনি জানান, এটা সৌখিন মানুষের মেলা। ৪/৫ হাজার টাকার নিচে কোন মাছ পাওয়া যায় না। মেলায় ছোটো আকারের মাছের দাম হাঁকানো হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা, মাঝারি সাইজের মাছের দাম হাঁকানো হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং বড় সাইজের মাছের দাম ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ। এক রাতেই মাছের মেলায় কোটি কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়ে থাকে।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা সিলেটের অনেক প্রবাসীও মাছের মেলাকে কেন্দ্র করে দেশে আসেন। গোয়ালা বাজারের ফুল মিয়া ইংল্যান্ড থেকে দেশে এসেছেন, তিনি জানালেন বিদেশে থাকলেও দেশে সব কিছু মনে পরে। ছোট বেলার স্মৃতিতে মাছের মেলা বড় একটি অংশ নিয়ে বসে আছে। আমার আগামী মাসে দেশে আসার কথা ছিল। কিন্তু মাছের মেলার জন্য এক মাস আগেই চলে এসেছি। তিনি জানান, দুটি চিতল এবং তিনটি রুই তিনি কিনেছেন ৫৫ হাজার টাকা দিয়ে ।

মেলায় হাকালুকি হাওর থেকে বিশাল আকারের এক জোড়া কাতল ও এক জোড়া বোয়াল নিয়ে এসেছেন হিরা মিয়া ও লাল মিয়া। কাতলের জোড়ার দাম হাঁকছেন ২৬ হাজার এবং বোয়ালের জোড়ার দাম হাঁকছেন ৪৮ হাজার টাকা।
ব্যব্যসায়ীদের দাবি মেলার সব মাছ কোনো না কোনো হাওরের। এ কথা শুনে পাশে থাকা একজন প্রবীণ জানালেন দেশি মাছের সেই দিন কি আর আছে বাবা! দেশি মাছের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি তাই ব্যব্যসায়ীরা সব মাছকেই দেশি মাছ বলছে বাস্তবে বেশির ভাগ মাছ ফিশারির।
এদিকে, ক্রেতাদের অভিযোগ মাছের দাম অস্বাভাবিক। ফরহাদ মিয়া নবীগঞ্জ থেকে মাছ কিনতে এসেছেন তিনি জানালেন ১০ কেজি ওজনের একটা বোয়াল মাছের দাম তার কাছে দাবি করা হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। মাছের এতো দাম শুনে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। তবে মধ্যরাতের পর মাছের দাম কমবে বলে জানালে প্রতিবছর এই মেলায় নিয়ম করে আসেন এমন অভিজ্ঞরা।
মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ জানান, মেলার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে সেই সাথে কোন ধরনের আইন বিরোধি কাজ বা জুয়া যেনও না বসতে পারে তার জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা রয়েছে ।

সিলেটে মাছের নাম ময়ূরপঙ্খী
সিলেট নগরীর বন্দরবাজার এলাকার লালবাজারে পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে মাছের মেলার। তিনদিনব্যাপী এই মেলা শুরু হয়েছে সোমবার। মূলত এটি মাছেরই বাজার। প্রতিদিনই মাছ বিক্রি হয়। প্রতিদিনই যেখানে মাছের পসরা নিয়ে বসেন বিক্রেতারা, চলে কেনাবেচা- সেখানে আলাদা করে মেলার আয়োজনের বিশেষত্ব কী?
বিশেষত্বটা জানালেন লালবাজার মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি এনায়েতুর রহমান। তিনি বলেন, পৌষ সংক্রান্তিতে মাছের মেলা আমাদের ঐতিহ্য। নগর থেকে এইসব ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা মেলার মাধ্যমে তা ধরে রাখার চেষ্টা করছি। তাছাড়া মেলা উপলক্ষ্যে এখানকার মাছের সংগ্রহেও অনেক বৈচিত্র আনা হয়েছে। নানা দুর্লোভ ও সিলেটে দুস্প্রাপ্য প্রজাতির মাছও মেলায় নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিনকার চেয়ে আকারে অনেক বড় বড় মাছও আনা হয়েছে। ফলে হরেক প্রজাতির মাছের সঙ্গেও পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন নগরবাসী।
মেলায় ঢুকেই প্রমাণ পাওয়া গেলো এনায়ুতর রহমানের কথার। বাজারের প্রবশের পরই বা পাশের এক ব্যবসায়ীর মাছকে ঘিরে দেখা গেলো অতিরিক্ত ভিড়। কাছে ঘেঁষতেই বুঝা গেলো এই ভিড়ের কারণ। সবুজ আহমাদ নামের এই ব্যবসায়ী বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের পসরা সাজিয়েছেন। হাওর-বিল ঘেরা সিলেটে সামুদ্রিক মাছ প্রায় পাওয়াই যায় না। এই লোনা পানির এসব মাছের স্বাদ থেকে বঞ্চিত এখানকার বাসিন্দারা। মেলায় সেই সুযোগ মিলেছে। ফলে সামুদ্রিক মাছের দোকানের সামনে ভিড় একটু বেশি তো হতেই পারে।
সবুজ আহমদের স্টলের লম্বাটে যে মাছটি সবার দৃষ্টি কাড়ছিল তার নাম ময়ুরপঙ্খী। চেহারা তেমন আকর্ষণীয় নয়, ছাই রংয়া, বাইম মাছের মতো লম্বাটে, তবে নামের কারণেই এই মাছটি দৃষ্টি কাড়ছিল সবার। বাদুড়ের মতো দেখতে আরকেটি মাছের নাম- শাপলা। শাপলা কেবল ফুলের নাম নয়, মাছেরও এমন নাম হয়- এই মেলায় না আসলে সিলেটের ক’জন জানতো! ছিলো সমুদ্রের জনপ্রিয় মাছগুলো- কুড়াল, ভাটা, তাপসি।

মেলায় সামুদ্রিক মাছ নিয়ে বসা সবুজ আহমদ বলেন, প্রতি কেজি কুড়াল ১২শ’ টাকা, ময়ূরপঙ্খী কেজি প্রতি ১২শ’ টাকা, শাপলা কেজি প্রতি ৬০০ টাকা, বামাস ৬০০ টাকা, ভাটা ৮০০ টাকা, টুনা মাছ ৪০০ টাকা, ভইল মাছ ৪৫০ টাকা, সেইল ফিশ এক হাজার ৫০০ টাকা, তাপসি ৬০০ টাকা দরে কেজি বিক্রি করে হচ্ছে। ক্রেতারা চাইলে কেজি হিসেবে কিংবা আস্ত মাছও কিনে নিয়ে যেতে পারবেন।
সামুদ্রক মাছের পাশাপাশি রুই, কাতলা, চিতল, বোয়াল, চিংড়ি, পাবদাসহ এই অঞ্চলের জনপ্রিয় মাছগুলো তো ছিলই। মেলায় ২০ কেজি ওজনের একটি বোয়াল মাছ নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ী কালাম মিয়া। দাম হাঁকছেন ৩৫ হাজার টাকা। দুপুর পর্যন্ত বিক্রি হয়নি বোয়ালটি। ক্রেতারা কেবল দরদাম করে যাচ্ছেন। কালাম জানান, আস্ত মাছটি বিক্রি না হলে সন্ধ্যার কেটে কেজি হিসেবে বিক্রি করবেন।
লালবাজার মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলজার আহমদ ২০১৭ সাল থেকে আমরা এই মেলা করছি। বুধবার পৌষের শেষদিনে মেলাও শেষ হবে। প্রতিবছর এমন মেলার আয়োজন করা হবে বলে জানান তিনি।