২১ শতকেও ঘোড়া চালিত ট্রেন!
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও পৃথিবীর বুকে চালু ছিল ঘোড়া চালিত ট্রেন, অর্থাৎ বাহনটি টেনে নেওয়ার কাজ করতো ইঞ্জিন নয়- ঘোড়া। বিষয়টি কিছুটা বিস্ময়কর তো বটেই। কাঠের তৈরি লরির মতো দেখতে একটি বাহন, উভয় পাশেই রয়েছে যাত্রীদের বসার ব্যবস্থা। যানটির সামনের দিকে লোহার আংটায় দড়িতে বেধে দেওয়া হয় একটি ঘোড়া। ঘোড়াটিই যাত্রী সমেত যানটিকে রেললাইনের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে যায়।
১৬ জন যাত্রী বসার কথা থাকলেও ২০'র অধিক যাত্রী চলাচলই দৈনন্দিন ঘটনা ছিল, বেশ অমানবিক এক ব্যবস্থাই বলা যায়। বর্তমানে এই ট্রেনের সব কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও সর্বশেষ ২০১৪ সালেও এই ট্রেন দিয়ে নিয়মিত যাত্রী পরিবহন হতো।
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ফয়সালাবাদের জারানওয়ালায় গঙ্গাপুর গ্রামের দেখা মিলতো এই ট্রেনের। এর জন্য আলাদা যাত্রী ছাউনি ও টিকিট কাউন্টারও ছিল। যাত্রীরা প্রথমে বাহনটিতে চেপে বসেন। তারপরই দড়িতে বাধা ঘোড়াকে লোহার আংটার মাধ্যমে বাহনটির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। অন্য পাশ থেকে আরেকটি ট্রেন এলে পারাপারের জন্যও রয়েছে অভিনব পদ্ধতি। দুটি বাহন থেকে যাত্রীরা নেমে যান, সামনের বাহনের যাত্রীরা পেছনের বাহনে ও পেছনের যাত্রীরা সামনের বাহনটিতে উঠে বসেন। অদল বদল করা হয় ঘোড়া দুটি, এভাবেই মুখোমুখি এসে পড়া দুটি বাহন আবার উলটোপথে নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যায়।
এই ট্রেনের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৮৯৮ সালে, প্রথম যাত্রা শুরু হয় ১৯০৩ সালে। ব্রিটিশ ভারতের প্রখ্যাত প্রকৌশলী স্যার গঙ্গারাম আগরওয়াল ছিলেন এই ট্রেনের কারিগর। ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি করার সময় তিনি বেশ কিছু ঐতিহাসিক নির্মাণকাজের দায়িত্ব পান। অবসরের পর পাঞ্জাব প্রদেশের ৮৫ হাজার একর জমি ইজারা নেন তিনি। জমিগুলোকে সেচের মাধ্যমে উর্বর করে তুলতে কাজে লাগান তার প্রকৌশল বিদ্যা। প্রচলিত আছে, এরপর থেকেই গ্রামটিকে গঙ্গাপুর নামে ডাকা হয়।
গ্রামটিতে সেচ কাজের যন্ত্রপাতি আনা-নেওয়ার জন্য এই রেললাইন ও ঘোড়ায় টানা ট্রেনের প্রচলন করেন তিনি। গঙ্গাপুর থেকে বুচিয়ানা পর্যন্ত ৩ কিমি জুড়ে রেললাইন বসানো হয়। তবে কথিত আছে, তার মেয়ের জামাইয়ের অনুরোধে মেয়ের বিয়ের উপহার হিসেবেই এটি নির্মাণ করেছিলেন তিনি। সেসময় গঙ্গাপুর থেকে বুচিয়ানা রেলস্টেশন পর্যন্ত যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
১৯২৭ সালে গঙ্গারামের মৃত্যুর পর এই ট্রেন এস্টেট সোসাইটির অধীনে চলে যায়। এরপর ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সচল ছিল ট্রেনটি। রেললাইনের পাত চুরি হয়ে যাওয়ার ১৯৯৩ সালে বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল।
পরবর্তীতে ২০১০ সালে প্রায় ৫১ লাখ রূপি খরচ করে আবারও চালু হয় ট্রেন চলাচল। তবে ২০১৪ সালে এসে লাইনের সমস্যা জনিত বেশকিছু দুর্ঘটনা ও ব্যবস্থাপনা জটিলতার কারণে আবারও ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
একদিকে একটি দেশের শতাব্দী প্রাচীন পুরনো ঐতিহ্য রক্ষার প্রশ্ন, অন্যদিকে ঐতিহ্যের নামে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও একটি মাত্র ঘোড়া দিয়ে ২০ জনের বেশি যাত্রী টানার মতো পরিবহন ব্যবস্থা চালু থাকা কতোটা মানবিক- এনিয়ে প্রচলিত চলছে নানা বিতর্ক।