সাড়ে তিন কোটি বছর আগে বানরদের সমুদ্রযাত্রা!

পেরুর আমাজন জঙ্গলে একগুচ্ছ দাঁতের ফসিল খুঁজে পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। আজ থেকে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন বা সাড়ে তিন কোটি বছর পুরোনো এই দাঁতগুলো নিয়ে গবেষণা করে তারা বলছেন, বিরাট এক প্রাকৃতিক ভেলায় চড়ে আফ্রিকা থেকে আটলান্টিক সমুদ্র পেরিয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় এসেছিল বিলুপ্ত এক প্রজাতির বানর।
তখন আটলান্টিক মহাসাগর একটা সরু সমুদ্র ছিল। প্রাগৈতিহাসিক উকায়ালিপিথেকাস পেরডিটা প্রজাতির বানরগুলো খুব সম্ভবত সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলগুলো থেকে গ্রীষ্মকালীন ঝড়ে ভেঙ্গে আসা বড় একটুকরা স্থলভূমিতে করে পেরিয়ে এসেছে ৯০০ মাইলেরও বেশি।
ধারণা করা হচ্ছে যে, এই উকায়ালিপিথেকাসরা আকারে বেশ ছোটখাটই ছিল। কেননা তাদের সেই স্থলভূমির ভেলায় যে ধরনের এবং যে পরিমাণ খাবার জন্মাতো, তা বড় আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়।
গত বৃহস্পতিবার সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষনা প্রবন্ধটিতে এমন কথাই জানালেন প্রধান গবেষক ও সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কেক স্কুল অফ মেডিসিনের ক্লিনিকাল ইন্টিগ্রেটিভ অ্যানাটমিক্যাল বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. এরিক সিফার্ট।
সিফার্ট জানান, "এপর্যন্ত প্রাপ্ত জীবাশ্মের রেকর্ড থেকে আমরা জানি যে মহাসাগর পাড়ি দেওয়া বেশিরভাগ প্রাণীই আকারে ছোট ছিল। সম্ভবত খাবারের উৎসই এর কারণ।"
উকায়ালিপিথেকাস প্রজাতির বানর ছাড়া কেবলমাত্র দুটি প্রজাতির "অভিবাসী" স্তন্যপায়ী প্রাণীর হদিস পাওয়া যায়, যারা বিপদসংকুল আটলান্টিক পাড়ি দিতে পেরেছিল। তাদের একটি প্লাটিরাইন প্রাইমেটস বা নিউ ওয়ার্ল্ড মাংকি নামে পরিচিত। খাদা নাকবিশিষ্ট এই প্রাইমেটদের দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় আজও পাওয়া যায়। আর অন্য প্রাণীটি ছিল একধরনের ইঁদুর যা ক্যাভিওমর্ফ নামে পরিচিত, ক্যাপাইবারার মতো প্রাণীদের পূর্বপুরুষ।
কিন্তু দাঁত থেকে কি করে এই তথ্য জানা যায়
দাঁত প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট এর মতো কাজ করে। আমাদের এই গবেষক দল পেরুর আমাজনে ইউরুয়া নদীর বাম তীরে একটি খননের সময় এক গুহায় দাঁতগুলো খুঁজে পান।
জায়গাটার নাম উকায়ালি থেকে বানরটির এমন নামকরণ।
ধারণা করা হচ্ছে এই বানরটির ওজন ছিল প্রায় ৩৫০ গ্রাম (১২ আউন্স), যা দক্ষিণ আমেরিকার মারমোসেটদের আকারের সমান।
সিফার্ট জানান, দাঁতগুলো দেখে এদের প্যারাপিথিসাইডি নামে আফ্রিকার বিলুপ্ত এক প্রজাতির প্রাইমেটের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। এরা আজ থেকে প্রায় ২৩ মিলিয়ন থেকে ৫৬ মিলিয়ন বছর আগে মিশরে, লিবিয়া এবং তানজানিয়ায় বাস করত।
সিফার্ট বলেন, "যদি উকায়ালিপিথেকাস আর এই আফ্রিকান প্যারাপিথেসাইডি পরস্পর আত্মীয় হয় তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে এরা যথেষ্ট চঞ্চল, বেশ বড় লাফ দিতে পারতো। গাছেই বসবাস করতো এরা।
আর তাদের চোয়ালের দাঁতের গঠন দেখে বোঝা যায় এদের প্রধান খাবার ছিল গাছের ফল।
অভাবনীয় আবিষ্কার
কোটি কোটি বছর আগে কোনো প্রাণী এভাবে ভেলায় করে সমুদ্র পার হবে- বিষয়টা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না সিফার্ট আর তার দল। তবে পানামা খালে ভাসমান জমির টুকরো দেখে এই হাইপোথিসসিসটা আরও মজবুত হয়ে উঠল তার জন্য।
তিনি বলেন যে এই প্রাকৃতিক ভেলাগুলো ফল ধরে এমন খাড়া গাছগুলো টিকিয়ে রাখতে পারে।
তিনি বলেন, "ভেবে দেখুন, সাড়ে তিন কোটি বছর আগে কোনও ছোট্ট প্রাইমেট মাইলের পর মাইল এভাবে ভেলায় ভেসে চলে এসেছে অন্য মহাদেশে। এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বিবর্তনের লম্বা যাত্রা অসম্ভব নয় এদের পক্ষে"।
যে জায়গাটায় দাঁতের ফসিলগুলো পাওয়া গেছে সেটা পেরুর অ্যামাজন জঙ্গলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি নদীর তীরে ছিল, যেখানে কোনও রাস্তা নেই এবং সবকিছুই একটি ছোট বিমানে করে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসতে হয়।
'ব্যাপারটা যে কি অসম্ভব সেটা চিন্তা করেই অবাক হয়ে যাচ্ছি আমি', সিফার্ট বলেন।
'এই দুর্গম জায়গায় এমন ফসিল খুঁজে পাবার বিষয়টা রীতিমতো অভাবনীয়। আর প্রাগৈতিহাসিক এই বানরদের অবিশ্বাস্যকর সমুদ্রযাত্রা নিয়ে গবেষণা প্রকাশ করছি, এটাই সবচাইতে উল্লেখযোগ্য পাওয়া আমাদের জন্য।"