সবুজ পাহাড়ের রুপালি হ্রদে আশ্চর্য লঞ্চ যাত্রা
হঠাৎ রাঙামাটিতে বেড়াতে আসা যে কারো কাছেই বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হবে। পাহাড়ঘেরা সবুজ এই জেলার ১০টি উপজেলার মধ্যে ছয়টিতেই যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌপথ!
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ কৃত্রিম জলাধার 'কাপ্তাই হ্রদ'। ১৯৫৪ সালে কর্ণফুলি নদীর ওপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে রাঙামাটি জেলার ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি ডুবে এই হ্রদের সৃষ্টি হয়। জেলাজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে আছে এই হ্রদ।
অনিবার্যভাবেই জেলার পরিবহন ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে নৌচলাচল। স্থানীয় কাঠের তৈরি লঞ্চই জেলা শহর থেকে উপজেলাগামী মানুষের যাতায়াতের সবচেয়ে বড় নির্ভরতা।
লঞ্চের সঙ্গে যেভাবে জড়িয়ে রয়েছে জীবনযাত্রা
ষাটের দশকে প্রমত্তা কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। নদীর ভাটিতে দেওয়া বাঁধে ডুবে যায় নদী তীরবর্তী শহর রাঙামাটি। তৈরি হয় কাপ্তাই হ্রদ। প্রায় ৭০০ বর্গকিলোমটার আয়তনের এই হ্রদই পরবর্তীকালে হয়ে উঠে জেলা শহরের সাথে উপজেলার মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম।
বর্তমানে ছোটবড় প্রায় ৫৪টি লঞ্চের মাধ্যমে চলছে নৌচলাচল। জেলার ১০টি উপজেলার মধ্যে বরকল, জুরাছড়ি, বাঘাইছড়ি, লংগদু, নানিয়ারচর ও বিলাইছড়ি এই ছয় জেলায় যেতে চাইলে লঞ্চে চড়তে হবে।
এসব উপজেলার কয়েক লক্ষ মানুষ নৌযোগাযোগেই নির্ভর করেন। তবে ষাটের দশক থেকে নয়, এর বহু আগে থেকেই লঞ্চের সঙ্গে এই জনপদের সখ্যতা। বর্তমানের সড়ক যোগাযোগের আগে, ডুবে যাওয়া রাঙামাটি শহর থেকে লঞ্চে করেই চট্টগ্রামে যাতায়াত করতেন এখানকার পাহাড়বাসীরা।
কেমন চলছে রাঙামাটির লঞ্চ যোগাযোগ
রাঙামাটি শহরের রিজার্ভবাজারের লঞ্চঘাট থেকে প্রতিদিন সাতটি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে অন্তত ৩০টি লঞ্চ ছেড়ে যায়। সারাদিনের পরিবহন শেষে এই ঘাটেই লঞ্চগুলো ফিরে আসে।
এদের মধ্যে সবচেয়ে দূরের বাঘাইছড়ি যেতে সময় লাগে অন্তত সাত ঘণ্টা। এছাড়া বরকলে যেতে আড়াই ঘণ্টা, ছোট হরিণায় পাঁচ ঘণ্টা, জুরাছড়িতে আড়াই ঘণ্টা, লংগদুতে সাড়ে তিন ঘণ্টা, নানিয়ারচরে আড়াই ঘণ্টা এবং বিলাইছড়িতে তিন ঘণ্টার দূরত্বে যাওয়া-আসা করে অন্তত ৫৪টি লঞ্চ।
এর মধ্যে প্রায় নিয়মিতই ১৫-২০টি লঞ্চ ডকইয়ার্ডে থাকায় প্রতিদিন চলাচল করে অন্তত ৩০-৩৫টি লঞ্চ। আগে কাপ্তাই উপজেলা ও মাইচ্ছড়ি রুটে লঞ্চ চলাচল করলেও বর্তমানে সড়ক যোগাযোগ চালু হওয়ায় এই পথ দুটি বন্ধ আছে। তবে শীঘ্রই রাঙামাটি-ছোট হরিণা-ঠেগা রুটে লঞ্চ চলাচল চালুর কথা শোনা যাচ্ছে।
রাঙামাটির লঞ্চ চলাচলের সাথে জড়িত বিভিন্নস্তরের মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জেলায় অন্তত ৩০ জন মালিকের ৫৪টি লঞ্চ চলে এখানে। এদের মধ্যে প্রতিটি লঞ্চে গড়ে ৫ জন করে প্রায় ৩০০ সারেং, লস্কর, সুকানি ও মিস্ত্রি কাজ করেন।
মালিকদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১২টি লঞ্চ আছে হাজী গফুর এন্ড সন্স-এর অধীনে। এরপর হাজী ইউসুফ আলীর উত্তরাধিকারদের ৯টি, সাত্তার হাজীর ৯টি, খালেক কোম্পানির ৭টি,ফখরুদ্দিন আহমেদের ৬টি, মোনাফ ক্যাশিয়ারের ৪টিসহ বর্তমানে মোট ৫৪টি লঞ্চ আছে।
যেভাবে তৈরি হয় লঞ্চ
রাঙামাটির বিভিন্ন নৌরুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলো স্থানীয়ভাবেই তৈরি হয়। দীর্ঘদিন ধরেই এ কাজে নিয়োজিত স্থানীয় শ্রমিকরাই লঞ্চ নির্মাণ করেন।
প্রায় প্রত্যেকের নিজস্ব ডকইয়ার্ড রয়েছে। গাছের তৈরি বডিতে চায়না ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। একটি লঞ্চ তৈরিতে আনুমানিক ৭০ লাখ টাকা খরচ হয়। প্রতিটি লঞ্চ তিন বছর পর পর সংস্কার করতে হয় এবং আট বছর পর খোলনোলচে পাল্টে ফেলতে হয়। ছোট নৌরুট এবং যাত্রী পরিবহন কম থাকায় এই জেলার নৌরুটে স্টিলবডি ব্যবহার করা হয় না।
নিরাপদ নৌরুট
দেশের নানান প্রান্তে নৌপথে প্রায়ই দুর্ঘটনার খবর শোনা গেলেও রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ কেন্দ্রিক নৌরুটগুলোকে বেশ নিরাপদ বলা যায়। বড় কোনো দুর্ঘটনা এখানে ঘটে না বললেই চলে।
লঞ্চ মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সত্তরের দশকের শুরুর দিকে বৌদ্ধধর্মীয় গুরু বনভান্তের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা পুণ্যার্থীদের বহনকারী একটি লঞ্চ ডুবে শতাধিক নিহত হওয়া ছাড়া বড় কোন লঞ্চ দুর্ঘটনার খবর মেলেনি।
তবে আশির দশকে অস্থির পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র গেরিলা সংগঠন শান্তিবাহিনীর বোমা হামলা ও গুলির নিয়মিত শিকার ছিল যাত্রীবাহী এসব লঞ্চ।
প্রায়ই লঞ্চগুলোকে উদ্দেশ্য করে গুলি ও বোমা হামলা চালানো হতো। নানিয়ারচরের বুড়িঘাট, বাঘাইছড়িরর মাইল্যা এবং সুভলং চ্যানেলে এমন একাধিক হামলার ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অর্ধ শতাধিক লঞ্চ যাত্রী। সাধারণত সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর থেকে নামকরণ, নকশা অনুমোদনের পর বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ থেকে চলাচলের অনুমতি পায় এখানকার লঞ্চগুলো। গড়ে দেড়শ থেকে দুইশ যাত্রী পরিবহন করে এসব লঞ্চ।
ঝুঁকি বাড়ছে লঞ্চ ব্যবসায়
তবে ধীরে ধীরে কমছে রাঙামাটিবাসীর লঞ্চ নির্ভরতা। সড়ক যোগাযোগ চালু হওয়ায় বন্ধ হয়েছে কাপ্তাই ও মাইচ্ছড়ি নৌপথ। বিকল্প যোগাযোগ তৈরি হয়েছে নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি ও লংগদু উপজেলার সাথে। সেই সঙ্গে নৌপথেও লঞ্চের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে দ্রুতগামী স্পিডবোট। ফলে এই ব্যবসায় ঝুঁকি বাড়েছে, কমছে যাত্রী পরিবহন।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে লঞ্চগুলো নিজেদের পরিষেবার মানোন্নয়নের চেষ্টা করেছে। বসার স্থান ও ইঞ্জিনের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। চেষ্টা চলছে বেশ পরিপাটি ব্যবস্থা রাখার। তবুও বাস্তবতা বলছে, ধীরে ধীরে লঞ্চ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসছে মানুষ।
শুষ্ক মৌসুমের বিড়ম্বনা
লঞ্চনির্ভর এই জনপদে শুষ্ক মৌসুম ভোগান্তির নাম নিয়েই হাজির হয়। এপ্রিল থেকে জুলাই মাস অবধি হ্রদে পানি কম থাকায় লংগদু, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি এবং বিলাইছড়ি উপজেলা থেকে বেশ দূরেই লঞ্চগুলোকে থেমে যেতে হয়।
ফলে দীর্ঘপথ পাঁয়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয় মানুষকে। মালামাল পরিবহন মোটামুটি অসম্ভব হয়ে পড়ে। অথচ হ্রদের কিছু পয়েন্টে ড্রেজিং করা হলে লঞ্চ চলাচল মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে মানুষের দুর্ভোগ কমত।
পাশাপাশি বর্ষা মৌসুমে হ্রদে বিপুল কচুরিপানাও নৌপথে তৈরি করে দীর্ঘসূত্রতার বাধা।
যে পথ নির্ভরতার-ভালোবাসার
রাঙামাটি শহর থেকে বয়ে যাওয়া প্রতিটি নৌপথই বেশ দৃষ্টিনন্দন। সারি সারি পাহাড়ের ফাঁক গলে বয়ে যাওয়া কাপ্তাই হ্রদের নৌপথ যেন মায়াবী আবেশে জড়িয়ে থাকে। পুরো পথজুড়েই কখনো পাহাড়ি ঝরনা, কখনো হরিণ কিংবা অন্য কোনো বুনো প্রাণীর চলাচল যাত্রীদের মুগ্ধ করবেই। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে প্রতিটি পথই খুলে দিতে পারে পর্যটন সম্ভাবনার অপার দুয়ার।
রাঙামাটির প্রবীণ নাগরিক সংবাদকর্মী সুনীল কান্তি দে বলেন, 'রাঙামাটির মানুষের জীবন ও আবেগের সাথে মিশে আছে এসব লঞ্চ। স্বাধীনতার আগে ও পরে এই লঞ্চ নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থাই এখানকার মানুষের আজকের সমৃদ্ধির মূল ভীত গড়ে দিয়েছে। মূল শহর থেকে দূর পাহাড়ের বিভিন্ন উপজেলায় যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল এসব লঞ্চ। আজ হয়তো নানান বিকল্প তৈরি হয়েছে, কিন্তু এককালে লঞ্চ ছাড়া কোনো বিকল্পই ছিল না। এখনো অধিকাংশ জনপদের মানুষের নির্ভরতা লঞ্চেই।'
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থার রাঙামাটি জোনের চেয়ারম্যান ও লঞ্চ মালিক মঈনুদ্দিন সেলিম বলন, 'এই অঞ্চলের মানুষের আবেগ আর বেঁচে থাকার বিরাট একটি অংশজুড়েই আছে লঞ্চসেবা। আমাদের পূর্বসুরীদের মতো আমরাও চেষ্টা করছি যতদিন প্রয়োজন, ততদিন এই সেবা দিয়ে যাওয়ার। সময় পাল্টেছে, বিকল্প নানান মাধ্যম তৈরি হয়েছে, সড়ক হচ্ছে, সেতু বসছে, হয়ত একদিন লঞ্চ সার্ভিসও আর থাকবে না। তবে এই জনপদের মানুষের জীবন আর স্মৃতিতে লঞ্চ থাকবেই।'