সবুজের বনসাই যাচ্ছে ভারত, মালয়েশিয়া
ছোটবেলা থেকেই গাছের প্রতি বাড়তি আগ্রহ ছিল বনসাই শিল্পী কে এম সবুজের। ১৯৯৬ সালে সিলেটে গিয়ে এক নার্সারিতে একটি বনসাই দেখেন। সেখান থেকে কয়েকটি চারা কিনে শুরু করেন বনসাই চাষ। এখন তার বাগানে এক হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের বনসাই রয়েছে।
এরই মধ্যে তার সৃজন বনসাইয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে মালয়েশিয়া ও ভারত। রপ্তানি হচ্ছে অন্তত ২০ লাখ টাকার বনসাই। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগ্রহী তরুণরা বনসাই সংগ্রহের পাশাপাশি বেকারত্ব ঘোচাতে নিচ্ছেন নানা প্রশিক্ষণ।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, শৈল্পিক এ বনসাই শিল্পে সরকার পৃষ্ঠপোষকতা দিলে অনেক বেকারের কর্মসংস্থান হবে।
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার চর পাথালিয়া গ্রামের কে এম সবুজ। পুরো নাম খান মুহাম্মদ সবুজ। থাকেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আমবাগ পশ্চিমপাড়া এলাকায়। সেখানেই এক বিঘা জমিতে তার স্বপ্নের বনসাইয়ের বাগান।
দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি বনসাই তৈরি করছেন। তার হাতে তৈরি লাখ লাখ বনসাই ছড়িয়ে আছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে। ইতিমধ্যে মালয়েশিয়ায় বরই, কৃষ্ণচূড়া, বাবলা ও নিমগাছসহ বেশ কিছু বনসাই তিনি বিক্রি করেছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।
মাত্র ১০০ টাকার বিনিয়োগ ২৪ বছরে এখন এক কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে তার কাজে স্ত্রী, মা, শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই সহযোগিতা করেন। দিন দিন বাড়ির ছাদ ছাড়াও জমিতে বনসাই বাগান সম্প্রসারিত হয়েছে। বাগানে কাজ করছেন ১২ জন শ্রমিক। বেশ কয়েকটি একক বনসাই প্রদর্শনীতে তার বনসাই আলোচিত হয়। ইতোমধ্যে পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী পদক।
ভারত ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানি
কে এম সবুজ প্রতি বছর অন্তত ২০ লাখ টাকার বনসাই ভারত ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করেন। তিনি জানান, তার রপ্তানি করা বনসাই গাছ ক্রেতারা প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে যান। সেখানে জাহাজে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে কসট্রিপ মুড়িয়ে টবে রাখা হয়।
পরে গাছগুলো জাহাজ থেকে নামিয়ে হরমোন দিয়ে ফের টবে রাখা হয়। এই প্রক্রিয়ায় সেখানে বনসাই থেকে নতুন পাতা গজায়।
শুরুর গল্প
ঘটনাটি ১৯৯৬ সালের গোড়ার দিকে। সিলেট শহরে এক নার্সারিতে একটি বনসাই দেখেন তিনি। বাসায় ফিরে ভাইয়ের কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে চারটি তেঁতুলের চারা কিনে বনসাই চর্চার যাত্রা শুরু করেন।
পৈতৃক ভিটা গজারিয়া হলেও তার পুরো পরিবার ঢাকায় থাকে অনেক আগে থেকেই। পড়াশোনার পাশাপাশি বাসার ছাদ, বারান্দা ও আঙিনা একসময় ভরে যায় বনসাইয়ে। কিন্তু লাভবান হতে পারছিলেন না। এরই মধ্যে ১০-১২ বছর চলে যায়। পরিবারের সদস্যরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন।
পরিবার থেকে এক পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান সবুজ। ঠিক সে সময়ই একটা বনসাই ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করে বদলে যায় তার ভাগ্যের চাকা। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
পরিবারের কাছে আবার ফিরে যান। তাদের কাছে বেড়ে যায় সবুজের কদরও। বড় পরিসরে নতুনভাবে শুরু করেন বনসাই উৎপাদন। এরই মধ্যে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে ফেলেন। প্রশিক্ষণ নেন মালয়েশিয়ার রেডিয়েন্ট, ভারতের সার্ক কালচার ও চীনের ঘুঞ্জু লায়ান ডিস্ট্রিক নার্সারি এবং সিঙ্গাপুরের চায়না গার্টেন থেকে।
সবুজ জানান, শখের বশে বনসাই করা শুরু হলেও এখন বাণিজ্যিকভাবে বনসাই বিক্রি করে ভালো আয় হচ্ছে তার। নতুন সম্ভাবনাময় বনসাই শিল্প তরুণদের মধ্যে বেশ আগ্রহ তৈরি করেছে। তার বাগানে ৪৫০ প্রজাতির ২০ হাজারের বেশি বনসাই রয়েছে।
প্রতি বছর ভারত ও মালয়েশিয়ায় ২০ লাখ টাকার বনসাই রপ্তানি করা হয় এবং দেশে অন্তত ২৫ লাখ টাকার বনসাই বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডেকোরেশনের কাজ ছাড়াও সৌখিন লোকজন তার বনসাই কিনছেন। সব মিলিয়ে এখন কোটি টাকার ওপর মূলধন রয়েছে বলে জানান তিনি।
এ ছাড়া কাজের স্বীকৃতি হিসেবে গত বছর ২০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিশ্ব পরিবেশ দিবস, পরিবেশ মেলা ও বৃক্ষরোপণ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তাকে বৃক্ষ সংরক্ষণ, উদ্ভাবন ও গবেষণা ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রদান করেন।
সবুজ জানান, ছোট আকৃতি হওয়ায় বনসাই বাসা-বাড়ির যেকোনো জায়গায় মানানসই। গাছের কাছে থেকে সময় কাটানোর আগ্রহ থেকেই করপোরেট হাউসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কদর বেড়েছে বনসাইয়ের। তবে বাড়িতে আগ্রহী যে কেউ নিজেই এই শৈল্পিক বনসাই তৈরি করতে পারবেন। এ জন্য কিছু নিয়ম ও কলাকৌশল জানতে হবে। আর এসব কলাকৌশল রপ্ত ও প্রশিক্ষণ নিয়ে বনসাই তৈরির জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছেন তরুণ ও উদ্যোক্তারা।
তিনি জানান, বনসাই নিয়ে সরকারের কোনো নীতিমালা নেই। সম্পূর্ণ বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেই দেশে চলছে বনসাই শিল্প। তবে ক্রমবর্ধমান চাহিদা থাকায় বনসাইয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই বনসাই শিল্পী।
ইতোমধ্যে তার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় হাজার খানেক বনসাই তৈরি করেছেন জেলার সালনা এলাকার তসলিম নামে এক তরুণ।
তসলিম বলেন, 'প্রায় এক বছর সবুজের কাছে বনসাই নিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। শুরুতে বনসাই তৈরির কলাকৌশল রপ্ত করি। পরে ফাইকাস (বট) জাতীয় বৃক্ষ নিয়ে বনসাই করা শুরু করি। বর্তমানে আমার এখানে ছয় শতাধিক বনসাই রয়েছে, যার মধ্যে আছে ১০৩ প্রজাতির ফাইকাস। এরই মধ্যে বনসাই তৈরিতে প্রায় তিন লাখ টাকা ব্যয় করেছি, গাছগুলোর যত্ন নিচ্ছি।'
ক্রেতাদের সন্তুষ্টি
কে এম সবুজের বনসাই নিয়ে আগ্রহ রয়েছে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের। সুস্থ্য সবল গাছ, সতেজ ও রোগমুক্ত পাতা এবং ক্রেতাদের ঘরে বনসাই রাখার নানা নিয়ম-কানুন নিজেই বলে দেন সবুজ। আর এতে সন্তুষ্ট তার ক্রেতারা।
এ বিষয়ে ক্রেতা আজমির আহসান বলেন, 'বিভিন্ন বনসাই চারা আমার খুব পছন্দ। এরই মধ্যে আমি কে এম সবুজের কাছ থেকে ১০টি বনসাই নিয়েছি, যেগুলোর দাম তিন হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে। এর মধ্যে বট এবং ফোকেন টি নামের দুটি বনসাই আমি নিজের বাসার জন্য রেখেছি এবং বাকি বনসাই বিভিন্নজনকে উপহার দিয়েছি।'
'সবুজের উৎপাদিত বনসাই বেশ সতেজ, সুস্থ এবং সবল। এ গাছগুলো সহজে মরে না; তাই গাছগুলো নিয়ে আমি বেশ খুশি,' বলেন ওই ক্রেতা।