সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে খারাপ মাস্ক - কখন কোনটা পরবেন
বায়ুদূষণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে মহামারি পূর্ব সময়ে মাস্ক পড়তেন অনেক মানুষ। তবে পেশাগত দায়িত্ব পালন এবং জীবাণুর প্রতিরোধে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই ব্যবহার করতেন বেশি। কোভিড-১৯ মহামারির সেই মাস্কই এখন হয়ে উঠেছে অপরিহার্য, এবং প্রাণরক্ষার এক নির্ভরযোগ্য উপকরণ।
বাজারে বহুবিধ মাস্ক রয়েছে। এর সবগুলোই জীবাণুর বিরুদ্ধে সুরক্ষা নাও দিতে পারে। আবার কিছু মাস্ক দিতে পারে, বিশেষ কোনো পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় অন্যটির চাইতে বেশি সুরক্ষা।
ছোট্ট একটি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আপনি যে মাস্কটি ব্যবহার করছেন- তা আদৌ ফলদায়ক কিনা তা জেনে নেওয়া সম্ভব। মাস্কটি পরে ফুঁ দিয়ে একটি জ্বলন্ত মোমবাতি নেভানোর চেষ্টা করুন। ভালো মানের মাস্ক হলে এমনটা করা মোটেই সম্ভব হবে না।
নিয়মটি সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত না হলেও, অনেক সময় এর মাধ্যমে খুব বেশি সুরক্ষা দেবে না- এমন মাস্ক এড়িয়ে চলা সম্ভব।
গত এপ্রিলে প্রথম কাপড়ের তৈরি মাস্ক মার্কিন নাগরিকদের ব্যবহারের পরামর্শ দেয় যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র- সিডিসি। তখন থেকেই কোন ধরনের উপকরণে তৈরি মাস্ক বাতাস থেকে করোনার জীবাণু ছেঁকে ফেলতে বেশি কার্যকর হবে, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন দেশটির গবেষকরা।
একটি আদর্শ মাস্ক; হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে নিঃসৃত শ্বাসযন্ত্র নির্গত কণা যেমন আটকাতে পারে, ঠিক তেমনি এরোসল নামের বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্মকণাগুলোকেও ঠেকায়। আমরা যখন কথা বলি বা নিশ্বাস ছাড়ি তখন এসব সূক্ষ্মকণা তৈরি হয়।
কার্যকর মাস্কের আরও বেশকিছু বিশেষত্ব আছে। যেমন, এটি নাক ও মুখের চারপাশে ভালোভাবে বসে, বায়ুনিরোধী সিল তৈরি করবে। ফলে মাস্ক পরিধানকারী ব্যক্তির অন্যের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া বা তার মাধ্যমে অন্যদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
সঠিক পদ্ধতিতে মাস্ক পরা হলে, কিছু কিছু উপকরণের তৈরি মাস্ক অন্যদের চাইতে ভালো ফলাফল দিতে পারে। গবেষণায় এমন তথ্যই জানানো হয়েছে। সাম্প্রতিক ওই গবেষণা নিবন্ধের ওপর ভিত্তি করে নাক-মুখ ঢাকার এ আবরণের মধ্যে কোনটি কেমন তা জেনে নেওয়া যাক নিচের চার্ট থেকে:
চার্ট অনুসারে দেখা যাচ্ছে, এন-৯৫ শ্রেণির মাস্ক বড় আকারের শ্বাসগ্রন্থি নির্গত কণা আটকাতে ৯৯.৯৯% সফল। এরোসল বা আরও সূক্ষ্মকণা আটকে দেওয়ার ক্ষেত্রে যা ৯৫ শতাংশ। স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহারের জন্য এটিই সবচেয়ে উপযুক্ত।
সার্জিক্যাল মাস্ক বড় আকারের ৯৮.৫% কণা আটকায়। সূক্ষ্মকণা ঠেকানোর সক্ষমতা ৮৯.৫%। এটিও স্বাস্থ্য সেবাখাতের অবকাঠামোতে অবস্থানকালে সবচেয়ে উপযুক্ত আবরণ।
হাইব্রিড মাস্ক ঘরের বাইরে চলাচল এবং জনসমাগম স্থলে বেশি সুরক্ষা দেবে। বড় কণা আটকানোয় এর কার্যকারিতা ৯৬% এবং সূক্ষ্মকণা আটকাতে পারে ৯৪ শতাংশ।
তুলার তন্তু থেকে দুই স্তরের মাস্কও একইভাবে ঘরের বাইরে পরাটাই বেশি কার্যকর। বড় কণা আটকানোয় এর সক্ষমতা ৯৯.৫% এবং সূক্ষ্মকণার ক্ষেত্রে তা ৮২ শতাংশ।
অনেকে আবার রান্নাঘরের তোয়ালে বা ডিশ মোছার কাপড় দিয়ে তৈরি মাস্কও পরেন। এ ধরনের মাস্ক বাইরে পরা যেতে পারে, যা ৯৮% বড় কণা আটকাবে। সূক্ষ্মকণা আটকাবে ৭২.৫%।
তাছাড়া, শতভাগ তুলার তৈরি টিশার্ট দিয়ে তৈরি মাস্ক ঘরের বাইরে পরা যাবে। বড় ও সূক্ষ্মকণা আটকানোয় এর সক্ষমতা যথাক্রমে; ৯৭ ও ৫১ শতাংশ।
ঘরের বাইরে ছোটবড় দুই ধরনের বায়ুবাহিত কণা থেকে সবচেয়ে কম সুরক্ষা দেয় প্রাকৃতিক সিল্ক তন্তু থেকে তৈরি মাস্ক। উভয়ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা যথাক্রমে; ৫৬ ও ৫৪ শতাংশ।
অনেক সময় হাতের কাছে মাস্ক না পেয়ে অনেকে স্কার্ফ বা ব্যান্ডানা দিয়েও মুখ ঢাকছেন। কিন্তু, যারা ইচ্ছে করেই নিয়মিত এসব পড়ছেন, তাদের জন্য দুঃসংবাদ। বড় ও সূক্ষ্মকণা আটকাতে এ আবরণের সক্ষমতা মাত্র ৪৪ ও ৪৯ শতাংশ। নিতান্তই বাধ্য না হলে, ঘরে বাইরে সবখানে এগুলো না পড়ারই অনুরোধ করেছেন গবেষকরা।
এছাড়া, এয়ার ফিল্টার বা ভাল্ব যুক্ত মাস্ক, পরিধানকারীকে সুরক্ষিত রাখলেও তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তির জন্য- তা নিরাপদ নয়। এটি বড় ও সূক্ষ্ম কণা উভয়টি আটকাতেই ৯০% কার্যকর।
চার্টটি থেকে পাওয়া তথ্যগুলো সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ এবার জেনে নেওয়া যাক।
'ঘরে তৈরি উপকরণের মধ্যে হাইব্রিড মাস্কই সর্বোত্তম'
মাস্কের কাপড় যথাসম্ভব মুখমণ্ডলের সঙ্গে চেপে থাকতে হবে। সেলাইয়ের সময় এ বিষয়টি লক্ষ্য রাখা উচিৎ। এজন্যেই যেসব মাস্কের কাপড়ে বেশি সেলাইয়ের ফোড়ন থাকে, সেগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ানো কণা ছাঁকতেও ততবেশি সফল হয়।
মাস্কটির কাপড়ে একাধিক স্তরের বুনন থাকা উচিৎ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কাপড়ের তৈরি মাস্কে তিনটি স্তর রাখার পরামর্শ দিয়েছে। ভিতর বা নাক ও মুখের কাছাকাছি থাকা স্তরটি শ্বাসযন্ত্র নির্গত কণা শোষণ করবে। মধ্যস্তরের কাপড় ছাঁকনি হিসেবে কাজ করবে, আর বাইরের স্তরটি হতে হবে অশোসক উপাদান পলেস্টারের।
এন-৯৫ সবার সেরা কেন?
এন-৯৫ মাস্ক সর্বোত্তম কারণ এটি নাক ও মুখের চারপাশে নিখুঁত সিল তৈরি করে। ফলে ভাইরাসবাহী কণা ভেতর থেকে বাইরে বা বাইরে থেকে ভেতরে আসার সুযোগ পায় না। তাছাড়া, বায়ুবাহিত জীবাণু ছাঁকতে এতে ব্যবহৃত হয় কয়েক স্তরের ভাজ করা ফাইবার। সূক্ষ্মকণা আটকাতে ৯৫ শতাংশ সক্ষমতার কারণেই এন-৯৫ নামকরণ।
ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা সূত্রে জানা গেছে, ব্যবহারকারী যখন কথা বলেন, তখন তার শ্বাসযন্ত্র নির্গত মাত্র দশমিক ১% বড় কণা এন-৯৫ মাস্ক থেকে বাইরে যেতে পারে। এজন্যেই বেশিরভাগ দেশে এটি স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহারের জন্য রাখা হয়।
সার্জিক্যাল মাস্কের কার্যকারিতা:
একবার ব্যবহারের পর ফেলে দিতে হয়, এমন সার্জিক্যাল মাস্ক তৈরি হয় বুনন না করা ফ্যাব্রিক দিয়ে। ২০১৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এটি ইনফ্লুয়েঞ্জা গোত্রের জীবাণুর সূক্ষ্মকণা ঠেকাতে বাড়িতে তৈরি মাস্কের কাপড়ের মতোই তিনগুণ বেশি কার্যকর। তবে বাতাসের গতি তুলনামূলক কম থাকা এবং ব্যবহারকারী হালকা পরিশ্রম করলেই কেবল এর কার্যকারিতা বজায় থাকে। ব্যবহারকারী হাঁপিয়ে উঠলে বা বেশি পরিশ্রম করলে, এই প্রতিরোধ অনেকটাই হ্রাস পায়।
বাজারে পাওয়া যাওয়া কোনো মাস্কই এপর্যন্ত এন-৯৫ বা সার্জিক্যাল মাস্কই সমান নিরাপত্তা দিতে পারে না। এমনকি ঘরে তৈরি কাপড়ের মাস্কও নয়।
গত এপ্রিলে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় অবশ্য বলা হচ্ছে, হাইব্রিড মাস্কে দুইয়ের অধিক স্তরে ৬ শতাধিক সেলাইয়ের ফোড়ন দিয়ে তার সঙ্গে রেশম, শিফন বা ফানেল কাপড় যোগ করা হলে- সূক্ষ্মকণা প্রতিরোধ ৯৪ শতাংশে উন্নীত হয়। প্রায় ৩শ' ন্যানোমিটার আকৃতির সূক্ষ্মকণা আটকে দিতে পারে এমন মাস্ক। আর ৩শ' ন্যানোমিটারের চেয়ে বড় কণা ছাঁকার ক্ষমতা উন্নীত হয় ৯৬ শতাংশে।
- সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার