সত্তরের ১২ নভেম্বরের ভয়াল ভোলা সাইক্লোন
পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাণঘাতী ঝড়ের তালিকা করেছে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা(ডব্লিউএমও)। তালিকার প্রথমেই পৃথিবীর প্রাণঘাতী ঝড় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশের উপকূলে সংঘঠিত ঝড় "সাইক্লোন ভোলা"। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ঝড়টি বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় কয়েক জেলায় আঘাত হেনে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের হিসেবে মৃত্যের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ। কিন্ত বিশ্ব গণমাধ্যম ও বেসরকারি হিসেবে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় ওই ঝড়ে। বহু বছর পর, ২০১৭ সালের ১৮ মে জাতিসংঘের আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) ওই ঝড়কে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতি ঝড় হিসেবে লিপিবদ্ধ করে।
ঝড়ের ভয়াবহতা তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির হিসেব প্রকাশ করতে গড়িমসি করলে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সংস্থা ক্ষয়-ক্ষতির প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করতে এগিয়ে আসে।
"সাইক্লোন ভোলা" ঝড়ের ৫ দিন পর ১৯৭০ সালের ১৮ নভেম্বর বৃটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন ছাপে। তাতে মৃতের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়: ডেথ টোল অফ ওয়ান মিলিয়ন অর্থাৎ মৃত্যুর সংখ্যা ১০ লাখ। আর পূরো উপকূলে ক্ষতি হয় ৮৬.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পদ।
এদিকে সদ্য প্রকাশিত হওয়া বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও ৭০ এর ১২ নভেম্বর ঝড়ে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় (পৃষ্ঠা ২৯৭) ।
সাইক্লোন ভোলার বাতাসের গতি ও জলোচ্ছ্বাসের তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। ১৯৬০ থেকে ২০১৭ সালের মে পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমানায় আঘাত হানা ঝড়ের সেই তালিকায় সাইক্লোন ভোলার বাতাসের গতিবেগ ঘন্টায় ২২৪ কিলোমিটার এবং এর প্রভাবে ১০-৩৩ ফুট জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের এই তালিকা থেকে আরো জানা যায়, ঝড় আঘাত করেছিল তখনকার পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশের ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা এবং চট্টগ্রাম জেলায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ ও প্রাণহানি হয় ভোলা জেলায়। অন্যদিকে আবহাওয়া বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়েদার ও হারিকেন সায়েন্স জানায়, ভোলার তজুমুদ্দিন উপজেলায় প্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
ঝড়ের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে পাকিস্তান সরকার তা প্রকাশে নীরব থাকে।
বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতিতে মিতালী ক্লাব নামের একটি সামাজিক সংগঠন ঝড়ের পর উদ্ধার, ত্রাণ কাজ, ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয় এবং বিদেশি সাংবাদিকদের তথ্য প্রদানের জন্য চালু করেছিল মিতালী ইনফরমেশন সেন্টার। এ সেন্টারের পরিচালক ছিলেন বর্তমান বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (ডরপ)র নির্বাহী পরিচালক এএইচএম নোমান।
তিনি জানান, নোয়াখালীর উপকূলীয় সব জেলাতেই ঝড় আঘাত হানে। বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি ছিল তার একটি । রামগতির (রামগতি-কমলনগর) চর আবদুল্লাহ, বড়খেরী, চরগাজী, চর রমিজ, চর আলগী, চর কাদিরা, চর বাদাম, চর ফলকন, চর কালকিনি ইউনিয়নে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। ক্লাবের উদ্যোগে এ জরিপ পরিচালিত হয়। সাইক্লোনের প্রভাবে ১০ থেকে ২০ ফুট পানিতে তলিয়ে যায় উপদ্রুত অঞ্চল। প্রবল স্রোতে ভেসে যায় বিপুল সম্পদসহ হাজার হাজার নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটি(সিপিপি)র রামগতি উপজেলা টিম লিডার মোঃ মাইন উদ্দিন খোকন জানান, চর আবদুল্লাহ ইউনিয়নের বেশির ভাগ মানুষই ঝড়ে প্রাণ হারায়। এছাড়া বড়খেরী, চর বাদাম, চর সীতা এবং চর কাদিরা ইউনিয়নেরও অর্ধেকের বেশি মানুষ মারা যায় ঝড়ের আঘাতে।
ভোলা সাইক্লোনের তীব্র ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ৩ দিন লড়াই করে বেঁচে ফিরেছিলেন, কৃষক আবদুল হক। আবদুল হকের বর্তমান বাড়ি লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার উত্তর চর লরেঞ্চ গ্রামে।
তিনি জানান, ওই দিন রামগতির চর কাদিরা ইউনিয়নের চর কাদিরা গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন পরিবারের সঙ্গে। তাদের বাড়ির ২৬ জন মানুষের মধ্যে তিনিসহ মাত্র ৩ জন বাঁচতে পেরেছিলেন। ঝড়ে পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন তারা। বাড়ি থেকে বহুদূরে জীবিত পাওয়া যায় তাদের। ঝড়ের পর আবদুল হক বাড়ির কোন চিহ্ন খুঁজে পাননি।
ঝড়ের কয়েক দিন পর আর্ন্তজাতিক সংবাদ সংস্থা বৃটিনের আইটিভি টেলিভিশন নেটওয়ার্ক এর টেমস টেলিভিশন ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যু নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে। সাড়ে ২৪ মিনিটের ওই ভিডিও প্রতিবেদনের মাঝামাঝিতে প্রতিবেদক দোভাষীর মাধ্যমে স্থানীয় কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সাক্ষৎকারের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন প্রায় শতাধিক লোক। দোভাষী তাদের মধ্যে কতজন তাদের স্বজন হারিয়েছে এমন প্রশ্ন করলে, প্রত্যেকে হাত উঠিয়ে জানায় তাদের স্বজন হারানোর কথা বলেন। এদের মধ্যে একজন বলেন, তিনি তার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে ৫৩ জনকে হারিয়েছেন। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ঝড়ে বিপুল প্রাণহানি ছাড়াও সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয় উপকূলের ২০ লাখ মানুষ।
সে সময়ের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটি (সিপিপি)'র কমলনগর উপজেলা টিম লিডার মোঃ শামছুদ্দোহা খোকন জানান, ঝড়ে তার আত্মীয়স্বজনের অনেকেই মারা যায়। তার বাবা গোলাম মোস্তফা মিয়াকে ১৫ দিন পর বরিশালের একখালে জীবিত ভাসতে দেখে স্থানীয়রা উদ্ধার করে। গোলাম মোস্তফা মিয়া ছিলেন রেড ক্রসের সদস্য।
ঘূর্ণিঝড়ের পর বঙ্গবন্ধুর গঠিত ত্রাণকমিটির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান কমলনগরের হাজী নুরুল ইসলাম জানায়, ঝড় থেমে যাওয়ার পর তাদের এক হুদয়বিদারক দৃশ্যের মুখে পড়তে হয়: তারা দেখেন চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ, লাশের গন্ধে মানুষের তেষ্টানো মুশকিল হয়ে পড়ে। ২০ ফুট জলোচ্ছ্বাসের কারণে কয়েক দিন পর্যন্ত মৃতদের মাটি দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে গণকবরে বেশিরভাগ মৃতের দাফন করা হয়। অনেকের লাশ আজও পাওয়া যায়নি।
"সাইক্লোন ভোলা"র মৃতদেহ উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মাস্টার মফিজ উল্লাহ। তিনি ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে জানান, ১২ নভেম্বরের পর কত লাশ উদ্ধার ও দাফন করেছি তার কোন হিসেবে নেই। শত শত লাশ কবর দিতে হয়েছে। ' এতবড় একটা সাইক্লোন পরবর্তী প্রাণহানি এবং ধ্বংসযজ্ঞের পর সরকারের কোনো উদ্যোগ ছিল না। কত বছর পেরিয়ে গেছে এখনও রাষ্ট্রীয়ভাবে এদিনকে স্মরণ করা হয় না।
মাস্টার মফিজ উল্লাহ আরো জানায়, ঝড়ের ২য় দিন পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাতিয়া হয়ে রামগতি এসেছিলেন। সে সময় তিনি আওয়ামীলীগের প্রার্থী সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য সিরাজুল ইসলামের জীপে চড়ে এখানকার কমলনগর উপজেলার চর লরেঞ্চ পর্যন্ত পরিদর্শন করে রামগতি ফিরে, ওখান থেকে ভোলা যান।
সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সত্তরের ঘূর্ণিঝড় ও ঐতিহাসিক নির্বাচন নামক একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ১৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া দুঃখী মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন। উপকূলীয় দুর্গত এলাকা ভোলা, রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ সফর শেষে হোটেল শাহবাগে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটির (সিপিপি) ওয়েবসাইটে ২৭ নভেম্বর উল্লেখ বঙ্গবন্ধুর সংবাদ সম্মেলন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
উপদ্রুত অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় কোন উদ্যোগ না থাকলেও বিভিন্ন সময় অনেক সংগঠনের উদ্যোগে ১২ নভেম্বরকে শোকের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। উপকূলে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন কোস্টাল জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক ২০১৭ সাল থেকে এদিনকে উপকূল দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ১৯ জেলায় পালন শুরু করেছে। সংগঠনটি এই দিনটিকে জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক ভাবে উপকূল দিবস ঘোষণা করার দাবি জানান।
কোস্টাল জার্নালিস্ট নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টু বলেন, ১২ নভেম্বরের ধ্বংসযজ্ঞকে কেন্দ্র করে উপকূলের জন্য একটি পৃথক দিবস থাকলে উপকূলবাসীর মধ্যে প্রাকৃতিক দুযোর্গ নিয়ে সচেতনতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল, সংবাদ মাধ্যম থেকে শুরু করে সকল মহলে উপকূল নিয়ে ভাবার সুযোগ বাড়বে। এর মধ্যদিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলের ঝুঁকির দিকগুলো এবং এ অঞ্চলের উন্নয়নের বিষয়গুলো সবার নজরে আসবে। সর্বোপরি জলবায়ু পরির্বতনের ফলে বাংলাদেশ যে ঝুঁকিতে আছে তা আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়কে বোঝানো সম্ভব হবে।'