শতবর্ষ ধরে যে গ্রামে মানুষ ও চিতাবাঘের পাশাপাশি বসবাস
বেরা। ভারতের রাজস্থানের একটি খেয়ালি আধা শহর, আধা গ্রাম। উদয়পুর ও যোধপুরের মাঝামাঝি এক রমরমা পর্যটন কেন্দ্রও। পাথুরে আরাভালি পর্বতের কোলে মনোমুগ্ধকর ল্যান্ডস্কেপ। তালপাতার ছাউনিতে গড়া কুঁড়েঘর আর ভুট্টা ও সরিষার ক্ষেতে ভরা প্রান্তর।
এ শহর ঘিরে রয়েছে অনন্য সব গাছগাছালি আর প্রাণীতে ভরা বন। এরমধ্যে রয়েছে ক্যাটকি, টাওয়ারিং কিকার ও পলাশ-সহ মরু অঞ্চলের বিভিন্ন গাছ। ঝোঁপের আড়ালে জীবন কাটায় হায়েনা, খরগোশ, শিয়াল ও বনবিড়ালের মতো প্রাণী।
পক্ষীবিজ্ঞানীদের জন্যও বেরা একটি স্বপ্নের গ্রাম। এখানে দুই শতাধিক প্রজাতির পাখির বসবাস। এরমধ্যে রয়েছে চাতক, ধূসর পায়ের রাজহংসী, চড়ুই, সারস ও ভারতীয় তিতির। হনুমান ও ময়ূরেরও দেখা মেলে হুটহাট।
অন্যদিকে, ১৫ ফুট দৈর্ঘ্যের কুমির ভেসে বেড়ায় জাওয়াই নদীর পাড়ে যোধপুরের সাবেক মহারাজা উমাইদ সিংয়ের গড়া জাওয়াই বাঁধে।
তবে এই গ্রামকে সত্যিকার অর্থেই অনন্য করে তুলেছে যে ঘটনা, তা হলো- পৃথিবীর বুকে এটিই সম্ভবত একমাত্র প্রাকৃতিক পরিবেশ, যেখানে ভারতের সবচেয়ে আতঙ্কজনক শিকারি প্রাণীগুলোর একটির সঙ্গে এক শতাব্দীরও বেশিকাল ধরে প্রতিবেশীর মতো জীবন কাটাচ্ছে মানুষ।
'চিতাবাঘের গ্রাম' নামে পরিচিত বেরায় রয়েছে এই গ্রহে এ প্রাণীর সবচেয়ে বড় সমাবেশ। এখানকার কাঁটাযুক্ত ছোট ছোট ঝোঁপে অন্তত ৯০টি চিতা বাঘের বাস। প্রায় হাজার বছর আগে ইরান থেকে আফগানিস্তান হয়ে রাজস্থানে পাড়ি জমানো রাখাল জনগোষ্ঠী রাবারির সঙ্গে বেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ওই বাঘগুলোর।
এখানে এ গোত্রের দীর্ঘকায় ও কোমলদেহী আদিবাসী পুরুষেরা গরু ও ভেড়ার পাল চড়ান। তাদের গায়ে থাকে সাদা ধুতি, লাল পাগড়ি ও রুপালি মাদুলি। কাঁধে লম্বা ছড়ি। তাদের অধিকাংশের মুখেই দীর্ঘ গোঁফ খেলা করে; সেগুলোকে তারা বেশ সৃজনশীল তরিকায় পাকিয়ে রাখেন।
'রাবারি' শব্দের আভিধানিক অর্থ- 'বহিরাগত'। পশুপালন ও ভ্রমণের মধ্যেই জীবন কাটানো যাযাবরদেরও বোঝানো হয় এই শব্দের মাধ্যমে। হিন্দু দেবতা শিবের অনুগত হিসেবে (পরনে চিতাবাঘের চামড়া- এই রূপেই সবসময় তাকে ফুটিয়ে তোলা হয়), এর উৎসের খোঁজে এই গোত্র হিমালয়ের ছুটে বেড়ায়। তাদের বিশ্বাস, তারা শিব ও পার্বতীর সৃষ্টি।
রাবারিরা বলেন, শিব ও তার পত্নী পার্বতী যখন লেক মনসরোবরের কাছে কৈলাশ পাহাড়ে থাকতেন, তখন নিঃসঙ্গতায় তারা মানুষের সঙ্গ পেতে আকুল হয়ে উঠেছিলেন। পার্বতীই তখন শিবের কাছে আকুতি জানান। আর এভাবেই পৃথিবীতে রাবারিদের আবির্ভাব।
২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্যমতে, বেরা অঞ্চলে প্রায় ১১ হাজার রাবারির বসবাস। 'ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের সম্প্রদায় উট পালত, তবে আজকাল আমরা ভেড়া ও ছাগলও পালন করি,' বলেন ৬৫ বছর বয়সী মাঙ্গতা রাম। 'আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষেরা পরস্পরের সঙ্গে বেশ নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে থাকি; সবাই সবাইকে চিনি। নিজেদের পোশাক-আশাক, পুরাণ, ইতিহাস ও বংশানুক্রমিক ঐতিহ্যের মূল্য আমাদের কাছে সবার ওপরে।'
স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই গোত্রের সঙ্গে চিতাবাঘের সহাবস্থানের নেপথ্যে রয়েছে একটি গভীর আধ্যাত্মিক সংযোগ।
'রাবারিরা অভিভাবকতুল্য দেবতা হিসেবে পশুদের মান্য ও পূজা করেন,' বলেন বেরার সাফারি কোম্পানি জাওয়াই ওয়াইল্ড ক্যাম্পের মালিক দিলীপ সিং দেওরা। 'চিতাবাঘ কোনো রাবারির প্রাণ কেড়ে নিলে এই গোত্রের লোকেরা ওই শিকারী প্রাণীকে বাধা দেন না। তাদের বিশ্বাস, নিজের প্রতি উৎসর্গকৃত এই প্রাণবলির বিনিময়ে শিব তাদের পালিত পশুর সংখ্যা বাড়িয়ে দেবেন এবং তাদের পুরস্কৃত করবেন।'
চারপাশে ছড়িয়ে থাকা দেবি মন্দিরগুলোতে ওই শিকারি প্রাণীগুলোর অবাধ বিচরণ। বেড়ার ১০-১২টি গ্রামে ছড়িয়ে রয়েছে এমন অনেক মন্দির। 'গ্রামের মন্দিরে চিতাবাঘের এমন বিচরণ অনেক পর্যটককে বিস্মিত করে; সেই পরিবেশেই পুরোহিতকে দৈনন্দিন আরাধনা করতে দেখা তারা রীতিমতো চমকে যান,' হাসি মুখে বলেন দেওরা। 'তবু, বেরার প্রাত্যহিক জীবন বরাবরই এমন।'
চিতাবাঘের সংখ্যা দিন-দিন বাড়তে থাকায় স্থানীয় সাফারি প্যাকেজগুলো একটা সুনিশ্চিয়তা দিতেই পারে: 'চিতাবাঘের দেখা না পেলে পয়সা ফেরত!' পর্যটকের সংখ্যা দিন-দিন বাড়ার পাশাপাশি এখানে বছরের পর বছর ধরে গবেষক ও পক্ষীবিজ্ঞানীদেরও দেখা মেলে।
এক শতাব্দীর অধিককাল হয়ে গেল, বেরায় কোনো মানুষের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি, শুধু এক শিশুকে একবার টেনে নিয়ে যাওয়া ছাড়া। এমনকি সেদিন ওই শিশুকে তক্ষুণি ছেড়ে দিয়ে, ঝোঁপের আড়ালে ফিরে গিয়েছিল সেই চিতাবাঘ।
মানুষ ও পশুর এমন সহাবস্থান এই শহরকে অনন্য করে তুলেছে। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বাঘ, বিশেষ করে চিতাবাঘ মানুষের ওপর আক্রমণকারী হিসেবেই পরিচিত। খাদ্যসংকট, আবাস দখল, নির্বিচারে অবকাঠামো নির্মাণ ও অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কারণে ওইসব অঞ্চল বাঘের জন্য অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।
ভারতে প্রায় ১৪ হাজার চিতা বাঘের বসবাস। দেশটির সব বণ্যপ্রাণীর মতো ওদেরও সুরক্ষার আইনি বিধান রয়েছে। তবে দিল্লি, বেঙ্গালুরু ও মুম্বাইয়ের মতো শহরগুলোর নগর বসতিতে চিতাবাঘের আক্রমণ ও মানুষ খুনের ঘটনা দিন-দিন বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ রমন তিয়াগি। 'এই পরিস্থিতি বেশ কিছু মানুষ-পশু সংঘাতের জন্ম দিয়েছে। যেমন ধরুন, উত্তরখণ্ডের পার্বত্য অঞ্চলে চিতাবাঘের সঙ্গে মানুষের সংঘাতের বেশ বড় ধরনের ইতিহাস পাবেন বন্যপ্রাণী অনুসন্ধানকারী জিম করবেটের লেখা বইপত্রে।'
বেরা অবশ্য এই ধরনের শত্রুতা থেকে মুক্ত। এ শহরের ঢেউ খেলানো গ্রানাইটের পাহাড়, সুবিস্তৃত মাঠ ও শীতল গুহাগুলো চিতাবাঘগুলোর জন্য সানন্দে জীবনধারনের সুব্যবস্থা করে রেখেছে। এ কারণে ২০০৩ সালে জাওয়াই ড্যাম'কে চিতা বাঘের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করতে পেরেছে সরকার। এর ফলে ওই ল্যান্ডস্কেপ ও চিতা বাঘের আবাস সুরক্ষা পেয়েছে বলে জানান ছয় বছরেরও বেশিকাল ধরে ওই শিকারি প্রাণীর ওপর তথ্যচিত্র তৈরিতে মগ্ন থাকা ওয়াইল্ডলাইফ ফটোজার্নালিস্ট ধীরাজ মালি।
তিনি মনে করেন, মানুষের উপস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে চিতাবাঘ। আর বছরের পর বছর ধরে শিকার প্রবণতা কমিয়ে নিজেদের সহজাত বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। 'এমনকি সাফারির সময়ও প্রাণীগুলোর সঙ্গে পর্যটকদের সংঘাতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি, যেখানে প্রতি বছর প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটে এ অঞ্চলে,' বলেন মালি।
রাবারিরা যদিও নিজস্ব পোশাক পরেন, তবু তাদের অনেকেই, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম ধীরে ধীরে এই যাযাবর গোষ্ঠীর জীবনচর্চা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ ভালো চাকরির সুযোগে বিভিন্ন শহরে চলে গেছেন; অন্যরা কাজ করছেন স্থানীয় পর্যটন ক্ষেত্রে।
'পর্যটন শিল্পকে রাবারিরা সব সময়ই স্বাগত জানান। কেননা, এর ফলে কৃষিকাজ ও পশুপালনের পাশাপাশি তারা বাড়তি উপার্জন করতে পারছেন,' বলেন দেওরা। 'পুরুষেরা ট্র্যাকার হিসেবে কাজ করেন এবং চিতাবাঘের দেখা পেলে হোটেলগুলোতে সতর্কবার্তা পৌঁছে দেন। কেউ কেউ প্রকৃতিবিদ হিসেবেও কাজ করেন; কেননা, ওই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য বেশ সমৃদ্ধশালী। কেউ কেউ গাইড হিসেবে নিজেদের জীবনধারা পর্যটকদের সামনে উপস্থাপনের দায়িত্বও পালন করেন। অন্যদিকে, নারীরা রাবারি খাবার ও রন্ধনসম্পর্কীয় গোপনীয়তা পর্যটক নারীদের সঙ্গে বিনিময় করেন। গৃহকর্মী ও রাঁধুনি হিসেবে হোটেলগুলোতে কাজ করেও কেউ কেউ জীবনে প্রথমবারের মতো উপার্জন করেন।'
জলবায়ু পরিবর্তন, অরণ্যনিধন ও নৃতাত্ত্বিক নানা কারণে পৃথিবীতে যখন মানুষ-পশু সংঘাত দিন-দিন বাড়ছে, তখন সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ সহকারে বিভিন্ন প্রাণীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক শক্তিশালী বার্তা দেয় বেরার কাহিনি।
- দ্য ন্যাশনাল [সংযুক্ত আরব আমিরাত] থেকে অনুবাদ: রুদ্র আরিফ