চশমাপরা হনুমানের বাঁচার লড়াই
রঙ-বেরঙের প্রাণীতে ভরপুর আমাদের দেশ। এই প্রাণিজগতের সুন্দর এক প্রাণী ‘চশমাপরা হনুমান’। দিনের পর দিন অন্যসব প্রাণীর মতো বিপন্ন হচ্ছে সুন্দর প্রাণীটিও। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বিপন্ন আর বাংলাদেশে মহাবিপন্ন চশমাপরা হনুমান। মহাবিপন্ন মানে হারিয়ে যাওয়ার শেষ ধাপ। তবে আশার কথা হচ্ছে, মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া, আদমপুর, পাথারিয়া ও সাগরনালবনসহ হবিগঞ্জের দুইটি বনে প্রায় ৪০০ চশমাপরা হনুমান প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে এখনো টিকে আছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একদল গবেষকের দুই বছরের গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. হাবিবুন নাহারের তত্ত্বাবধানে যুক্তরাজ্যের রাফর্ড ফাউন্ডেশনের আর্থিক অনুদানে একদল গবেষক মৌলভীবাজারের লাউয়াছাড়া, আদমপুর, পাথারিয়া এবং হবিগঞ্জের সাতছড়ি ও রেমা-কালেঙ্গা বনে দুই বছরব্যাপী (২০১৮- ২০১৯) বিপন্ন এই প্রাণীর সংখ্যা জরিপ করেছেন। জরিপে মহাবিপন্ন এই প্রাণীকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যের প্রথম ধাপ হিসেবে তাদের বর্তমান অবস্থা এবং কমে যাওয়ার কারণ নিয়ে গবেষণা চালানো হয়।
গবেষক দলের প্রধান তানভীর আহমেদ জানান, এ গবেষণায় সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের পাঁচটি বনে ৩৬টি ভিন্ন ভিন্ন দলে মোট ৩৭৬টি চশমাপরা হনুমান সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সাগরনাল বনেও চশমাপরা হনুমান পাওয়া গেছে। যদিও অনুদানের সীমাবদ্ধতার কারণে ওই বনে হনুমানের সংখ্যা জরিপ করা সম্ভব হয়নি। তবে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে ধারণা করা হচ্ছে, এই বনে তিন থেকে চারটি দলে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫টি চশমাপরা হনুমান থাকতে পারে। সুতরাং কেবল সিলেট বিভাগেই প্রায় ৪০০ চশমাপরা হনুমানের বসবাস।
তিনি আরও জানান, গবেষণা চলাকালে সবচেয়ে বেশি চশমা পরা হনুমানের দেখা মেলে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছাড়া জাতীয় উদ্যানে। সেখানে ১০টি দলে মোট ১২৬টি চশমাপরা হনুমানের দেখা মিলেছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পাথারিয়া সংরক্ষিত বন। এ গবেষণা থেকে বোঝা যাচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশে চশমাপরা হনুমানের সংখ্যা আগের ধারণার থেকে ভালো আছে। যদিও বিভিন্ন কারণে এ সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে।
গবেষক দলের সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাজ্যের ওয়ালস ইউনিভার্সিটির গবেষক এসপি গিটিন্স ও বাংলাদেশ বনবিভাগের বন্যপ্রাণিবিদ এ ডব্লিউ আকন্দের গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে চশমাপরা হনুমানের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩০০টি। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ফরিদ আহসান তার এমফিল গবেষণায় বাংলাদেশে এ হনুমানের সংখ্যা উল্লেখ করেছিলেন ১০৫০টি। কিন্তু ২০০৩ সালে ভারতের একটি রিপোর্টি বলা হয়, বাংলাদেশে চশমাপরা হনুমানের সংখ্যা ১০০টিরও কম; যার মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক হনুমানের সংখ্যা ৫০টিরও কম।
এর মানে দাঁড়ায়, তার আগের তিন প্রজন্মে (প্রতি প্রজন্ম ১০-১২ বছর) চশমাপরা হনুমানের সংখ্যা পৃথিবীব্যাপী ৫০ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যদিও ১৯৮২ এবং ১৯৮৪ সালের হিসাবের সঙ্গে বর্তমানের হিসাব মেলালে ২০০৩ সালে উল্লেখিত বাংলাদেশে চশমাপরা হনুমানের সংখ্যাকে ‘উল্লেখযোগ্যভাবে কম’ মনে করছেন গবেষকরা।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) কর্তৃক ২০১৫ সালে প্রকাশিত লাল তালিকা বইয়ে বাংলাদেশে চশমাপরা হনুমানের বর্তমান সংখ্যা উল্লেখ না করলেও বলা হয়, এই প্রজাতির সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং মহাবিপন্ন প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অন্যদিকে ২০০৮ সাল থেকেই চশমাপরা হনুমান পৃথিবীব্যাপী বিপন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে আইইউসিএন।
অন্যদিকে দেশে চশমাপরা হনুমানের সংখ্যা নির্ণয়ে আগে কখনোই মাঠ পর্যায়ে বিজ্ঞানভিত্তিক জরিপ চালানো হয়নি, তাই সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বাংলাদেশের কোনো বনে বর্তমানে কী পরিমাণ চশমাপরা হনুমান টিকে আছে, সে তথ্য সঠিকভাবে নিরুপনের জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। সিলেটে বিভাগে (মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ) এর অবস্থা ভাল থাকায় এখানেই প্রথম জরিপ চালানো হয়। তবে এসব বনেও আগের মত চশমাপরা হনুমান দেখা যায় না। নানা কারণেই এরা বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. হাবিবুন নাহার বলেন, চশমাপরা হনুমান কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো প্রাকৃতিক বনের পরিমাণ কমে যাওয়া। বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা তৈরি করে এবং গাছ কেটে বনকে ছোট ছোট খ-ে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে, যা চশমাপরা হনুমানসহ সকল বৃক্ষচারী প্রাণীদের জন্য হুমকিস্বরূপ।
চশমাপরা হনুমান কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে গবেষক তানভীর আহমেদ জানান, বিষয়টি মানবকেন্দ্রিক ও বেশ জটিল। বনভূমির পরিমাণ তো কমেছেই, সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও প্রাকৃতিক ফলজ বন কেটে কাঠের গাছ লাগানো হয়েছে। যার ফলে ওই এলাকার প্রাণীদের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে এবং তারা বনের বাইরে খাদ্যের খোঁজে লোকালয়ে চলে আসছে। অবৈধভাবে সংরক্ষিত বন থেকে নিয়মিত বাঁশ ও জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করা হয়। সেই সঙ্গে মৌলভীবাজারের আদমপুর, পাথারিয়া এবং সাগরনাল বনে অবৈধ শিকার ও বাণিজ্যের কারনে এ হনুমানের সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে।
এই সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া বৈদ্যুতিক লাইন জানিয়ে তানভীর আহমেদ বলেন, আমাদের প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ‘‘২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত লাওয়াছড়া, সাতছড়ি এবং পাথারিয়া বনে অন্য প্রাণীর পাশাপাশি মোট আটটি চশমাপরা হনুমান বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়। তার মধ্যে পাঁচটি ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বাকি তিনটি মারাত্মকভাবে আহত হয়। এখনই এদের রক্ষায় গুরুত্ব না দিলে একসময় এরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’’
চশমাপরা হনুমান প্রকৃতির জন্য খুবই উপকারি জানিয়ে তিনি বলেন, এদের খাদ্যের ৪৭ শতাংশ বিভিন্ন গাছের পাতা এবং ১৪ শতাংশ ফল ও বীজ। খাদ্য গ্রহণ শেষে ফলের বীজ বনের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যা মূলত বনকে নতুন জীবন দান করে। তাই এ হনুমান বিপন্ন হলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বনায়নের জন্য মারাত্মক হুমকি হবে।
বাংলাদেশে মোট পাঁচ প্রজাতির বানর, তিন প্রজাতির হনুমান, এক প্রজাতির করে নরবানর (উল্লুক) ও লজ্জাবতী বানর পাওয়া যায়। হনুমানগুলোর মধ্যে অন্যতম সুন্দর হনুমান হচ্ছে ‘চশমাপরা হনুমান’। এদের চোখের চারপাশে গোলাকার বৃত্তের মতো সাদা রং থাকে বলে এদের ‘চশমাপরা’ হনুমান বলে। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের বেশকিছু চিরহরিৎ বনে এদের বসবাস।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, লাওস ও ভিয়েতনামে এ হনুমান দেখা যায়। ঘন চির সবুজ বনের এ বাসিন্দা দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে। প্রত্যেক দলে চার থেকে ২৬টি করে হনুমান থাকে। দলের নেতৃত্বে থাকে একজন শক্তিশালী পুরুষ। পুরুষটিই প্রজনন বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করে। নারী হনুমানের প্রাপ্তবয়স্ক হতে তিন থেকে চার বছর সময় লাগে। গর্ভধারণের সময়কাল ২০৫ দিন। সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাসে একটি করে বাচ্চা দেয় এবং এক বছর ধরে লালন পালন করে। অনেকটা নিঃশব্দে চলাচল করা এ প্রাণী বিপদের সম্মুখীন হলে ভয়ঙ্কর শব্দ করে, যা অ্যালার্ম কল নামে পরিচিত। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন গাছের পাতা, ফল, ফুল ও পোকামাকড়।
এ বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) আবদুল ওয়াদুদ জানান, বনের ভেতরের রাস্তাঘাট নিয়ে আমরা এরই মধ্যে সড়ক ও জনপথসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছি। সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এত সতর্কতার মধ্যেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে চোরাকারবারিরা যে সক্রিয় নেই তা বলা যাবে না, তবে আমরা আমাদের স্বল্প জনবল নিয়েও আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।