রিকামবেন্ট বাইসাইকেল: এই বাহনের কথা কি আমরা জানি?
ভেলোসিপিড—আধুনিক বাইসাইকেলের পূর্বপুরুষ। দুচাকার এই কাঠের যন্ত্রে প্যাডেল থাকত না, চালাতে হতো মাটিতে পা দিয়ে ধাক্কা মেরে। ভেলোসিপিডের জন্ম ফ্রান্সে, ১৮০০ সালের দিকে।
তারপর অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভেলোসিপিড থেকে জন্ম নেয় বাইসাইকেল, ১৮৮৫ সালের দিকে। আর অভিবক্ত বাংলায় এই দ্বিচক্রযানটির আগমন ১৮৮৯ সালে। ভারতবর্ষে আধুনিক বাইসাইকেলের প্রবক্তা বাঙালি ব্যবসায়ী হেমেন্দ্রমোহন বোস।
কলকাতায় বেশ মাতামাতিও শুরু হয় বাইসাইকেল নিয়ে। উনিশ শতকের শেষ দশকে সাইকেল রীতিমতো ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। সাইকেল নিয়ে মাতামাতি তুঙ্গে পৌঁছে, ১৮৯৭ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল সাইক্লিস্ট অ্যাসোসিয়েশন।
যাহোক, আমাদের লেখার বিষয় বাংলার সাইকেলেতিহাস নয়। আজকের লেখার বিষয় একটি বিশেষ জাতের সাইকেল, যার নাম রিকামবেন্ট বাইসাইকেল।
রিকামবেন্ট বাইসাইকেল চালাতে হয় হেলান দিয়ে বসে। এর গতি সাধারণ সাইকেলের চেয়ে বেশি। অনেকের কাছে এই সাইকেল চালানো বেশি আরামদায়কও মনে হয়। কিন্তু তারপরও রিকামবেন্ট সাইকেল আজকাল দেখা যায় না বললেই চলে। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ফিরে যেতে হবে একশো বছর পেছনে।
'সেফটি বাইসাইকেল', এখন যা শুধু 'বাইসাইকেল' নামে পরিচতি, প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল ১৮৮৫ সালে, জন স্টেয়ারলির হাত ধরে। সেফটি সাইকেলে চাপা ছিল তুলনামূলক সহজ ও নিরাপদ। এর গতিও ছিল পূর্বসূরিদের চেয়ে বেশি। আবির্ভাবের কিছুদিনের মধ্যেই নারী ও কর্মজীবী শ্রেণির কাছে সেফটি বাইসাইকেল হয়ে ওঠে যাতায়াতের ও ঘুরতে বেরোনোর জনপ্রিয় বাহন।
এর কদিন পরই, ১৮৯০-এর দশকে, বাজারে আসে গিয়ারযুক্ত রিকামবেন্ট বাইসাইকেল। একে 'নরমাল বাইসাইকেল'ও বলত অনেকে, কেননা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে থেকেই এই সাইকেল চালানো যেত। পরের দশকগুলোতে কয়েক রকমের রিকামবেন্ট সাইকেল বের হয়। কিছু সাইকেলে রকিং চেয়ারের মতো বসে থাকা যেত তো কিছু সাইকেলে বসে থাকা যেত সোফার মতো।
১৯৩০-এর দশকে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা পায় রিকামবেন্ট সাইকেল। বিশেষ করে ইউরোপে এর জনপ্রিয়তা চড়চড় করে বাড়তে থাকে। ১৯৩৩ সালে আর্নেস্তো পেটাজোনি ভেলোকিনো নামের এক সেমি-রিকামবেন্টের পেটেন্ট করেন। অনেকটাই হুইলচেয়ারের মতো দেখতে এই সাইকেলের সামনের চাকার ব্যাস ছিল ১০ ইঞ্চি। এর হ্যান্ডেলবার উল্টো দিকেও ঘোরানো যেত। এই প্রকল্পটি অনেকের নজর কাড়লেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাতিল হয়ে যায়।
১৯৩০-এর দশকের সবচেয়ে সফল ও প্রভাব বিস্তারকারী রিকামবেন্ট ছিল চার্লস মোকেটের ভেলো-ভেলোকারস। এটি ছিল বেশ গতিশীল সাইকেল। এই বাইসাইকেলের গতির কারণে আন্তর্জাতিক সাইকেল অ্যাসোসিয়েশন (ইউসিআই) বাইসাইকেলের সংজ্ঞা বেঁধে দিতে বাধ্য হয়। এর পরোক্ষ উদ্দেশ্য ছিল রিকামবেন্টের নাম সাইকেলের তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলা।
১৯৩৪ সালে ইউসিআইয়ের কমিটি রেসিং বাইকের সংজ্ঞা প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বটম বাকেট ১০ সেন্টিমিটারের চেয়ে বড় হতে পারবে না। এর ফলে কেবল সেফটি বাইসাইকেলগুলোই সাইকেল রেসে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।
এরপর ধীরে ধীরে কমে আসতে রিকামবেন্টের উৎপাদন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রিকামবেন্ট তৈরির হার আরও কমে যেতে থাকে।
তবে ১৯৭০-এর দশকে ফের জনপ্রিয়তা ফিরে পেতে থাকে রিকামবেন্ট সাইকেল। ১৯৭২ সালে এইচ ফ্রেডেরিক উইল্কি ছোট চাকার রিকামবেন্ট তৈরির উদ্যোগ নেন। তাদের সংশোধিত রিকামবেন্ট অনেকেরই নজর কাড়ে।
তবে কোনো রিকামবেন্ট সাইকেলই আজতক সর্বস্তরে জনপ্রিয়তা কুড়াতে পারেনি। এর প্রধান কারণ এই সাইকেলের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা। উদাহরণস্বরূপ, অধিকাংশ রিকামবেন্টের সিটই বসার জন্য আদর্শ ছিল না, যদিও বর্তমানে এই ত্রুটি অনেকটাই সারিয়ে আনা হয়েছে।
২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে হরেক আকারের হরেক গড়নের রিকামবেন্ট সাইকেল আসে বাজারে। আধুনিক রিকামবেন্ট পুনরুজ্জীবনের সুতিকাগার যুক্তরাষ্ট্রে বড় চাকার সাইকেলই তখনও বেশি জনপ্রিয় ছিল। তবে ইউরোপে বড় চাকার রিকামবেন্ট দেখা যেত খুবই কম। রিকামবেন্ট সাইকেলের জন্য আদর্শ জায়গা ছিল নেদারল্যান্ডস।
একুশ শতকের সিংহভাগ রিকামবেন্ট তৈরি হয়েছে তিন ধরনের আরোহীকে মাথায় রেখে—লম্বা, মাঝারি ও খর্বকায়।
রিকামবেন্ট বাইসাইকেলের জনপ্রিয় হতে না পারার একটি কারণ হলো, অধিকাংশ মানুষই প্রথাগত রাইডিং পজিশনে বসে সাইকেল চালাতে অভ্যস্ত। আরেকটি কারণ হচ্ছে, সিংহভাগ মানুষের ধারণা, যানবাহনের ভিড়ে রিকামবেন্ট সাইকেল ঠিকমতো চোখে পড়ে না। ফলে সাধারণ বাইসাইকেলের চেয়ে রিকামবেন্ট চালানো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
তবে রিকামবেন্টের জনপ্রিয়তার পথে সবচেয়ে বড় বাধাটা হলো, এই সাইকেল কখনও বড় পরিসরে উৎপাদিত হয়নি। তাই আজও রিকামবেন্ট বিশেষ পণ্যই রয়ে গেছে, সর্বসাধারণের পণ্য আর হয়ে উঠতে পারেনি।