রিউগইয়ং হোটেল: বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিত্যক্ত ভবনের গল্প
১৯৮৭ সালে উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে শুরু হয় রিউগইয়ং হোটেলের নির্মাণ কাজ। ১ হাজার ফুট উচ্চতাসম্পন্ন পিরামিড আকৃতির এই সুউচ্চ ভবনটি ৩ হাজার কক্ষ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন।
নির্মাণকাজ শুরুর দুই বছর পরই হোটেলটি উদ্বোধন করার কথা থাকলেও, এখনো নির্মাণাধীন অবস্থায় পড়ে আছে।
১৯৯২ সালে পরিকল্পিত উচ্চতায় ভবনটি নির্মাণের পর নির্মাণকাজ ১৬ বছর বন্ধ থাকে। সেই সময়েই এই হোটেলের নাম হয়ে যায় 'হোটেল অব ডুম' বা ধ্বংসের হোটেল। হোটেলটিকে পরবর্তীকালে এলইডি লাইট দিয়ে সাজানো হয়।
বিভিন্ন সময় হোটেলটির নির্মাণকাজ শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বারবার কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
রিউগইয়ং হোটেলই বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিত্যক্ত ভবন।
স্নায়ুযুদ্ধের ফসল
যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত দক্ষিণ কোরিয়া ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত উত্তর কোরিয়ার মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধের অংশ ফসল এই রিউগইয়ং হোটেল। এই হোটেলের কাজ শুরুর আগের বছর দক্ষিণ কোরিয়ার একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরে বিশ্বের তৎকালীন সর্বোচ্চ উচ্চতার হোটেল নির্মাণ করে। দেশটির রাজধানী সিউলে তখন গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজনের তোরজোর চলছিল। পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ হতে শুরু করে দক্ষিণ কোরিয়ায়।
প্রত্যুত্তরে উত্তর কোরিয়া ১৯৮৯ সালে অলিম্পিকের পরিমার্জিত সমাজতান্ত্রিক সংস্করণ 'ওয়ার্ল্ড ফেস্টিভ্যাল অব ইয়ুথ অ্যান্ড স্টুডেন্টস' আয়োজন করে।
দক্ষিণ কোরিয়ার রেকর্ড নিজেদের করে নেওয়ার জন্য ফেস্টিভ্যাল শুরু হওয়ার আগেই হোটেলটি নির্মাণের পরিকল্পনা করে উত্তর কোরিয়া। তবে প্রকৌশলগত কিছু ত্রুটির কারণে সেই সময়ের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি।
কিন্তু ইতোমধ্যেই দেশটির সরকার আনুষঙ্গিক ব্যয় হিসেবে কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ করে ফেলে এ কাজে। এর ফলে দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতিতে চাপ পড়ে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর প্রয়োজনীয় সাহায্য ও বিনিয়োগও বন্ধ হয়ে যায়। অবধারিত অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে দেশটি। ভবনটির বাহ্যিক অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হলেও ১৯৯২ সালে ভবনটির উপরে একটি ক্রেন ঝুলন্ত অবস্থায়ই এর কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
পুনরায় নির্মাণকাজ
১৬ বছর বন্ধ পর হঠাৎ করেই ২০০৮ সালে মিশরীয় প্রতিষ্ঠান ওরাসকম নির্মাণকাজ শুরু করে।অবশেষে ভবনটির উপর ঝুলে থাকা ক্রেনটি সরানো হয়। কংক্রিটের ভবনটি গ্লাস ও ধাতব পাত দিয়ে সজ্জিত করা হয়।
ভবনটির রূপ বদলে দেওয়ার এই কাজে ১৮০ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়। ২০১১ সালে এই প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়। ২০১২ সালে জার্মান প্রতিষ্ঠান কেমপিনস্কি ঘোষণা দেয়, তাদের ব্যবস্থাপনায় রিউগইয়ং হোটেল আংশিকভাবে চালু হবে। তবে তার কয়েক মাস পরেই প্রতিষ্ঠানটি এই প্রকল্পের কাজ থেকে সরে আসে।
দুর্বল নির্মাণশৈলীর জন্য ভবনটির অবকাঠামো ত্রুটিপূর্ণ, বহুল প্রচলিত এই ধারণা আবারও জোরদার হয়। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, ২০১৩ সালে পিয়ংইয়াংয়ে ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণের কারণে ২৩ তলার একটি ভবন ভেঙ্গে পড়ে।
হোটেলটির ভবিষ্যৎ
২০১৮ সালে ভবনটিকে এলইডি লাইট দিয়ে সাজানো হয়। পিয়ংইয়াংয়ের বৃহৎ আলোক প্রদর্শনী কেন্দ্রে পরিণত হয় ভবনটি। উত্তর কোরিয়ার ইতিহাস ও রাজনৈতিক স্লোগান সমৃদ্ধ চার মিনিটের অনুষ্ঠানও প্রদর্শন করা হয়।
বিগত বছরগুলোতে হোটেলটির আশেপাশে বিস্তৃত আকারে কাজ শুরু হয়। নামের ফলক লাগানো হয় ভবনটিতে। হোটেলটি খুলে দেওয়া হবে কি না, এ নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়েছে।
তবে রিউগইয়ং হোটেল বর্তমানে কোরীয় উপদ্বীপের সর্বোচ্চ উচ্চতার ভবন নয়। ২০১৭ সালে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া সিউলের লোটে ওয়ার্ল্ড টাওয়ারের উচ্চতা রিউগইয়ংয়ের চেয়েও ৮০০ ফুট বেশি।
ব্যর্থতার এই বিব্রতকর অবস্থা এড়াতে উত্তর কোরিয়ার সরকার পিয়ংইয়াংয়ের দাপ্তরিক ছবি থেকে হোটেলটির ছবি সরিয়ে ফেলে।
তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নতুন করে এলইডি বাতির সাজসজ্জা কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাই নির্দেশ করছে।
- সূত্র: সিএনএন