মেজবান: ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির বন্ধন

এলাহী কারবার! খাবার নিয়ে চলছে কাড়াকাড়ি। কার আগে কে বসবেন তা নিয়ে চলছে হইচই। একদল খেয়ে উঠতে না উঠতেই আরেক দল চেয়ারের পেছনে এসে ঠাঁই দাঁড়িয়ে।
চট্টগ্রামের লাভ লেনের একটি কমিউনিটি সেন্টারে ঐতিহ্যবাহী মেজবান আয়োজনে করোনা মহামারি শুরুর আগে ২০২০ সালে দেখা গিয়েছিল এমনই দৃশ্য। খাতুনগঞ্জের জনৈক ব্যবসায়ী আহমদ উল্লাহ ৫,০০০ লোকের জন্য পারিবারিকভাবে এ মেজবান আয়োজন করেছিলেন।
বিয়ে-শাদী কিংবা ঘরোয়া আড্ডা। খাবার টেবিলে নানান পদের মেনুতে চট্টগ্রামের মেজবানের মাংস থাকা যেন বহু বছরের পুরোনো ঐতিহ্য। যারা খেতে ভালোবাসেন, তারা চট্টগ্রাম এসে মেজবানের মাংসের স্বাদ নেবেন না- এমনটি কখনই হয়নি।
গরম ভাত। সঙ্গে গরুর মাংস। মাংসের ভেতর কালো ভুনা চাই। ছোলার ডালে মেশানো হয় কিছু বাড়তি মাংস। কখনো হাড়। খাবার শেষে আবার গরুর নলা (পায়ের হাড়)।
চট্টগ্রামে ১৫৫টির বেশি কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে। যেখানে বছরজুড়েই স্বাভাবিক সময়ে মেজবানের আধিক্য থাকে বেশি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিংবা সিটি নির্বাচনের আগের এক মাস পুরোটা সময় জুড়ে চট্টগ্রামে নেতা-কর্মীদের জন্য মেজবানের আয়োজন করতে দেখা যায় রাজনীতিবিদদের।
বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের সংখ্যা ৫০০ পেরুলে মেজবান দিতে দেখা যায় এই অঞ্চলের অনেক পরিবারকে। তবে মেজবান মানেই এই অঞলে ঐতিহ্য, মেজবান মানেই এখানে ভিন্ন এক সংস্কৃতি।
মেজ্জানের হাত ধরে জনপ্রিয়
চট্টগ্রামে মেজবানের মাংসের জন্য এখন প্রসিদ্ধ নাম 'মেজ্জান হাইলে আইয়ুন'। পুরোনো ঐতিহ্যকে ধরে রেখে গরুর মাংসের মেজবানি খাবার পরিবেশন করছে প্রতিষ্ঠানটি।
চট্টগ্রামে তাদের ৫টি রেস্টুরেন্ট এই মুহুর্তে চালু রয়েছে। এছাড়া ঢাকায় আছে আরও ২টি।
সরেজমিনে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে অবস্থিত মেজ্জান রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরে গিয়ে দেখা যায়, বড় বড় পাতিলে মশলা মাখানো মাংসের টুকরো সাইজ করে কেটে চুলোয় বসানো হয়েছে। আর নিচে আগুনের তাপ দিচ্ছে রান্নার কাজে নিয়োজিত অন্তত ২০ জন লোক।

লাকড়ির চুলোতে রান্না হওয়ার কারণে অতিথিরা আসল মেজবানের মাংসের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হন না। প্রতিদিন সকাল-বিকাল দু'ভাবে মেজবানের মাংস মানুষের খাবারের টেবিলে পরিবেশন করা হয়। এখান থেকে রান্না হওয়ার পর বড় পাতিলে সেগুলো জামাল খান, চকবাজার, লালখান বাজার ও আগ্রাবাদ শাখায় পৌঁছানো হয়।
জানতে চাইলে প্রতিদিন একটি করে গরু মেজবানের মাংসের জন্য জবাই দেওয়ার কথা জানালেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মনজুরুল হক।
তিনি বলেন, মাসে ছোট বড় মিলিয়ে ২০/২৫টি গরু তো লাগেই। কোনো দিন ছোট গরু, কোনো দিন বড় সাইজের গরু। আসলে চাহিদার উপর নির্ভর করে।
চট্টগ্রামে কেউ বেড়াতে আসলে ঐতিহ্যবাহী মেজবান খেতে চায়। কিন্তু ঠিক ওই সময় কোথাও মেজবানের আয়োজন না থাকলে অনেকে খাওয়াতে পারেন না। চট্টগ্রামে এসে কেউ যাতে মেজবান না খেয়ে ফেরত না যান ওই আইডিয়া থেকে রেস্টুরেন্টে মেজবানের আয়োজন।
তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামের মেজবানের ঐতিহ্য ধরে রাখতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা। গুণগত মান ধরে রাখতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছি আমরা। ঘরে বসে খাবার অর্ডার করার জন্য মেজ্জান নিজস্ব অ্যাপস চালু করেছে বলে উল্লেখ করেন মনজুরুল হক।
তবে চট্টগ্রামের এই ঐতিহ্যকে ধরে রেখে খাবারের মেন্যুতে মেজবানের মাংসের জন্য আরও বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট সুনাম কুড়িয়েছে। মেজবান বাড়ি, হোটেল জামান, মুরাদপুরের আল মদিনা হোটেল ও ওরিয়েন্ট রেস্টুরেন্টের নাম শোনা যায় খাবার প্রেমীদের মুখে।
১২০০ বছরের ঐতিহ্য!
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানের মাংসের প্রচলন কবে সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই গবেষকদের কাছে। তবে ইতিহাসের নানান জায়গায় 'মেজোয়ানি' ও 'মেজমান' শব্দ দুটো পাওয়া যায়।
ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম তার গবেষণা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, নবম শতাব্দীতে চট্টগ্রামের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ ছিল। মানে ১২০০ বছর আগে এই অঞ্চলে তাদের আসা-যাওয়া শুরু হয়।
আর এই আরবদের হাত ধরেই চট্টগ্রামে জনপ্রিয় হয়ে উঠে মেজবানের মাংস-এমনটাই মনে করেন রন্ধনশিল্পী ও খাবার গবেষকরা।
বিশিষ্ট রন্ধনশিল্পী জোবায়দা আশরাফ বলেন, চট্টগ্রামের মুসলিম বণিকদের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ বেড়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলে ৭০০ বছর আগে থেকে খাবারে বৈচিত্র্যতা আসতে শুরু করে। ঠিক তখন থেকেই মেজবানের মাংস খাবারের টেবিলে ঠাঁই পেতে শুরু করে বলে ধারণা করা হয়।
১৫০০ শতকের কবি বিজয় গুপ্তের পদ্মপুরাণ কাব্যগ্রন্থে এই সংস্কৃতির তথ্য পাওয়া যায়। ১৬০০ শতাব্দীর সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ কাব্যগ্রন্থে 'মেজোয়ানি' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ভোজ অর্থে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের সাবেক কিউরেটর ও গবেষক শামসুল হোসাইন তার এক লেখায় বলেছেন, মেজবান ফারসি শব্দ। ১৫০০ ও ১৬০০ শতাব্দীর প্রাচীন পুঁথি সাহিত্যে 'মেজোয়ানি' ও 'মেজমান' দুটি শব্দ পাওয়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
এক সময় মাটির চুলোতে মেজবানের মাংস রান্না করা হতো। পরিবেশন করা হতো মাটির বাসন বা সানকিতে। তবে যুগের সঙ্গে পরিবর্তনে রান্না ও খাবার পরিবেশন- দুটোতেই এসেছে পরিবর্তন।