মিমি চকলেট: শৈশবের ভালোবাসার মৃত্যু
সত্তর ও আশির দশকে শিশুরা চকলেট বা চুইংগাম বলতে মিমি চকলেটকেই বুঝত। এমনকি নব্বইয়ের দশকের শুরুতেও যখন বাহারি মোড়কের চকলেটগুলো বাজারে সেভাবে পসার লাভ করেনি, তখনো গরু এবং কমলার কোয়ার অলংকরণে ছাপা এই মিমি চকলেটই ছিল ছেলেবুড়ো সবার পছন্দের শীর্ষে।
সে সময়ের একক টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভিতেও যেভাবে মিমির বিজ্ঞাপন সম্প্রচার করা হতো তাতে শিশুদের কাছেও এটি হয়ে ওঠে অতি আরাধ্যের।
এই দারুণরকম জনপ্রিয় মিমি চকলেটের একচেটিয়া সাম্রাজ্র্যের সূর্য অস্তমিত হতে শুরু করে নব্বইয়ের দশকের শেষে; যখন ব্যাক্তি মালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানি এবং বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো এদেশের বাজারে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। প্রতিযোগিতা এবং সেকেলে কলকব্জা- এ দু'য়ে মিলে মিমি চকলেট আস্তে আস্তে বাজার থেকে অদৃশ্য হতে শুরু করে।
অবশেষে টানা কয়েক বছরের লোকসানের পর ২০১৮ সালে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে মিমি কোম্পানি বন্ধ ঘোষণা করে । ফ্যাক্টরির স্থানটিকে এখন একটি মোটরসাইকেল কোম্পানির শো রুম হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। চকলেট তৈরির মেশিনগুলোও বাতিল হিসেবে বহু আগেই বিক্রিও করে দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ২০০৬ সালেও একবার কোম্পানিটি বন্ধের উপক্রম হয়েছিল। স্বাধীনতার পর থেকেই তেজগাঁওয়ে অবস্থিত মিমি চকলেট ফ্যাক্টরির তত্ত্বাবধানে ছিল বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট।
এই ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখারুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মিমি ছিল বাংলাদেশের প্রথম চকলেট বার উৎপাদন করা কোম্পানি। কিন্তু বিপুল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কোম্পানিটি বন্ধ করা করে দেওয়া হয়।"
"কারখানাটিকে আধুনিকীকরণ না করে, পুরনো মেশিন দিয়ে দিনের পর দিন ব্যবসা পরিচালনা করা কঠিন ছিল। নিয়মিত লোকসান গুনতে থাকায় কর্তৃপক্ষের কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।"
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনজুর বলেন, দক্ষ ব্যবসায়িক নেতৃত্ব ছাড়া কোনো কোম্পানি টিকে থাকতে পারে না। সরকারি সংস্থাগুলোর ব্যবসা পরিচালনার জন্য সুদক্ষ নেতৃত্বগুণ নেই। এসব সংস্থার শীর্ষ পদে কোন স্থায়ী নিয়োগ নেই। ফলে কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করাও সম্ভব হয় না এবং প্রবল দায়িত্ববোধের অভাব থাকে।
চকলেট উৎপাদন এবং বিপণন সংস্থাগুলোর মতে, প্রতি বছর চকলেট-ক্যান্ডির বাজারমূল্য বাড়ছে ১২-১৫ শতাংশ। বর্তমানে এ খাতে বাজারের আকার প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা। যার ৬০%ই নির্ভর করে আমদানির ওপর।
৫৩ বছরের যাত্রা
মিমি'র যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৫ সালে , তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের তেজগাঁওয়ে মাত্র এক একর জমির ওপর দাঁড়ানো একটি ফ্যাক্টরি সাথে নিয়ে। মিমি তৈরির মেশিনগুলো আমদানি করা হয়েছিল জার্মানি থেকে।
স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট্রের ওপর এটি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ ট্রাস্টের একজন পরিচালক বলেন, "শুরুতে চকলেটের বাজার অতটা প্রসারিত ছিল না। এ খাতে দেশে তখন কোন ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানিও ছিল না। বিদেশি চকলেট ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ফলে মিমি চকলেটের জনপ্রিয় হতে একদমই সময় লাগেনি।
স্বাধীনতার পরের ১৮ বছরেও মিমি চকলেটের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এমনকি, ১৯৯০ সালেও কোম্পানিটি প্রতি মাসে ৫০-৬০ লাখ টাকার চকলেট এবং চুইংগাম বিক্রি করত।
তবে ক্ষয়টা শুরু হয় এরপর থেকে। চকলেট উৎপাদনের সেকেলে কলকব্জা, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং নেতৃত্বগুণের অভাব কোম্পানির ধ্বংস ডেকে আনে।
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কর্মকর্তাদের মতে, পুরনো মেশিনের সাহায্যে চকলেট উৎপাদনের মাশুল সবচেয়ে বেশি গুণতে হয় ২০০০ সালের পর। উৎপাদন খরচ তো বাড়েই, মেশিনগুলোও বারবার মেরামতের পরে পুরনো গতি আর ধরে রাখতে পারছিল না।
এখানেই শেষ নয়। একটা পর্যায়ে মিমি চকলেট কোম্পানির ঘাড়ে ঋণ খেলাপির দায় বর্তায়। কাঁচামাল আমদানি করা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায়, ২০০৬ সালে প্রথমবার কর্তৃপক্ষ কোম্পানিটি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়।
২০০৯ সালে, সরকার বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট্রের আওতাধীন কিছু সংস্থাকে ১২৬ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ দেবার ঘোষণা দেয়, যার ভেতরে মিমি চকলেট কোম্পানিও ছিল। অর্থ সাহায্যের পরেও কোম্পানির পুনরুজ্জীবনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পুরনো যন্ত্রপাতি।
২০১৪ সালে, মিমি চকলেটের বার্ষিক বিক্রয় নেমে আসে ১৫-২০ লাখে। সবদিক বিবেচনা করে এবার সত্যিই কোম্পানিটি একবারে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অবশেষে, ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মিমি চকলেট বাংলাদেশের বাজার থেকে বিদায় নেয়।
কারখানার প্রাক্তন কর্মীরা জানান, কারখানা সচল এবং পুরনো যন্ত্রপাতি পরিবর্তনের দাবিতে তারা আন্দোলনও শুরু করেছিলেন; কিন্তু কোম্পানির ব্যবস্থাপকেরা একে খুব একটা গুরুত্ব দেননি।
চকলেট নয়, এখন বিকিকিনি চলে মোটরসাইকেলের
মিমি ফ্যাক্টরির প্রাক্তন কর্মচারী এবং বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট্রে কর্মরত আবদুল আজিজ জানান, "২০১৯ এর শুরুতে ফ্যাক্টরির মেশিনগুলো বাতিল হিসেবে বিক্রয় করা হয়। এর সাথে মিমি চকলেট কোম্পানির অবশিষ্টাংশটুকুও আর থাকল না।"
ট্রাস্টের আরেকজন কর্মকর্তা এবং তত্ত্বাবধানকারী জামিল আহমেদ বলেন, 'কারখানার জায়গাটি একটি মোটরসাইকেল কোম্পানিকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। এখানে যতটুকু ভাড়ার টাকা উঠে তা চকলেট এবং চুইংগাম বিক্রির চাইতে অনেক বেশি।'
ট্রাস্টের পরিচালক মো আবু সাঈদ ফকির বলেছেন, 'মিমি চকলেট কোম্পানিই প্রমাণ দেয় যে, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব সরকারের নয়।'
পুরনো মেশিনগুলোকে প্রতিস্থাপন করা, পণ্যকে সময়ের সাথে বৈচিত্র্যপূর্ণ করা এবং বাণিজ্যের দৌড়ে টিকে থাকতে প্রতিযোগিতামূলক বিপণন কৌশল আয়ত্ত করার প্রয়োজনীয়তাও তিনি উল্লেখ করেন।
আবু সাঈদ আরও বলেন, "বেসরকারি খাত আধুনিক যন্ত্রপাতি ও কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে চকলেট উৎপাদন করছে। বিদেশি চকলেটের আমদানিও বেড়েছে। সরকারি সংস্থা হওয়ার দরুণ মিমি চকলেট কোম্পানির আধুনিকীকরণ সম্ভব হয়নি। সংস্থাটিকে শেষ পর্যন্ত তাই টিকিয়েও রাখা যায়নি।
এভাবেই অনেকের শৈশব কৈশরের স্মৃতিময় মিমি চিরতরে হারিয়ে যায়।