মাসুকের ক্যাকটাস ভুবন
ছয় কাঠা দোতলা বাড়ির ছাদে বিশাল শেড। শেডটি নীল জাল দিয়ে ঘিরে রাখা। শেডের ভেতরেই নানা আকৃতির প্লাস্টিক টবে রাখা নানা জাতের ক্যাকটাস; চারা গাছ থেকে বড় আকৃতির।
আকৃতি অনুযায়ী এসব টবের কোনোটিতে চারা গাছ রাখা হয়েছে, কোনটিতে গ্রাফটিং করা হয়েছে, আর কোনটিতে গ্রাফটিং করার পর তুলে একটু বড় হওয়ার পর লাগানো হয়েছে। শেডের ভেতর প্রায় দেড় হাজার সারি সারি টব; গাছ রয়েছে চার হাজারের মতো।
রাজশাহী মহানগরীর কুমারপাড়া মোড়ে বড় রাস্তার কাছে মাসুক আলম খান নামের এক যুবকের বাড়িতে দেখা যাবে এমন চিত্র। পেশায় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ট্যাক্স কালেকশন বিভাগের কর্মী হলেও নেশা তার ক্যাকটাস উৎপাদন।
মাসুকের ক্যাকটাস ভুবন দেখতে সম্প্রতি এ প্রতিবেদক যান তার বাসার ছাদে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, শেডের ভেতর প্রায় ১২ হাজার বীজের অঙ্কুরোদগম করা হচ্ছে। এ জন্য রয়েছে প্রায় শখানেক প্লাস্টিকের বক্স। এক-একটি বক্সে অঙ্কুরোদগমনের জন্য ফেলা হয়েছে ২০০ থেকে এক হাজার বীজ।
এ জন্য বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাটি প্রস্তুত করে প্লাস্টিক বক্স ভর্তি করতে হয়। টবের জন্যও বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাটি প্রস্তুত করতে হয়।
এই শেডের ভেতর বীজ থেকে চারা গাছ। চারা গাছ থেকে গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে ক্যাকটাস বড় করা পর্যন্ত সবই করা হয়। তারপর পর্যাপ্ত বড় করে ক্যাকটাস বিক্রি করা হয়।
শুধু দোতলার এই ছাদেই নয়, একতলার ছাদের বর্ধিত অংশেও ইট বালু ও সিমেন্ট দিয়ে টানা শেড তৈরি করা হয়েছে। সেখানেও ক্যাকটাসের বীজ থেকে চারাগাছ ও বড় ক্যাকটাস উৎপাদন করা হয়।
কুমারপাড়া মোড়ের বড় রাস্তা ধরে সাহেব বাজারের দিকে গেলে কিংবা সাহেব বাজার থেকে তালাইমারীর দিকে এলে যে কারো সহজেই চোখে পড়বে বাড়ির ছাদের বিশাল বড় শেড। কৌতূহলীরা হয়তো বা বুঝতেই পারবেন না এই শেডে কী হচ্ছে!
মাসুক আলম খান বাণিজ্যিকভাবে ক্যাকটাস উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাতকরণ করছেন। এ নিয়ে তিনি বলেন, “তিনটি পর্যায়ে এই শেডে ক্যাকটাস চাষাবাদ করা হয়। প্রথম পর্যায়ে ছোট ছোট প্লাস্টিকের বক্সে বীজের অঙ্কুরোদগমন ঘটানো হয়। একটি বক্সে ১০০টি বীজের অঙ্কুরোদগমন ঘটনা হলে সেখান থেকে কমপক্ষে ৫০টি চারাগাছ পাওয়া যায়। এরপর সেসব চারাগাছগুলোর অর্ধেক টবে পুনঃবপন করা হয়। আর অর্ধেক গ্রাফটিং করা হয়।”
মাসুক জানান, তৃতীয় ধাপে গ্রাফটিং করার পর গাছ বড় হলে তুলে আলাদাভাবে আরেকটু বড় টবে লাগানো হয়। একটি ক্যাকটাস গাছ পূর্ণাঙ্গ বৃদ্ধি পেতে তিন বছর সময় নেয়। কিন্তু গ্রাফটিং করা হলে দেড় বছরে তা পূর্ণাঙ্গ বৃদ্ধি পায়।
মাসুক আলমের দাবি, ক্যাকটাস বাংলাদেশের অনেকেই চাষাবাদ করলেও বীজের অঙ্কুরোদগমন করে চারাগাছ তৈরি করে এত বড় পরিসরে তিনিই একমাত্র করছেন। বীজগুলো তিনি ভারত, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিয়ে আসেন। তার কাছ থেকে বাংলাদেশের অনেকেই চারা গাছ কিনে বিক্রি করছেন।
দরদাম
মসুরের ডালের চেয়েও ছোট প্রতিটি ক্যাকটাসের বীজের দাম ২০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। কোনো কোনো ক্যাকটাসের একটি বীজের দাম তার চেয়েও বেশি। পুরো পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজার ক্যাকটাসের জাত থাকলেও মাসুক আলমের কাছে ১৫০-২০০ জাতের ক্যাকটাস রয়েছে। তবে তারা সাধারণত কম দামের ক্যাকটাসগুলোই বাজারজাত করছেন। তারা বীজ থেকে চারা উৎপাদনের পর ৫০ থেকে ২০০ টাকায় চারাগাছ বিক্রি করছেন। আর ক্যাকটাসের গাছ বিক্রি করেন ১০০ টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকায়। তার কাছে বিক্রির উপযোগী ৪ হাজার গাছ রয়েছে।
মাসুক আলম মনে করেন, কেউ দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে ছয় মাসে তা ৭ লাখ টাকায় বিক্রির উপযোগী হবে।
মাসুক জানান, অবকাঠামোগত খরচ ও শ্রম বাদ দিলে শুধু বীজের জন্যই তিনি গত এক বছরে দুই লাখ টাকা খরচ করেছেন। প্রথম দফায় ৬০ হাজার টাকার বীজ কিনে তার মধ্যে থেকে কিছু গাছ বড় করে এক লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন। ওই টাকা দিয়ে আবার বীজ কিনেছেন।
মাসুক বলেন, “আপাতত তিন বছর ক্যাকটাস বিক্রি করে যা আয় করব তার সবই ক্যাকটাস চাষাবাদে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে।”
ক্যাকটাস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শত শত ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে বিশ্বব্যাপী। যেখানে ক্যাকটাসপ্রেমীরা তাদের কাছে থাকা ক্যাকটাসের বিভিন্ন জাতের ছবি ব্যবহার করেন।
মাসুক আলম বলেন, “আমি নিজে ৯৭৫টি গ্রুপের সদস্য। এ ছাড়া আমার নিজের ‘বাংলাদেশ ক্যাকটাস সাকুলেন্ট লাভারস‘ নামের একটি গ্রুপ আছে, যেখানে ৮২টি দেশের সদস্য রয়েছে। গ্রুপের মোট সদস্য সংখ্যা প্রায় সাত হাজার।”
শুরুর কথা
খুব ছোটবেলা থেকেই গাছ অন্তঃপ্রাণ ছিলেন মাসুক আলম খান। ১৯৯৭ সালে তিনি ভারতের কালিম্পং ও ভুবনেশ্বর ঘুরতে যান। সেখানকার বিখ্যাত ক্যাকটাস শেডগুলো ঘুরে দেখেন। তখনই তিনি ভাবেন, একটি ক্যাকটাস শেড নিজের মতো করে তৈরি করবেন বাংলাদেশে। তখন থেকেই ভারত থেকে কিছু কিছু গাছ নিয়ে এসে নিজের বাড়িতে শুরু করেন। তবে মাঝখানে কয়েক বছর বন্ধ ছিলো তার এ কার্যক্রম। গত বছর থেকে আবার বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেন তিনি। আর এ কাজে সহায়তা করেছেন থাইল্যান্ড ফেরত মেসবাহ উদ্দিন।
কারা কেনেন
মাসুক আলম বলেন, শিক্ষিতদের মধ্যে গাছ কেনার চাহিদা বাড়ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ক্যাকটাস ল্যান্ডস্কেইপ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের একমাত্র ক্যাকটাস ল্যান্ডস্কেইপ রাজশাহীর র্যাব -৫ অফিসে করেছেন মাসুক।