মহামারিকালে নেট দুনিয়ায় অপরাধের জোয়ার
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদানে ডিজিটাল সুরক্ষাই সাধারণত প্রাধান্য পায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অনলাইন কার্যক্রমে। কিন্তু, মহামারির তাণ্ডবে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড চালাতে সাইবার সিক্যিউরিটির এ নিরাপত্তার চাইতে বেশি প্রাধান্য পেতে থাকে কর্মীদের নিজ বাসস্থানে অবস্থান করে দাপ্তরিক কাজে অংশ নেওয়ার গুরুত্ব। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আর্থিক ব্যবসা, পণ্য ও সেবা বিক্রির উদ্যোগ- সবখানেই অগ্রগণ্য হয়ে ওঠে- রিমোট ওয়ার্কের ধারণাটি।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে; বৈধ বাজার ব্যবস্থাকে সব সময়েই অনুসরণ করে ছায়া বাজার। ব্যতিক্রম হয়নি এক্ষেত্রেও। বৈধ ব্যবসাকে ধাওয়া করেই অনলাইনে অপরাধী চক্রের তৎপরতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। মহামারিতে চাঙ্গাও হয়েছে এসব সাইবার অপরাধের ব্যবসা।
মহামারি এনেছে সুবর্ণ সুযোগ:
সাইবার অপরাধ দমনে বিশ্বের সবচেয়ে তৎপর সংস্থা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই। গত জুন নাগাদ মার্কিন সরকারের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাটি জানায়, ডিজিটাল অপরাধের মাত্রা বাড়িতে অবস্থানে কড়াকড়ি আরোপের পর থেকে ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে । এছাড়াও, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাস নাগাদ আসা ভুক্তভোগীদের অভিযোগের সংখ্যা ২০১৯ সালের পুরো বছরে পাওয়া অভিযোগকে ছাড়িয়ে গেছে, বলেও জানায় সংস্থাটি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন জোট- ইন্টারপোলের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনও এফবিআই-এর দাবিকে সমর্থন করে বলছে; শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় বরং ইন্টারপোলের সদস্য সকল দেশেই একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর বৈশ্বিক সমন্বয়কারী সংস্থাটির মহাসচিব জার্গেন স্টোক বলেন, ''সাইবার অপরাধীরা তাদের আক্রমণের মাত্রা যেমন বাড়িয়েছে, ঠিক তেমনি অনুসরণ করছে আরো উন্নত ও অভিনব পন্থা। কোভিড-১৯ সৃষ্ট আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির অস্থিতিশীলতার সুযোগ কাজে লাগিয়েই তারা এসব তৎপরতা চালাচ্ছে।''
মহামারিতে অনলাইনে অর্থনৈতিক লেনদেনে সূচিত হয়েছে নাটকীয় গতি। ভাইরাসের বিস্তার রোধে বাড়িতে অবস্থান করা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো সতর্কতার পদক্ষেপ- হয়ে ওঠে লেনদেন বৃদ্ধির মূল প্রভাবক। যা অপরাধী চক্রের জন্য হয়ে উঠেছে আকর্ষণের কেন্দ্র।
সাইবার ক্রিমিনালদের মূল লক্ষ্য:
পরামর্শক সংস্থা- অ্যাডব অ্যানালিটিক্সের তৈরি এক সূচকে দেখা যায়, বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের অনলাইনে খরচের পরিমাণ জুনে ৭৬ শতাংশ বাড়ে - গত বছরের একই সময়ের তুলনায়। জুলাইয়ে খরচ প্রবৃদ্ধি বাড়ে ৫৫ শতাংশ হারে। অনলাইনে ক্রয়ের এ ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়েই জুনে খুচরা পণ্য ক্রয়ে জালিয়াতি বাড়তে থাকে। বছরের শুরু থেকে ওই মাসের ৩০ তারিখ নাগাদ মার্কিন কেন্দ্রীয় বাণিজ্য কমিশনের কাছে এমন এক লাখ ৪০ হাজার প্রতারণার অভিযোগ আসে। যা ছিল ২০১৯ সালে আসা প্রায় সমস্ত জালিয়াতির সমান সংখ্যা।
একইসময়ে সাইবার অপরাধী হ্যাকার গোষ্ঠী চুরি করে- ৫ লাখ ৭০ হাজার অনলাইন আইডেন্টিটি। এটাও গত বছর জুরে হওয়া সমগ্র চুরির কাছাকাছি এক পরিসংখ্যান। অবস্থাদৃষ্টে এটাই পরিষ্কার যে,মহামারির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে কাজ করা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের সুযোগ নিয়ে- তাদের ব্যক্তিগত তথ্য, ক্রেডিট কার্ড নাম্বার এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে দুষ্কৃতিকারীরা।
অপরাধের নতুন কৌশলও আগের থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ভুয়া এবং স্পাইওয়্যার যুক্ত মেইল পাঠানো, বৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙ্গিয়ে ছদ্ম পরিচয় তৈরি করে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া; সব কিছুই চলছে ডিজিটাল মাধ্যমে। সাইবার অপরাধীরা অনেক সময় গোষ্ঠীবদ্ধভাবে একজন ব্যক্তিকে টার্গেট করে। এর মাধ্যমে তারা ব্যাংক বা ক্রেডিট কার্ড কোম্পানির ছদ্মবেশ ধরে ভোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে- তাদের অ্যাকাউন্টের লগইন আইডি, পাসওয়ার্ড বা অর্থনৈতিক তথ্য হাতিয়ে নেয়।
হুমকিতে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান:
অর্থনৈতিক জালিয়াতিতে জড়িত হ্যাকারেরা সাম্প্রতিক মাসগুলিতে সরকার এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্তৃপক্ষের পাঠানো তথ্য সম্পর্কিত ইমেলগুলোও নকল করা শুরু করেছে। মহামারির মধ্যেই এভাবে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে নাগরিকদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করছে তারা, বাড়াচ্ছে সংক্রমণের ঝুঁকি।
একের পর এক ভুয়া ইমেইল পাঠানো, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আদলে ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি এবং সাইট হোস্টিংয়ের জন্য তৈরি করা ক্ষতিকর ডোমেইন; সাইবার নিরাপত্তার জন্য বিশাল এক হুমকি হয়ে উঠেছে।
গত জুনে ক্ষতিকর ডোমেইন শনাক্তের জন্য তৈরি করা ইন্টারপোলের বৈশ্বিক একটি টাস্ক ফোর্স, এ ধরনের ২ লাখ নতুন নিবন্ধিত সাইট শনাক্ত করে এবং সেখানে থাকা তথ্যও বিশ্লেষণ করে। এসব সাইট ইন্টারপোলের ৮০টি সদস্য দেশের অনলাইন বাণিজ্য ও লেনদেনকে প্রভাবিত করছে। আয়কর কর্তৃপক্ষ, শুল্ক বিভাগ, জনস্বাস্থ্য বিভাগের মতো সরকারি সংস্থা এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সাইটের আদলে তৈরি করা হয় জাল সাইটগুলোকে। বিশ্বস্ত এসব সংস্থার পরিচয় ব্যবহার করে নানা দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরিতে তাই খুব একটা বেগ পেতেও হচ্ছে না অপরাধী চক্রগুলোকে।
ইন্টারপোল আরো জানায়, একক কোনো ব্যক্তিকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর চাইতে মহামারিকালে নানা প্রতিষ্ঠানকেই আক্রমণ করার দিকে ঝুঁকেছে অপরাধীরা। নিকট অতীতে অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো এধরনের হামলায় বেশি ক্ষতির শিকার হলেও- এখন হ্যাকারদের মূল লক্ষ্য বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি দপ্তর এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো স্থাপনা।
এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ব্যাহত করতে তাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে র্যানসমঅয়্যার। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে এ ধরনের ক্ষতিকর সফটঅয়্যার অনুপ্রবেশ করানো হলে; তার মাধ্যমে তথ্য চুরি বা মুছে দেওয়া যায় কোনো প্রতিষ্ঠানের সার্ভার থেকে। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হ্যাকারদের দাবি করা নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ না দিলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে এ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। জিম্মি করে অর্থ আদায়ে পারদর্শিতার জন্যই র্যানসমঅয়্যার নামকরণ।
কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেই কিছু হ্যাকার গোষ্ঠী অত্যন্ত নির্মমতার পরিচয় দিয়ে জনস্বাস্থ্য স্থাপনা; হাসপাতাল, চিকিৎসা কেন্দ্র এবং কিছু সরকারি ওষুধ গবেষণা কেন্দ্রকে তাদের লক্ষ্যবস্তুও বানায়। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ আর নিরাময় আবিষ্কারের প্রচেষ্টা। একদিকে মানুষের জীবন বাঁচানো অন্যদিকে হ্যাকারদের তাণ্ডব- দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়েই লড়তে হচ্ছে বিশ্বকে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট