মস্তিষ্কে কোভিড-১৯ এর প্রভাব
১৭ শতকে ইংল্যান্ডে তখন দেখা দিয়েছিল বিউব্যুনিক প্লেগের প্রাদুর্ভাব। সেই মহামারি থেকে বাঁচতে ক্যামব্রিজ ছেড়ে লিঙ্কনশায়ারের গ্রাম্য ঠিকানায় আশ্রয় নেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। এখানেই ছিল তার পৈত্রিক বাড়ি। বাড়ির পেছনেই আবার নানা ধরনের ফলমুলের গাছ। বলা যায় খুবই মনোরোম পরিবেশ।
নিউটন তো শহর ছাড়লেন, গ্রামেও আসলেন, তাই এবার কিন্তু তার বৈজ্ঞানিক মন পেল চিন্তার অখণ্ড অবসর। রোগ বা রোগী থেকে দূরে থাকার ভয় ও শঙ্কা ছাড়াই ডুবে যেতে পারলেন চিন্তার জগতে। আর এভাবেই একদিন গাছের নিচে বসে বসে ভাবনার কালে গাছ থেকে টুপ করে খসে পড়লো একটি আপেল। আর বাকিটা ইতিহাস। ওই সূত্রেই তো মধ্যাকর্ষণ বলের তত্ত্বটি বিজ্ঞান উপহার পেয়েছিল।
দেখাই যাচ্ছে মহামারি তৎকালীন পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীকে প্রভাবিত করেছিল। তাই মধ্যাকর্ষণ মহামারির অবদান সেকথা বললেও বাড়িয়ে বলা হয় কি?
আজো বিশ্ব এক মহামারির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এক বছরের বেশি সময় জুড়ে এই হাল আমাদের মগজেই বা কেমন প্রভাব ফেলছে? জ্ঞান-চর্চা বা দর্শনে মহামারির প্রভাব কী- এসব প্রশ্নও জাগে।
এই দীর্ঘ সময়ের বড় একটা অংশ বাড়ি থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছেন অনেকেই। অবশ্য তাতে অনেকেরই হয়েছে মেদভুঁড়ি অর্জন। কারো কারো চিন্তায় পেকে গেছে চুল। আর কেউ অবসর কাটাতে পালছেন ছোট্ট বিড়াল ছানা।
আমরা অনেকেই অসুস্থ হয়েছি, সেরেও উঠেছি আবার অনেকে আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশেও চলে গেছেন। তাই আবেগ- অনুভূতিকেও প্রভাবিত করেছে কোভিড-১৯। আমাদের চিন্তা, স্বাস্থ্য, জীবনযাপন আর মানসিক জগতকে এভাবেই বছরব্যাপী ঘিরে রাখে মহামারির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অসংখ্য প্রভাব।
অতিমারীর কালে বেঁচে থাকার এই সময় কী আমাদের চিন্তাকে বড় আকারে পরিবর্তন করছে? সেটা কী আমাদের চিন্তার ধারাকে চিরতরে বদলে দেবে?
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি ইতিহাসবিদ ফ্রাঙ্ক স্নোডেনের অভিমত, 'মানুষজন স্বাভাবিক জীবনে ফেরার কথা বলাবলি করছেন। আমার কিন্তু মনে হয় না তা করা সম্ভব হবে।'
বিগত ৪০ বছর ধরে অতীতের নানা অতিমারির কালে সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে পড়াশোনা করেছেন স্নোডেন। এনিয়ে লেখা তার বিখ্যাত বই, 'এপিডেমিক্স অ্যান্ড সোস্যাইটি: ফ্রম ব্লাক ডেথ টু প্রেজেন্ট'
চলতি বছরটা প্রথমদিকে তার খুব ব্যস্ততার মধ্য দিয়েই কাটে। অতীত ইতিহাস থেকে নতুন করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় কী ইঙ্গিত পাওয়া যায়- তা জানতে প্রতিদিনই অসংখ্য কল আসছিল তার কাছে। সারাজীবন মানুষকে মহামারির ইতিহাস জানানোর যে চেষ্টা করেছেন, এবার যেন সেই সুযোগ তার হাতে কোভিড-১৯ তুলে দেয়। অথচ জীবনের ওই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বেশি ব্যস্ত থাকার সুযোগ পেলেন না স্নোডেন, কারণ তিনিও তখন সংক্রমিত হয়েছেন।
স্নোডেন মনে করেন, কোভিড-১৯ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তার মতে, 'পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার দুর্বলতা/ ব্যর্থতার সূত্র ধরেই মহামারি সকল সমাজে বিশেষ কিছু বিষয়ে গভীর ছাপ ফেলে। সম্পর্কটি মানব সমাজের সঙ্গে জীবজগত আর অন্যান্য প্রজাতির সম্পর্ককেও তুলে ধরে।'
স্নোডেন জানান, 'সব মহামারি এক ধরনের নয়। তাদের প্রত্যকের আছে নিজ বৈশিষ্ট্য। তবে চলমান মহামারিও বিউব্যুনিক প্লেগের ওই সময়ের মতো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও চিন্তাশক্তিতে বড় প্রভাব ফেলছে।' কোভিড-১৯ এর জের ধরে দ্বিতীয় আরেক মহামারির শঙ্কাও করছেন তিনি। যাকে তিনি মনোরোগের নতুন মহামারি নাম দিয়েছেন।'
এব্যাপারে বলেছেন ইউএসসিএফ ওয়েইল ইনস্টিটিউড ফর নিউরোসায়েন্সের সাইক্রিয়াট্রির সহকারী অধ্যাপক অ্যাইফে ও'ডোনাভান। তিনি মানসিক আঘাত/ বিপর্যয় বিশেষজ্ঞ।
তিনি জানান, 'অনেক স্তরে অনিশ্চয়তার সঙ্গে আমাদের যুঝতে হচ্ছে। নিজেকে নিয়ে ভাবনা তো আছেই, অর্থনৈতিক চিন্তা, পরিবার-পরিজনকে নিয়ে ভাবনা, সবকিছুই একাকার হয়ে গেছে মনোজগতে। সত্যিই এরমধ্যে অনেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। অন্যদের সাথেও এমনটা ঘটবে বলে আমরা জানি, কিন্তু জানি না কখন বা কীভাবে তারা সেই দুর্ভাগ্যের শিকার হবেন। এই অবস্থায় স্নায়ু উত্তেজিত হবেই। চিন্তার জগতে বড় আলোড়ন পড়বেই। আমরা না চাইলেও প্রচ্ছন্নভাবে এই উদ্বেগ মনের গহীনে কাজ করেই যাবে।'
ও'ডোনাভান বলেন, দুশ্চিন্তার প্রভাব আমাদের পুরো শরীরেই পড়ে। কারণ আমরা যখন কোনো বাস্তব বা কাল্পনিক হুমকির শঙ্কায় থাকি তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেহে উদ্বেগজনিত একটি জৈবিক ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে। কর্টিসোল নামের হরমোন তখন গ্লুকোজ তৈরিতে সাহায্য করে। সক্রিয় হয়ে ওঠে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ফলে প্রদাহ দেখা দেওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে। মগজের স্বাভাবিক ক্রিয়া এতে ব্যাহত হয়। এতে মানুষ যেকোনো বিষয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ও ভীত থাকে। অন্যদিকে, ইতিবাচক দিকে নজর দেওয়ায় তাদের মনোযোগ থাকে কম।
এমন অবস্থায় কানের কাছে কেউ হাঁচি দিলেও আমাদের স্বতন্ত্র দৈহিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা সঙ্গে সঙ্গে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থানে চলে যায়। কাউকে মাস্ক না পড়তে দেখেও এমনটা হতে পারে। অচেনা কেউ আপনার দিকে এগিয়ে আসছে এমনটা দেখলেও এখন মানুষ ভয় পাচ্ছেন। জুম কলে থাকার সময় ব্যাকগ্রাউন্ডে কোনো পরিচ্ছন্নতা কর্মী কাজ করছেন এমন দৃশ্যও অনেককে উদ্বিগ্ন করছে।
ও'ডোনাভান বলেন, 'নানা দেশের সরকারি নির্দেশনা বেশ ফাঁক-ফোকর রয়ে গেছে। নিয়মিত পরিবর্তনও হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধিতে। এই অবস্থা উদ্বেগ কমানোর পক্ষে একদমই উপযুক্ত না। আমাদের অবশ্যই মানসিক প্রভাবের কথা ভেবে সকলে মিলে সতর্ক থাকতে হবে। যাতে আমাদের সিদ্ধান্তে সমাজের অপর কোনো ব্যক্তি অহেতুক উদ্বেগের শিকার না হন। নৈতিক এ দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমেই আপাতত আমরা মানসিক বিপর্যয় ঠেকানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারব।'
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান