ভ্যাকসিন দৌড়ে ‘ডার্ক হর্স’ এই ফরাসী বায়োটেক
কোভিড-১৯ মোকাবিলার মহাযুদ্ধে ব্যতিব্যাস্ত পৃথিবী। প্রধান হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে অণুজীবের মারাত্মক অভিযোজন, যার বিস্তারে বাড়ছে সংক্রমণ ও প্রাণহানি। ভাইরাস অচিরেই প্রথম প্রজন্মের টিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত সুরক্ষাকে পাশ কাটানোর ক্ষমতা অর্জন করবে, এই হুমকিও রূপ নিচ্ছে বাস্তবে। এই অবস্থায় অভিযোজিত ভাইরাসের ধরনগুলো প্রতিরোধে দীর্ঘকালীন যুদ্ধ জয়ের সম্ভাব্য সমাধান দেখাচ্ছে বৈশ্বিক ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্টদের তুলনায় বেশ ছোট একটি ফরাসী জৈবপ্রযুক্তি কোম্পানি- ভ্যালনেভা এসই।
ভ্যালনেভা এমন একটি টিকা নিয়ে গবেষণা করছে যা অন্য সংস্থার প্রতিষেধকের তুলনায় কার্যকরভাবে ভ্যারিয়ান্ট প্রুফ হতে পারে। প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী ৩০ লাখের বেশি জীবন কেড়ে নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে বলছেন, রোগটি নির্মূলে ভাইরাসের অভিযোজিত ধরনগুলোর বিস্তার রোধ করতে হবে। তাই ফরাসী সংস্থাটির আবিষ্কার সফল হলে টিকাদানে আসবে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
প্রতিষেধকেটির তৃতীয় বা সর্বশেষ মানব ট্রায়াল কেবল শুরু হয়েছে, এবং চলতি সপ্তাহেই তাতে অংশ নেওয়া স্বেচ্ছাসেবীরা প্রথম ডোজ ইঞ্জেকশন নেবেন। ট্রায়াল সফল হলে চলতি বছরের শরতেই অনুমোদন পেতে পারে টিকাটি।
ওষুধ শিল্পের বৃহৎ সংস্থা ফাইজার বা মডার্নার মতো কোম্পানি যখন এমআরএনএ প্রযুক্তির মতো নতুন ও অভিনব পন্থার আশ্রয় নিয়েছে, ঠিক তখনই বহুল পরীক্ষিত ও প্রমাণিত একটি পদ্ধতির ওপর নির্ভর করছে ভ্যালনেভার গবেষণা। সম্পূর্ণ সার্স কোভ-২ ভাইরাসের নিষ্ক্রিয় ধরন ব্যবহার করছে তারা, ইউরোপে এই প্রযুক্তির কোভিড টিকার ট্রায়াল একমাত্র ভ্যালনেভাই করছে।
শতাব্দী প্রাচীন এ পদ্ধতিতে রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের একটি মৃত বা নিষ্ক্রিয় নমুনাকে ব্যবহার করে কোনো রকম ইনফেকশন সৃষ্টি না করেই মানবদেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সংক্রমণ প্রতিরোধের বিরুদ্ধে সক্ষম করে তোলা হয়। এমনভাবে তৈরি টিকাকে বলা হয় ইন-অ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিন, যা অতীতে ফ্লু এবং পোলিও ভাইরাস প্রতিরোধ করতে সফলতা দেখিয়েছিল।
ইউরোপে অনুমোদিত প্রায় সকল টিকাতেই সার্স কোভ-২ ভাইরাসের দেহাবরণে থাকা কাঁটা সদৃশ অংশ বা স্পাইকের প্রোটিন ব্যবহার করা হয়েছে। নতুন ধরনের কারণে এসব টিকার প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়লে তখন বুস্টার শট বা কার্যকারিতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে সেরা সমাধান হতে পারবে ভ্যালনেভা প্রতিষেধকের ডোজ প্রদান।
ইতোমধ্যেই, যুক্তরাজ্যে ১৯ কোটি ডোজ রপ্তানির চুক্তি করেছে কোম্পানিটি। এব্যাপারে যুক্তরাজ্যের ভ্যাকসিন টাস্কফোর্সের সাবেক প্রধান কেট বার্মিংহাম জানান, সবশেষ ট্রায়ালে টিকাটি নিরাপদ ও ফলপ্রসূ প্রমাণিত হলে, আগামী শীতে এটি বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে বুস্টার শট হিসেবে দেওয়া হতে পারে।
"ভাইরাসের সম্পূর্ণ দেহ ব্যবহার করে তৈরি ভ্যাকসিনের সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অণুজীব মাত্রই অভিযোজনশীল, তাই স্পাইক প্রোটিন থেকে তৈরি প্রতিষেধক নেওয়াদের মধ্যেও নতুন ধরন থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা একমাত্র এ ধরনের টিকাই দিতে পারে।"
কোভিড পরবর্তী বিশ্বে স্বাস্থ্য সেবা খাতের জটিলতা হয়ে উঠেছে গুরুতর। গবেষণার পুঁজি সংগ্রহে চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের নাসডাক বাজারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ১০ কোটি ডলার তহবিল সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে ভ্যালনেভা, বিনিয়োগ আকর্ষণের এই বাজিতে ব্যর্থ হলে নিঃসন্দেহে বাড়বে তাদের বাণিজ্যিক ঝুঁকি। আবার সফল হলে শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতেই ১৭০ কোটি ডলারের ব্যবসা করবে তারা, যা কিনা সংস্থাটির গেল বছরের বার্ষিক আয়ের চেয়ে ১০গুণ বেশি।
আজ বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) দেওয়া এক বিবৃতিতে কোম্পানিটি জানায়, আইপিওতে তারা ৭১ লাখ শেয়ার বিক্রি করবে। সংগৃহীত অর্থ ভ্যাকসিন গবেষণাসহ পাইপলাইনে থাকা অন্যান্য পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হবে।
তবে নিষ্ক্রিয় ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হওয়ায় সফলতার পথটিও বেশ দুর্গম। তাছাড়া, ইতোমধ্যেই বাজারে আসা অন্যান্য ভ্যাকসিনগুলোর তুলনায় অনেক পরে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বিতরণ হবে ভ্যালনেভার টিকা। যেমন; যুক্তরাজ্যে যখন এর অ্যাডভান্স ট্রায়াল শুরু হবে ততোদিনে সেখানকার অর্ধেক জনসংখ্যা অন্য কোম্পানির টিকা পেয়ে যাবে।
বাণিজ্যিক এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই ভ্যালনেভার প্রার্থী টিকার ট্রায়ালে স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে প্লেসেবো বা অন্য ওষুধের নির্যাসের বদলে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি টিকা দেওয়া হবে। দুই ভ্যাকসিনের তুলনামূলক কার্যকারিতা তুলে ধরার জন্যেই নেওয়া হয়েছে এ পদক্ষেপ। বাণিজ্যিক সফলতার জন্য অবশ্যই ফরাসী সংস্থার প্রতিষেধককে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার সমান বা তার চাইতেও ভালো প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করতে হবে।
"সফলতার সম্ভাবনা বা ব্যর্থতার ঝুঁকি ছাড়া কোনো গবেষণা নেই, কিন্তু সত্যি বলতে কি বিফলতার কথা আমি ভাবতেও চাই না," বলছিলেন ফরাসী সংস্থাটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা থমাস লিঙ্গেলবাখ। আর ৫৭ বছরের এই কর্মকর্তা তার ঝুঁকি নেওয়ার সহজাত ক্ষমতার জন্যেই পরিচিত। সবকিছু প্রত্যাশামাফিক চললে এবং সত্যিকার অর্থেই ভাইরাসের নতুন ধরন ঠেকানোর মতো টিকা বাজারে আনতে পারলে- এই ঝুঁকির বহুগুণ আর্থিক পুরস্কার ও খ্যাতি দুইই পাবেন তিনি।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ