ভারতবর্ষের টেলিগ্রাফম্যান!
বড়বাজার—কলকাতার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। নতুন কেউ জায়গাটায় গেলে অসংখ্য গলি-উপগলির গোলকধাঁধায় হারিয়ে যেতে পারে। এক বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই জায়গাটাতে সম্ভবত কলকাতার সবচেয়ে বেশি মানুষ পায়ের ধুলো দেয়। বড়বাজারের অসংখ্য গলি-উপগলির একটি শিব নন্দী লেন। এই রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে ভারতবর্ষের 'টেলিগ্রাফম্যান' শিবচন্দ্র নন্দীর নামানুসারে।
শিবচন্দ্র নন্দীর এই নামের মাহাত্ম্য বোঝার আগে ভারতবর্ষে দীর্ঘ দূরত্বে যোগাযোগব্যবস্থার পটভূমি জেনে নেওয়া দরকার। তার আগে দু-এক কথায় জেনে নেওয়া যাক টেলিগ্রাফ সম্পর্কে। 'টেলিগ্রাফি' মানে হলো লম্বা দূরত্বে কোনো বার্তা পাঠানো, আর এই বার্তা পাঠানোর কাজটি যে যন্ত্রের সাহায্যে করা হয়ে সেটির নাম 'টেলিগ্রাফ'।
টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের আগে লম্বা দূরত্বে বার্তা আদান-প্রদানে করতে অনেক সময় লাগত। আঠারো শতকে লন্ডন থেকে কলকাতায় একটা চিঠি পৌঁছতে সময় লাগত ৪৪ দিন। এই যোগাযোগ-সমস্যার সমাধান করতে ১৭৯২ সালে ফ্রান্সে আবিষ্কৃত হয় অপটিক্যাল টেলিগ্রাফ। পরবর্তীতে উপনিবেশিক ভারতে অপটিক্যাল টেলিগ্রাফের আমদানি করে ব্রিটিশরা। কিন্তু বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ আবিষ্কৃত হওয়ার পর সেসব বাতিলের খাতায় নাম লেখায়।
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতবর্ষে কাছাকাছি সময়ে আবিষ্কৃত হয় টেকসই বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ। ১৮৩৭ সালে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রে বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ আবিষ্কার করেন স্যামুয়েল মোর্স। এর দু-বছর পরই ১৮৩৯ সালে কলকাতায় একই আবিষ্কার করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইরিশ চিকিৎসক উইলিয়াম ব্রুক ও'শনেসি।
১৮৩৫ সালে ও'শনেসি কলকাতা মেডিকেল কলেজে রসায়ন ও মেটিরিয়া মেডিকার প্রথম অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। এছাড়া মিন্ট মাস্টার, কেমিক্যাল এক্সামিনার অভ মিন্ট এবং এশিয়াটিক সোসাইটির জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবেও কাজ করেছেন।
'জার্নাল অফ এশিয়াটিক সোসাইটি'র বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত বহু প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ও'শনেসি নানা বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, বিশেষ করে গ্যালভানিক ব্যাটারি তৈরি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন।
১৮৩৯ সালে 'ইকুইটেবল' নামে একটি জাহাজ 'ফলতা স্যান্ডস'-এর কাছে ডুবে যাওয়ার পর নৌচলাচলে খুব সমস্যা দেখা দেয়। ওই ডুবন্ত জাহাজের মধ্যে বারুদ রেখে বৈদ্যুতিক উপায়ে সেটিতে আগুন ধরিয়ে দেন ও'শনেসি। প্রবল বিস্ফোরণে জাহাজটি চুরমার হয়ে যায়। ফলে মুক্ত হয়ে যায় নৌচলাচলের পথ।
বোটানিকাল গার্ডেনে ২১ মাইল লম্বা তার খাটিয়ে তার দুটোর দুই প্রান্তের মধ্যে সংকেত বিনিময়ে সফল হন ও'শনেসি। কিন্তু এই সাফল্যের পরও তাকে দশ বছরের বেশি সময় চুপচাপ বসে থাকতে হয়। কারণ কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত লাইন বসাবার টাকা মঞ্জুর করছিল না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
লাইন বসানোর অনুমতি পাওয়ার দশ মাসের মধ্যেই ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ও'শনেসির নেতৃত্বে ভারতবর্ষে প্রথম বৈদ্যুতিক লাইনের প্রথম অংশের কাজ শেষ হয়। এই ও'শনেসিরই আবিষ্কার শিবচন্দ্র নন্দী।
প্রথম টেলিগ্রাফ লাইন পাতার শুরু থেকেই এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শিবচন্দ্র। ১৮৪৬ সালে শিবচন্দ্র যোগ দেন কলকাতার টাঁকশালের রিফাইনারি বিভাগে। তার কারিগরি দক্ষতা ও'শনেসির নজর কাড়ে। অচিরেই শিবচন্দ্র হয়ে ওঠেন ও'শনেসির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কর্মী।
'কলের শহর কলকাতা' বইয়ে সিদ্ধার্থ ঘোষ বলেছেন, সংগত কারণেই শিবচন্দ্র নন্দীকে প্রথম ভারতীয় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বলা যায়। যাহোক, কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত ৯০০ মাইল টেলিগ্রাফ লাইন পাতার কাজ তদারকির দায়িত্ব চাপে শিবচন্দ্রের কাঁধে।
কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত লাইন স্থাপনের কাজের সবচেয়ে দুঃসাহসী ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রমত্ত পদ্মা দিয়ে লাইন নেওয়া। মাটির ওপর দিয়ে তার টানা যাবে না, সাবমেরিন কেব্ল পাততে হবে পদ্মার পানির নিচ দিয়ে। কোনো স্টিমার কোম্পানিই দশ হাজার টাকার কমে এ কাজ করতে রাজি হচ্ছিল না।
সে সময়ই আবির্ভূত হন শিবচন্দ্র নন্দী। নিজের জীবন বিপন্ন করে, জেলেদের ডিঙি ভাড়া করে ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে দ্রুতগতিতে পদ্মার বুকে সাত মাইলব্যাপী সাবমেরিন কেব্ল পাতার কাজ সম্পন্ন করলেন খুব অল্প খরচে।
শিবচন্দ্রের দুঃসাহসিকতা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ভূয়সী প্রশংসা করে হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ লিখেছেন, 'বহু লোকের কীর্তিনাশ করিয়া যে পদ্মা কীর্তিনাশা নাম লাভ করিয়াছিল, সেই পদ্মায় ৭ মাইল "কেব্ল" স্থাপনের কার্য শিবচন্দ্র যেরূপ অল্প ব্যয়ে সুসম্পন্ন করিয়াছিলেন, তাহা বিস্ময়কর।'
একদিন তার খাটানোর জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজতে বেরিয়েছেন শিবচন্দ্র। গভীর মনযগে জায়গা দেখতে দেখতে আচমকা পা ঢুকিয়ে দিলেন চোরাবালিতে। সেবার সঙ্গীদের জন্য কোনোমতে প্রাণে বেঁচে ফেরেন তিনি।
আরেকবার শিবচন্দ্র গিয়ে পড়েছিলেন অজগরের সামনে। কিছু উদ্ধত ইংরেজ সৈনিক তাকে খুন করার ষড়যন্ত্র আঁটে। কিন্তু প্রখর বুদ্ধির জোরে সেই চক্রান্ত বানচাল করে দেন শিবচন্দ্র।
টেলিগ্রাফের লাইন বসাতে নিজের সৃজনশীল ক্ষমতার সফল প্রয়োগ করেন শিবচন্দ্র। টেলিগ্রাফের তার বসাতে তালগাছের গুঁড়ি ব্যবহারের সিদ্ধান্তই তার উদ্ভাবনী শক্তির সাক্ষ্য দেয়। বিদ্যুতের তার খাটানোর জন্য সে সময় ইংল্যান্ড থেকে লোহার খুঁটি আনানো হত। এতে লেগে যেত দীর্ঘ সময়, খরচ হতো বিস্তর টাকা। এই সমস্যা সমাধানে তালগাছের গুঁড়িকে লোহার খুঁটির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করেন শিবচন্দ্র।
১৮৫৭ সালের আগেই ইংল্যান্ডে চলে যান ও'শনেসি। তার জায়গায় আসেন কর্নেল স্টুয়ার্টও। কিন্তু তিনি সামরিক ব্যস্ততার কারণে টেলিগ্রাফ বিভাগে ঠিকমতো সময় দিতে পারেননি। সে কারণে টেলিগ্রাফ বিভাগের সমস্ত দায়িত্ব মূলত শিবচন্দ্রকেই সামলাতে হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরে শিবচন্দ্রের এই অবদানকে সম্মান জানিয়ে তাকে রায়বাহাদুর খেতাব দেয়।
১৯০৩ সালে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় নিজের বাড়িতে মারা যান শিবচন্দ্র। প্রযুক্তির উন্নয়নে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সেই টেলিগ্রাফ, তার সঙ্গে বিস্মৃত হয়েছেন শিবচন্দ্রও। এখন শুধু বড়বাজারের ছোট্ট গলি 'শিব নন্দী লেন'ই টিকে আছে তার স্মৃতি হয়ে।