ভাগ্যকুলের ঘোল খেলে দুধের স্বাদ সত্যি ভুলে যাবেন!
দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে পারুন আর না-ই পারুন, ভাগ্যকুল বাজারের ঘোলের স্বাদ যে দুধে মেটাতে পারবেন না সে কথা হলফ করে বলা যায়! মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল বাজারের ঘোল দেশের নানাপ্রান্তের ভোজনরসিকদের মনে স্থান করে নিয়েছে এর অভিনব স্বাদে।
ঢাকার আশেপাশে একদিনের ছুটিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আদর্শ গন্তব্য মুন্সিগঞ্জ। ঢাকার শিক্ষার্থী আর কর্মজীবীদের প্রিয় সপ্তাহান্তের পরিকল্পনার একটি হলো মাওয়া ঘাটে ইলিশ খেতে যাওয়া। পদ্মার তাজা ইলিশ খাওয়ার পাশাপাশি মিষ্টিপ্রেমীদের হৃদয় জুড়াতে চলে যেতে পারেন মাওয়ার অদূরেই ভাগ্যকুল বাজারে। পদ্মার পাড় ঘেঁষা জমজমাট এই বাজারে রয়েছে কয়েক দশক পুরনো বেশ কিছু মিষ্টির দোকান। দেশের সেরা ঘোল খেতে চাইলে এই দোকানগুলোতেই হানা দিতে হবে আপনাকে।
ভাগ্যকুল বাজারে অবস্থিত পাঁচ-ছয়টি মিষ্টির দোকানের সবগুলোতেই পাওয়া যায় অভিনব স্বাদের এই ঘোল। তবে ঐতিহ্যবাহী পুরোনো দোকানগুলোর মধ্যে চিত্তরঞ্জন সুইটমিট, আনন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ও গোবিন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার উল্লেখযোগ্য। চিত্তরঞ্জন সুইটমিটের মালিকপক্ষ থেকে অনীল আচার্য্য জানান এখানের বেশিরভাগ মিষ্টির দোকানই প্রায় ৬০-৭০ বছরের পুরোনো।
চিত্তরঞ্জন সুইটমিটের প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন আচার্য্য স্বাধীনতার আগে নাস্তার হোটেল হিসেবে তার ব্যবসার শুরু করেন। দোকানে মিষ্টি বানানো শুরু হয় ৩৫ বছর আগে থেকে। স্থানীয় ফার্ম থেকে প্রতিদিন দুধ সংগ্রহ করে সেখান থেকে নিজেরাই তৈরি করেন দই আর ছানা। খাঁটি এই দই দিয়ে তৈরি হয় ঘোল আর ছানা থেকে অন্য সব ধরনের মিষ্টি। আচার্য্য পরিবারের সবাই মিলেই দোকানের কাজ সামলান। বাবা মারা যাওয়ার পর সুভাষ আচার্য্য, অনীল আচার্য্য, আর সমীর আচার্য্য তিন ভাই মিলে দেখেন দোকান।
"আমাদের সব মিষ্টি একদম ফ্রেশ করে বানানো হয়। কোনো কেমিক্যাল মেশানো হয়না কখনো" বলেন সমীর আচার্য্য।
আনন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সমীর মোদক জানান মিষ্টির দোকানটি কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা মনে নেই। কিন্তু এটি তার দাদার আমলের দোকান।
"একশো বছরের পুরানো আমাদের দোকান, ভাগ্যকুল বাজারের প্রথমদিকের দোকানের একটি এটি," বলেন তিনি। ঘোলের পাশাপাশি তাদের বরফি, সন্দেশ, পুডিং, দই, রসমালাই বেশ বিখ্যাত বলে জানান তিনি।
ঢাকা থেকে এই দোকানে খেতে আসা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী নীতিশ দাস বলেন, "বিখ্যাত এই ঘোল খেতেই বিক্রমপুরে আসি আমি, ঢাকায় ফেরার সময় প্রতিবার এই বাজারের মিষ্টিও নিয়ে যাই ফ্যামিলির জন্য"। আনন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ঘোল, মিষ্টি সবই বানায় তাদের নিজস্ব কারিগর।
গোবিন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এই বাজারের বেশ পুরোনো দোকান। সকাল থেকেই জমজমাট ছিল দোকানের পরিবেশ। শ্রীনগর এলাকার স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান গোবিন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ঘোল খুবই বিখ্যাত। "এই দোকানগুলো ভালো লাগে কারণ এদের ঘোলটা খুবই ফ্রেশ থাকে। পিউর দুধ দিয়ে এরা দই বানায়। ঘোল বানানোর পুরো প্রসেসে কোনো মেশিন ইউজ করেনা। দই পাতা থেকে শুরু করে ঘোল সার্ভ করা পর্যন্ত সবকিছুতে তাদের নিজস্বতা বজায় রাখে," ভাগ্যকুল বাজারের ঘোল সম্পর্কে বলেন শ্রীনগরে ঘুরতে আসা ফাহিম।
এই তিন দোকান ছাড়াও ভাগ্যকুল বাজারের "ভাগ্যকুল মিষ্টিমুখ" ও "সঞ্জয় ঘি ও দধি ঘর" বেশ জনপ্রিয়।
সকাল ৭টা থেকেই দোকানগুলোতে মিষ্টি বানানোর কাজ শুরু হয়। ঘোল ছাড়াও এই দোকানগুলোর আকর্ষণের মূলে রয়েছে রসগোল্লা, চমচম, কালোজাম, সন্দেশ, ছানা, বরফি, দই, পুডিং সহ নানা ধরনের মিষ্টি। সকালে ১০-১১টার দিকে দোকানগুলোতে গেলে দেখতে পারবেন সরাসরি মিষ্টি বানানোর দৃশ্য। ছানা মেখে গোল করে টগবগিয়ে ফুটতে থাকা স্বচ্ছ্ সিরায় জ্বাল দিয়ে বানানো হয় রসগোল্লা। ভোজনরসিক না হলেও তখন গরম গরম রসগোল্লা খাওয়ার লোভ সামলে রাখা দায়!
দইয়ের সাথে পানি মিশিয়ে এক জগ থেকে আরেক জগে ঢেলে ঘোল বানানোর প্রক্রিয়াটা দেখাও বেশ উপভোগ্য। খাঁটি দইয়ের ঘোলের সাথে এক টুকরো লেবুর ঘ্রাণ মিশে আরো উপভোগ্য হয়ে উঠে ভাগ্যকুল বাজারের এই অমৃত পানীয়।
দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই ভোজন রসিকেরা ভিড় জমায় এই দোকান গুলোয়। প্রায়ই বন্ধের দিনে ভাগ্যকুল বাজারে ভীড়ের জন্য চলাফেরাই করা যায় না বলে জানান স্থানীয় এক বাসিন্দা। তবে এই খ্যাতির কিছু বিড়ম্বনাও পোহাতে হয় মিষ্টির দোকানীদের। গোবিন্দ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক বলেন, "ইদানীং ফুড ভ্লগার নাম করে ভিডিও করতে আসে অনেকেই। তারা খাওয়ার চেয়ে বেশি বিরক্ত করে। অনেকেই দামাদামিও করতে চায়। এতে আমাদের কাজে অনেক সমস্যা হয়।"
মিষ্টির পাশাপাশি ভাগ্যকুল বাজারে গিয়ে পদ্মার পাড়ের হোটেলে বসে সকালের নাস্তা বা দুপুর ও রাতের খাবারও খেতে পারবেন বেশ অল্প দামে। খেতে বসে হোটেলের জানলা দিয়ে পদ্মার চড়ে জেগে ওঠা কাশবন দেখে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা হলে নৌকা নিয়ে যেতে পারেন সেখানেও। বাজারের ঘাটেই পাওয়া যায় নৌকা।
ঢাকা থেকে সরাসরি ভাগ্যকুল বাজারে যাওয়া যাবে বাস বা নিজস্ব গাড়ি দিয়েই। গুলিস্তান থেকে শ্রীনগরগামী 'ভাগ্যকুল পরিবহন' বা 'আরাম' বাসে করে প্রথমে বালাশুর বাজারে নামতে হবে। সেখান থেকে অটো বা রিকশায় করে ভাগ্যকুল বাজারে যাওয়া যাবে। মোট ভাড়া পড়বে ১০০ টাকার মতো। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ভাগ্যকুল বাজারে যেতে সময় লাগে এক ঘন্টার কাছাকাছি।
আবার মাওয়া ঘাট থেকে অটোতে করেও যাওয়া যায় ভাগ্যকুল বাজারে। ভাড়া পড়বে ৫০ টাকার মতো।
মিষ্টিপ্রেমী না হলেও যেকোনো ভ্রমণপ্রেমীকেই ভাগ্যকুল বাজারের পরিবেশ মুগ্ধ করবে। ছুটির দিনের মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর ভ্রমণ আপনার স্মৃতির পাতায় যোগ করবে একটি স্নিগ্ধ ছবি।