ভবিষ্যতে ভ্যাকসিন দেয়া হতে পারে নাক দিয়ে!
বিজ্ঞানের অদমনীয় গতির ফলে ফাইজার, মডার্না কিংবা জনসন অ্যান্ড জনসন এর কোভিড-১৯ প্রতিরোধক টিকা মানুষকে নানা রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়ার পাশাপাশি কোভিডের শিকার হয়ে মৃত্যু থেকেও দূরে রাখছে। এই সবগুলো ভ্যাকসিনই ইনট্রামাসকুলার, অর্থাৎ এগুলো পেশির টিস্যুর মধ্য দিয়ে ইনজেকশন আকারে ঢোকানো হয়।
একবার ভ্যাকসিনের উপাদানগুলো রক্তপ্রবাহের সাথে মিশে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা অ্যান্টিবডি তৈরি করতে থাকে এবং এই অ্যান্টিবডিগুলো রক্তের সাথে সারা দেহে মিশে গিয়ে মানবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঙ্গকে সুরক্ষা দিতে থাকে, যাকে আমরা 'সিস্টেমেটিক ইমিউনিটি' বলে থাকি। এই ইমিউনের সাড়াদানই আমাদের দেহকে মারাত্মক অসুস্থতা ও মৃত্যু থেকে সুরক্ষা দেয়, কিন্তু এই সাড়াদান শুরু হয় শুধুমাত্র ভাইরাস পুরোপুরি মানবদেহে ঢুকে যাবার পর।
কোভিড-১৯ জনিত রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে এসব ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা চমৎকার হলেও SARS-CoV-2 ভাইরাস এরপরেও কোনো না কোন অরক্ষিত দিক দিয়ে শরীরে ঢুকে পড়তে পারে এবং তার মধ্যে রয়েছে- মুখ ও নাক। এই দুই 'গেটওয়ে'র মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমিত হতে থাকে এবং সে কারণেই মাস্ক পরার এত বাধ্যবাধকতা। মুখ ঢেকে রাখার ফলে ব্যবহারকারীর বা তার পাশের ব্যক্তির মধ্যে ভাইরাস ছড়াতে পারেনা বলে প্রমাণিত হয়েছে।
কিন্তু যদি একটি নতুন ইনট্রান্যাজাল বা অনুনাসিক ভ্যাকসিনই থাকে তাহলে কেমন হবে?
এর মানে হলো এই যে, নাক দিয়ে একটি ভ্যাকসিন নেয়ার ফলে শ্বাসযন্ত্রের অংশজুড়েই ওই ভ্যাকসিন বিস্তার করবে এবং সেখানে অ্যান্টিবডি তৈরি করবে। যদি এই কাজে সফল হয়, তাহলে এই ইমিউন প্রক্রিয়া ব্যক্তিকে অসুস্থ করতে যাওয়া ভাইরাসকে প্রতিরোধ করবে এবং একই সাথে নিঃশ্বাস বা কফ-কাশির সঙ্গে যেন ভাইরাস বেরিয়ে যেতে না পারে তাও নিশ্চিত করবে। শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীতে ইমিউনিটি রক্ষার চেষ্টায় এর আগেও মোটামুটি সফল হয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। তবে কোম্পানিগুলো এখনো ইনট্রান্যাজাল ভ্যাকসিনের বাজারজাতকরণ ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে এবং এটি বাজারে আসতে খুব সম্ভবত আরও বছরখানেক লেগে যাবে।
বর্তমানে যে ভ্যাকসিনগুলো রয়েছে, সেগুলো ইমিউনোগ্লোবুলিন সি বা আইজিজি ও কিলার টি নামক অ্যান্টিবডি বিচ্ছুরণের মাধ্যমে একটি ইমিউনিটি প্রক্রিয়া তৈরি করে। এই সেল ও প্রোটিনগুলো ভাইরাসকে আমাদের দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নষ্ট করে দেয়া থেকে প্রতিরোধ করতে অত্যন্ত কার্যকরী। কিন্তু প্রথম ধাপেই ভাইরাসকে মানবদেহে প্রবেশে বাধা দিতে বিজ্ঞানীরা এখন নাক দিয়ে ভ্যাকসিন নেয়ার বিষয়টির উপর নজর দিয়েছেন। এই শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর পুরো প্রক্রিয়ায় রয়েছে নাক ও মুখের ভেতরের পাতলা-নরম টিস্যু লাইনিং যা সেখান থেকে ধরে গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল ও পুনরুৎপাদনকারী এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে শ্লৈষ্মিক ঝিল্লী থেকে ঝরতে থাকা একটি বিশেষ অ্যান্টিবডি ভাইরাসসহ অন্যান্য খারাপ বস্তু শরীরে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখবে। শ্লৈষ্মিক শিল্লীতে থাকা এই বিশেষ অ্যান্টিবডির নামই ইমিউনোগ্লোবিন এ বা আইজিএ। ক্ষতিকর কোনো ভাইরাসের মুখোমুখি হলে শ্লৈষ্মিক ঝিল্লী থেকে আইজিএ নির্গত হয়ে একে বাধাদান করবে।
নাকের ভেতর দিয়েই যদি একটি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রবেশ করানো সম্ভব হয় তাহলে ক্ষতিকর ভাইরাস ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রে প্রবেশের আগেই মানবদেহ তাকে বাধা দিতে পারবে। এছাড়াও, পেশির মধ্য দিয়ে দেয়া ভ্যাকসিনের চাইতে নাক দিয়ে প্রবেশ করানো ভ্যাকসিন SARS-CoV-2 এর বিরুদ্ধে বর্তমান ভ্যাকসিনগুলোর চাইতে আরও এক ধাপ বেশি কার্যকরী হবে বলে জানুয়ারিতে 'সায়েন্স ট্রান্সলেশন্যাল মেডিসিন' এর প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভাইরাস প্রতিরোধী আইজিএ অ্যান্টিবডি তৈরির জন্যে ভ্যাকসিনকে অবশ্যই সংক্রমণের প্রাকৃতিক পথেই প্রবেশ করাতে হবে। অর্থাৎ, ভ্যাকসিন দিতে হবে নাক দিয়ে একটি স্প্রের মাধ্যমে যাতে তা শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর ভেতরে চলে যায়।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজিস্ট মিক্যাল টাল বলেন, যেসব কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দেয়া হয় তা শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর জায়গাতে খুব বেশি অ্যান্টিবডি প্রতিরোধ দিতে পারেনা। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় সংক্রমণের শুরুতেই শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীতে একটি প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। কিন্তু যারা এই ইমিউনিটির জন্য ভ্যাকসিনের উপরেই নির্ভর করে আছেন, তাদের ক্ষেত্রে নাক দিয়ে আইজিএ পরিপূরক ভ্যাকসিন দেয়া একটি অধিক কার্যকরী উপায় হতে পারে।
টাল এর মতে, নাক দিয়েই যখন ভাইরাস ঢুকে ও বের হয়, তখন সেই জায়গাকে সুরক্ষিত করতে হলে আইজিএ দরকার হবেই।
- সূত্র-স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন