বিশ্ব ব্যাংকার বাংলার জগৎ শেঠ

দেশের ব্যাংকিংখাতে এখন জমছে খেলাপি ঋণের পাহাড়। এর সঙ্গে তারল্য সংকট আর অর্থ পাচারের প্রবণতা যোগ হয়ে তা এখন দেশের ব্যাংকিংখাতের জন্য গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে।
স্বাভাবিকভাবেই এই খাতের বর্তমান হাল কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশাও দেখাচ্ছে না। তবে তিনশ' বছর আগে অবশ্য পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। প্রাচীন বাংলার ব্যাংকিং খাত যে ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করতেন, তিনি জগৎ শেঠ। আসলে জগৎ শেঠ একটি সম্মানজনক উপাধি, তার আসল নাম ফতেহ চান্দ।

তবে জগৎ শেঠ নামটি শুনলেই সচেতন পাঠকের মনে এমন ব্যক্তির চরিত্র ভেসে ওঠে যিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেছিলেন।
সমালোচনা ও নিন্দার ঝড়ে অনেক সময় ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সত্যও চাপা পড়ে। এমনই এক সত্য হল পুঁজি সঞ্চালন ব্যবসা এবং বাণিজ্যে জগৎ শেঠ ও তার পরিবারের নিপুণ দক্ষতার ইতিহাস। শুধু বাংলায় নয়, যখন পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছিল না, তখন এই পরিবার নিজেদের দক্ষতা ও দূরদর্শিতার জোরেই দেশ-বিদেশের ব্যবসায়িদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল।

অবিভক্ত বাংলা ছিল মুঘল ভারতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল। আর বাংলার অর্থনীতির অর্ধেকটাই নিয়ন্ত্রণ এই বণিক পরিবারের সদস্যরা। নিজেদের প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়েই তারা নবাবদের আর্থিক উপদেষ্টা হয়ে উঠেছিলেন।
জগৎ শেঠ পরিবারের জৌলুশ সবচেয়ে বেশি বাড়ে তার পূর্বপুরুষদের হাত ধরে। ফতেহ চান্দ ছিলেন এমনই একজন পূর্বসুরি, যার জীবদ্দশায় পারিবারিক ক্ষমতা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও বিস্তার লাভ করে।

তবে এই যে পুঁজি লগ্নি ও তা সফলভাবে আদায়ের ব্যবসা সেটা শুরু হয় ফতেহ চান্দের পূর্বসূরি হিরান্দ চান্দের হাত ধরে। অলংকার ব্যবসায়ী থেকে পুঁজি লগ্নির ব্যবসায়ী হয়ে ওঠা হিরান্দ চান্দ ছিলেন রাজস্থানের নাগুয়ার শহরের বাসিন্দা । উন্নত জীবিকার সন্ধানে তিনি সেখান থেকে বিহারের পাটনায় আসেন।
সেই সময়ে পাটনা ছিল বাংলার নবাবদের শাসনাধীন এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা কেন্দ্র। নদীপথের যোগাযোগে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপুল সুবিধা থাকার কারণেই পাটনা ছিল খুবই সমৃদ্ধ। এখানে এসেই আর্থিক ব্যবসায় একজন সফল লেনদেন ব্যবস্থাপক হিসেবে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেন হিরান্দ।

তারই যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন ফতেহ চান্দ, যিনি আর্থিক ব্যবসার ব্যবস্থাপনায় অতুলনীয় দক্ষতা দেখান। এমনকি নানাখাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগের বিস্তৃত নেটওয়ার্কও গড়ে তুলেছিলেন। একজন সফল পুঁজি সরবরাহকারী হিসেবে তার সুনাম সারা ভারতেই ছড়িয়ে পড়েছিল। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরে তার সুদক্ষ নেটওয়ার্কের কারণেই তৎকালীন মুঘল সম্রাট মাহমুদ শাহ ফতেহ চান্দকে ডেকে পাঠান এবং তাকে জগৎ শেঠ বা 'বিশ্বের ব্যাংকার' উপাধিতে ভূষিত করেন। ফতেহ উপাধি পেলেও সেকালের রীতি অনুসারে তার সকল বংশধর এই উপাধি ব্যবহার করতেন।

মুদ্রা ব্যবসাতেও ফতেহ চান্দ ছিলেন আধুনিক ব্যাংকিংয়ের পথিকৃৎ। মুদ্রা ছাপানো,বিনিময় হার নির্ধারণ, স্বর্ণ ক্রয়, বিনিয়োগের সুদ আদায়, সুদহার নির্ণয় এক স্থান থেকে অন্যস্থানে অর্থ পাঠানো, বিদেশি বণিকদের সঙ্গে লেনদেন প্রভৃতি কাজে তার মতো দক্ষ কেউ ছিল না। খোদ মুঘল বাদশাহ থেকে শুরু করে ছোটখাটো জমিদার সবাই জগৎ শেঠ পরিবারের কাছে টাকা ধার নিতেন। আবার অনেক সময় তার ব্যবসায় বিনিয়োগও করতেন। এসব কার্যক্রম আজেকের দিনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সঙ্গেই বেশি মেলে।

রাজারাজরাদের কোষাধ্যক্ষ এবং ব্যাংকার হিসেবে সুনাম অর্জন করে এই পরিবার দিন দিন আরও ক্ষমতাধর হয়ে উঠছিল। তাদের আর্থিক প্রভাবকে তখনকার দিনে ইউরোপের রথসচাইল্ড পরিবারের সঙ্গেই তুলনা করা হতো। খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই ছিল জগৎ শেঠের অপর বৃহৎ গ্রাহক। নবাবী শাসনামলে তারা ভারতের মুর্শিদাবাদে মহল নির্মাণ করেছিলেন।

আর সম্পর্ক সুনজরে দেখেননি বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। তিনি জগৎ শেঠ পরিবারের ক্ষমতা হ্রাস করার উদ্যোগ নেন। এটাকে নিজেদের প্রভাবের প্রতি হুমকি হিসেবেই নেন তৎকালীন দুই জগৎ শেঠ, যারা ছিলেন সহোদর ভাই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও মীর জাফরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সাহায্য করেন ।

নবাব পরিবর্তনের আনন্দ অবশ্য জগৎ শেঠ পরিবার বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি। মীর জাফর নবাব হিসেবে একজন অযোগ্য, অলস এবং ভোগবাদি চরিত্রের পরিচয় দিলে কোম্পানি তার জামাতা মীর কাশিমকে ক্ষমতায় বসায়। দেশপ্রেমিক মীর কাশিম ক্ষমতায় এসেই এক নির্দেশে তিনি দুই শেঠকে গুপ্তহত্যা করার নির্দেশ দেন। আর এভাবেই বাংলার ইতিহাসে জগৎ শেঠ পরিবারের অগাধ প্রতিপত্তির সময়ের অবসান ঘটে।
