বিপদে পড়লে জমে যাওয়ার অনুভূতি হয় কেন?
ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনার পর, ভুক্তভোগী যখন এক সময় সামনে এসে ঘটনা প্রকাশ করেন, কিংবা ঘটনা ঘটার বেশ অনেক সময় পর বিচার চাওয়ার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হন- এ ধরনের ঘটনায় তীর্যক কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দেন অনেকেই, করে বসেন নানা ধরনের মন্তব্য।
সম্প্রতি বনানীর রেইন ট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার বিতর্কিত রায় ও পর্যবেক্ষণের পরও এ ধরনের কিছু কথা লোখমুখে ভেসে বেড়াচ্ছে, 'আলোচনা' চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার তিন দিনের মধ্যে মামলা করার বিষয় তুলে মন্তব্য করেন, '৩৮ দিন পর এসে তারা বললো 'রেপড হয়েছি', বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তার বিবেচনা করা উচিৎ ছিল।'
'ভুক্তভোগী কেন ঘটনার সময় আত্মরক্ষার চেষ্টা করেনি?', 'ঘটনার পর পরই কেন বিষয়টি জানায়নি?' এমন প্রশ্ন শুধু এ ঘটনায় না, ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়ন সম্পর্কিত ঘটনাগুলোতে এ ধরনের প্রশ্ন অহরহ শোনা যায়।
শুধু তা-ই নয়, ছিনতাইকারীর আক্রমণ বা অতর্কিত হামলার পরও অনেকের মনে হতে পারে ঘটনায় সময় কিছু করলাম না কেন? অনেকে তো প্রশ্নও করে বসেন, 'তুমি এভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?'
ভুক্তভোগী কখনো হয়তো আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। আবার কখনো বা একেবারেই জমে যান, মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছে না বা শরীর নাড়াতে পারছেন না এমন অনুভূতি হয়। অনেকে এভাবে বলে থাকেন, আমি চিৎকার করছিলাম, কিন্তু আওয়াজ বের হচ্ছিল না! এ ধরনের জমে যাওয়ার অবস্থাকেই বলা হয় 'ফ্রিজিং রেসপন্স'।
এ ধরনের অবস্থায় ঠিক কী হতে পারে? বা কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায় মানুষের মধ্যে? ফ্রিজিং রেসপন্স দেখা গেলে মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল অনুভূত হতে থাকে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। অনেকে আবার একেবারেই শরীর নাড়াচাড়া করতে পারে না। অনেক সময় ভুক্তভোগীরা এ সময় কোনো ধরনের অনুভূতিই অনুভব করেন না। 'ব্ল্যাংক' বা 'নাম্ব' অনুভূতি হয়- এমনভাবে বিষয়টির বর্ণনা দিয়ে থাকেন অনেকে। বাস্তবতা থেকে অন্য কোথাও আছে, এমন অনুভূতিও হতে পারে। অনেকের মনে হতে পারে এসব ঘটনার কিছুই বাস্তবে ঘটছে না।
এ অবস্থাটি বুঝতে হলে মানুষের মস্তিষ্কের গঠন, বিপদের সময় মস্তিষ্কের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে এ দিকে নজর দিতে হবে।
মানুষ কোনো ভীতিকর পরিস্থিতিতে পড়লে মস্তিষ্কের অ্যামিগ্লাডায় প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। মানব মস্তিষ্কের এ অংশই বিভিন্ন অনুভূতি ও অনুভূতি তাড়িত আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। ভয়ের মতো অনুভূতির সঞ্চারও হয় মস্তিষ্কের এ অংশেই। অ্যামিগ্লাডা মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে সিগন্যাল পাঠায়। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমকে (স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র) উদ্দীপিত করে।
অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম সিমপ্যাথেটিক ও প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম নিয়ে গঠিত। সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমের প্রতিক্রিয়ায়ই বিরূপ পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে জমে যাওয়ার অনুভূতি হয়। বিপদে পড়ার মুহূর্তে এরমধ্যে কোন তন্ত্র অধিক সচল ছিল, তার ওপর নির্ভর করে ওই মানুষের মধ্যে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে।
অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেম উদ্দীপিত হলেই শরীরে অ্যাড্রেনালিন ও কর্টিসল হরমোন নিঃসরণ হয়। কর্টিসলকে বলা হয় স্ট্রেস হরমোন। তড়িৎবেগে এ হরমোন নিঃসরণ হয়। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস, হার্টবিটে এর প্রভাব পড়ে। মস্তিষ্কের নির্দেশে শরীরে এমন কিছু পরিবর্তন আসে যা মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, হঠাত করেই হার্টরেট কমে যায়।
মস্তিষ্কের এই ফ্রিজিং রেসপন্স তৈরি হওয়ার পেছনের কী কী কারণ থাকতে পারে তা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে।
২০১৭ সালে দ্য রয়্যাল সোসাইটি জার্নালে প্রকাশিত 'ফ্রিজ ফর অ্যাকশন: নিউরোবায়োলজিকাল মেকানিজমস ইন অ্যানিমাল অ্যান্ড হিউম্যান ফ্রিজিং' শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, ফ্রিজিং রেসপন্স দেখা গেলে সে সময় মানুষের মস্তিষ্ক চলমান বিপদের বিরুদ্ধে কেমন ব্যবস্থা নেবে, বা ঠিক সেই কী করবে এ সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত হয়।
২০১৫ সালে 'জার্নাল অব এক্সপেরিমেন্টাল সাইকোলজি: জেনারেল' এ প্রকাশিত 'ফ্রিজিং প্রমোটস পারসেপশন অব কোয়ার্স ভিজ্যুয়াল ফিচারস' শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ফ্রিজিং এর ফলে ব্যক্তি তার আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা পায়। ভীতিকর পরিস্থিতিতে মানুষ কীভাবে আশপাশের দৃশ্যের ব্যাপারে ধারণা নেয় তার পরীক্ষা চালিয়েছেন গবেষকরা।
মানুষের মস্তিষ্ক আবার অনেক সময় ভয়াবহ কোনো ঘটনার তীব্রতা অনুভূতি থেকে মুক্তি পেতে চায়। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হার্ভার্ড রিভিউ অব সাইকিয়াট্রি জার্নালে প্রকাশিত 'ফিয়ার অ্যান্ড ডিফেন্স ক্যাসকেড: ক্লিনিক্যাল ইমপ্লিকেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট' শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো একটি ঘটনার ভয়াবহতার তীব্রতা অনুভূত হওয়া থেকে রক্ষা পেতে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ও অসাড় অনুভূতির সঞ্চার হয়। আগে কোনো ধরনের বাজে ঘটনার অভিজ্ঞতা আছে, এমন মানুষের মধ্যে তাই এ ধরনের ফ্রিজিং রেসপন্স ও অসাড় অনুভূতির সঞ্চারণ বেশি দেখা যায়।
ফ্রিজিং রেসপন্স পরবর্তী অবস্থায় ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন ধরনের আচরণ দেখা যায়। ফ্রিজিং রেসপন্সকে বলা চলে বিপদে পড়ার একেবারে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। এরপর দেখা যেতে পারে ট্রমা রেসপন্সসহ বিভিন্ন বিষয়।
মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, শৈশবের অভিজ্ঞতা অভিযোজন ক্ষমতাসহ অনেক কিছুর ওপরেই নির্ভর করে বিপদে পড়ার মুহূর্তে এবং এরপর মানুষ কেমন আচরণ করতে পারে। এমনকি অনেক সময় প্রকৃতপক্ষে বিপদের পরিস্থিতি তৈরি না হলেও, এ ধরনের পরিস্থিতির কোনো অনুভূতি বা দৃশ্যের সঙ্গে খুবই অল্প মিল আছে, এমন কিছু সামনে এলেও এমন অভিজ্ঞতা হতে পারে।