বাড়ি ফেরার পথে শুধু কাঁদি: কোভিড রোগীদের বাঁচাতে লন্ডনের স্বাস্থ্যকর্মীদের যুদ্ধ
শীতের নরম রোদ মাখানো লন্ডনের ইউস্টান রোডের ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতালের ছিমছাম পরিবেশে পা রাখলে প্রথম দিকে সব স্বাভাবিক বলেই মনে হবে। তবে ভিতরের ওয়ার্ডে পা দেওয়া মাত্র সব বদলে যাবে। এমন না যে ভিতরে কোনো উত্তেজনা বা, হইচই আছে। তবে পরিবেশটা একদম ভিন্ন। পা থেকে মাথা অবধি পিপিই জড়িয়ে ডাক্তার, নার্স আর হাসপাতালের কর্মচারীরা চারদিকে ছোটাছুটি করছে। কারও মুখে কোনো অভিযোগ নেই, কিন্তু চোখজুড়ে আছে গভীর মমতা। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টায় চলছে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম। কখনো তারা সফল হচ্ছেন; কখনো হচ্ছেন না।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেলেও বহু সময় ধরে স্মৃতিগুলো তাড়া করে ফিরবে। হাসপাতালের জানালা গলে নার্সের উদ্বিগ্ন চোখে পড়া রোদ আর ভেন্টিলেটরের অচেতন মানুষটিকে ভোলা সহজ না। এক তালে বিপ বিপ করে যাওয়া মনিটর আর যন্ত্রপাতির শব্দ, মাস্কে চাপা পড়া মৃদু ফিসফিসানি, অচেতন রোগীর সামনে মৃদু স্বরে ক্ষমা প্রার্থনা; কানে বাজতে থাকবে দীর্ঘ সময়।
ডক্টর বেন লাভেলঃ ইউসিএলএইচের একিউট মেডিকেল বিভাগের কনসালটেন্ট
"আমার ১৬ বছরের ডাক্তার জীবনে আমি এখনকার মতো পরিস্থিতি আর দেখিনি। আমরা আগের তুলনায় তিন থেকে চারগুণ বেশি রোগীকে ভর্তি করছি, কিন্তু আমাদের বাড়তি কোনো স্টাফ নেই। প্রতিদিন আমরা ভাবি আর নতুন রোগী নেওয়া সম্ভব হবে না। পরদিন আবার ঠিকই দ্বিগুণ সংখ্যক রোগীকে ভর্তি করি। জিনিসপত্রের এতো সংকট যে হাসপাতালের অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ে।"
"এখানে অনেক সংকটাপন্ন রোগী আসে, অনেকেই ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারে না। অনেকে এসেই তাদের অক্সিজেন মাত্রা বলেন, কিন্তু সেগুলো এত ভয়াবহ যে বলার মতো না। ঠিকমতো শ্বাস নিতে না পারাটা সবথেকে ভয়ংকর বিষয়। মানুষ এসময় মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে বোধ করতে পারে।"
"কিন্তু যখন আমরা শুনি তারা শ্বাস নিতে পারছেন না, আমাদের শান্ত থাকতে হয়। আমাদের এভাবেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। রোগীদের আমরা বলি, তারা এখন সুরক্ষিত এবং আমরা সাহায্যের জন্য প্রস্তুত। এরপর অক্সিজেন মাত্রা পরীক্ষা করে তাদের অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। পরবর্তীতে তাদের একিউট মেডিকেল ইউনিট বা ইনটেনসিভ ট্রিটমেন্ট বিভাগে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে আমরা কখনো প্যানিক করি না।"
"রোগীদের জন্য সবথেকে কার্যকরী হল উপুড় করে শোয়ানো। মানুষ যখন জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি লড়াই করতে থাকে আমাদের কাজ করে যেতে হয়। চোখের সামনে ওয়েটিং রুমের ছবি আসে। ট্রেন নিয়ে সহজেই এখান থেকে দূরে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু এখানকার নার্স, ডাক্তার, ফিজিওথেরাপিস্ট, নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং বহনকারী- সকলেই একটা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অক্লান্ত চেষ্টা করে যায়।"
"ভয়াবহ সময়েও হাসপাতাল ওয়ার্ডের শান্ত পরিবেশ এক ভৌতিক আবহের সৃষ্টি করে। অনেকেরই ধৈর্যের সীমা পার হয়ে যায়। ক্রিটিকাল কেয়ারের ৩৭ বছর বয়সী নার্স বেকি লেনন তাদেরই একজন। আমি তাকে দেখতাম সহকর্মীদের সাথে রোগীদের উপুড় হতে শুয়াতে সাহায্য করতে, তারা যাতে শ্বাস নিতে পারে সেজন্য সব রকমের চেষ্টা করতে। বেকি বুদ্ধিমান, সক্ষম এবং নিবেদিতপ্রাণ ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ইস্তফা জমা দিয়েছিল।"
এনেস্থেটিকের সহযোগী ক্রিস লেক প্রনিং দলের প্রধান। তার কন্ঠ দৃঢ় এবং পরিষ্কার।
"তিন পর্যন্ত গুণলে সোজা করবে। সাবাশ। এখন উত্তরমুখে পাঁচ ইঞ্চি। ধন্যবাদ," দলকে নির্দেশনা দিচ্ছিল ক্রিস।
"আমাদের দল যেভাবে একসাথে কাজ করছে, তাতে আমি বিমোহিত। পরিস্থিতি বিবেচনায়, মানুষের মনোবল অসাধারণ। ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার কাজ করে যাই। যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে, তখন শান্ত হই।"
একিউট মেডিসিন বিভাগের নীচতালায় শিফট শেষে সিনিয়র স্টাফ নার্স প্যাট্রিসিয়া বারাজোনাকে দেখা গেল। প্যাট্রিসিয়ার বন্ধুত্বপূর্ন চেহারায় তখনও পিপিই আর মাস্কের দাগ স্পষ্ট।
প্যাট্রিসিয়া বারাজোনাঃ একিউট মেডিকেল ইউনিটের সিনিয়র স্টাফ নার্স
"আমি আর আমার সহকর্মীরা ১৯ বেডের এক ওয়ার্ডে কাজ করি। এই ওয়ার্ডটি নন-ইনভেনসিভ ভেন্টিলেশনে থাকা কোভিড রোগীতে ভরা থাকে। কখনো তারা এখান থেকেই সুস্থ হয়ে ওঠে, তবে অনেক ক্ষেত্রে তাদের ইনটেনসিভ ট্রিটমেন্ট বিভাগে স্থানান্তরিত করতে হয়। প্রথম ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টাই বেশি সংকটপূর্ণ। এসময় ঠিক করতে হয় কার কোন ধরনের পরিচর্যার প্রয়োজন। রোগীরা সাধারণত এক সপ্তাহ আমাদের এখানে থেকে কোভিড বিভাগে যায়। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও আমাদের অনেককেই চিরতরে হারাতে হয়।"
"মৃত্যুকে দেখা আমাদের পেশার অনিবার্য এক অংশ। মানুষ যখন তাদের শেষ সময় পার করে, আমরা তখন বেশ সহজ-স্বাভাবিক থাকি। আমার ব্যক্তিত্ব বেশ প্রবল, শারীরিক ক্লান্তিও আমাকে বশ করতে পারে না। কিন্তু এখনকার এই পরিবেশ, রোজ রোজ চোখের সামনে অজস্র মানুষের চলে যাওয়া আমাকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।"
"মাঝেমাঝে আমি দুঃস্বপ্ন দেখি। মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে যায় আর আমি ভেন্টিলেটরের এলার্মের শব্দ শুনি; যেন কারও অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেছে বা ইনফিউশন পাম্পের ওষুধ শেষ কিংবা হার্ট মনিটর বলছে কোনো গন্ডগোল হয়েছে।"
"কখনো কখনো আমরা কোভিড আক্রান্ত যুগলদের পাই। তাদের সামলানো খুবই কঠিন। সাধারণত তাদের আলাদা রাখা হয়, তারা পরস্পরের সাথে দেখা করতে পারেন না। আমার এক ৭০-৮০ বছরের যুগলের কথা মনে আছে। কয়েকদিন পর তাদের ছেলেও এখানে ভর্তি হয়েছিল। সবাই কোভিডে আক্রান্ত ছিল। ছেলেটা বেঁচে গেলেও তার বাবা-মা দু'জনকেই হারায়। সে তাদের সাথে থাকত এবং তাদের দেখাশোনা করত। চাইলেও আমরা তার জন্য; তাকে ভালো বোধ করানোর জন্য কিছুই করতে পারিনি। বাবা-মা দু-জনকে একসাথে হারানো, সত্যি খুব হৃদয়বিদারক।"
অ্যালিসন গর্ডনঃ ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটের স্পেশাল রেসপিরেটরি ফিজিওথেরাপিস্ট
"আমি এবং আমার দল একই সাথে সুস্থ হতে থাকা এবং ভেন্টিলেশনের কোভিড রোগীদের দেখে থাকি। তারা যখন ভেন্টিলেশনে থাকে, আমরা তাদের শ্বাসনালী পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করি। যেসব রোগীদের ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয় এবং যারা নড়তে পারেন না আমরা দুই হাত দিয়ে তাদের ডায়াফ্রাম সঞ্চালনের মাধ্যমে কাশির অনুরূপ ব্যবস্থা করার চেষ্টা করি, শুধুমাত্র যাতে তাদের শ্বাস নিতে সুবিধা হয়।"
"আমরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ এমনকি মাসখানেক ধরে রোগীদের সাথে কাজ করি। ইনটেনসিভ কেয়ারের রোগীরা হাসপাতাল ছাড়ার পরও ১২-১৮ মাস তাদের পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। যখন তারা পুনরায় হাসপাতালে চেকআপ করাতে আসেন, আমাদের সত্যি খুব ভালো লাগে।"
"আমরা যখন শেষ পর্যন্ত কাউকে হাসপাতাল ছাড়তে দেখি, আমাদের খুব আনন্দ হয়। আমরা এটাকে বলি "পুনর্বাসন উৎসব"। বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনে আমি অনেক কাঁদি। আমি এটাকে বলি "ট্রেনের কান্না"। তবে বাড়িতে ঢুকার আগেই মুখে হাসি আনি, বাচ্চাদের সামনে মা কাঁদলে চলে নাকি!"
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
- ভাষান্তর: তামারা ইয়াসমীন তমা