বাবারাও শিখি: চাঁদ কত বড় হয়, স্কুলব্যাগ কখন কুশন হয়
কফির মগে লেখা আছে সুখী হবার মন্ত্র, টিশার্টে বাঘ আর হাতির ভাষা শেখার কৌশল, ব্যাগে ছাপা সুলতানার স্বপ্ন, এই ব্যাগ আবার পরিণত করা যায় নান্দনিক কুশন কভারে!
এগুলো সবই শিখির শিক্ষা উপকরণের অংশ। "বিশ্ব জোড়া পাঠাশালা মোর সবার আমি ছাত্র" মন্ত্রে বিশ্বাসী "শিখি"র কর্মীরা এরকম অভিনব নানা শিক্ষা উপকরণের মাধ্যমে বদলে দিতে শুরু করেছেন আমাদের শেখার ধারণাকেই। জানার আর শেখার আনন্দকে ছড়িয়ে দিতেই কাজ করে শিখি।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ব্যবহার্য নানা উপকরণকে শিখি সাজিয়েছে শিক্ষার বার্তা দিয়ে। প্রচলিত পাঠ্যপুস্তকগুলোর খটমটে পোশাকি ভাষার বদলে সহজ স্বাভাবিক কথা বলার ভাষায় নানা গল্পের মাধ্যমে সাজানো এসব উপকরণের সাথে সহজেই যেকোন বয়সী মানুষ সংযোগ স্থাপন করতে পারে। নিত্য প্রয়োজনীয় এসব উপকরণ পরিবারের সকলের মধ্যে ভাবনার খোরাকের জন্ম দিয়ে পরিণত হচ্ছে শিক্ষা উপকরণে।
শিখির অভিনব এই যাত্রা নিয়ে কথা হয় এর অন্যতম পরিকল্পনারী এহসান হাফিজের সঙ্গে। একইধারে একজন গবেষক, লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক, ডিজাইনার, নৃতাত্ত্বিক মাঠকর্মী হিসেবে কর্মরত এহসান হাফিজের শিক্ষাজীবন কেটেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে।
দেশের পাঠ্যপ্যুস্তকের কঠিন ভাষা আর স্কুলের একঘেয়ে পরিবেশে বর্তমান প্রজন্ম শেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে দেশের সুশীল সমাজের অনেকের মতো বসে না থেকে অবস্থা পরিবর্তনের "ইঞ্জিনিয়ারিং সলিউশন" নিয়ে ভাবতে থাকেন এহসান হাফিজ ও তার দল। কারণ অন্ধকারকে দূর করতে হলে তাকে ভয় পেয়ে বসে না থেকে আগে কোনো একজনকে আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। সে আলোই পথ দেখাবে অন্ধকার দূর করতে আগ্রহী আরো হাজারো জনকে।
আলোর পথের সন্ধানে থাকা শিখির দলের মূলে রয়েছেন এহসান হাফিজ ছাড়াও মো. ফয়সাল, মাহমুনুল হক, শফিউল ফারুখ উজ্জ্বল, মাহমুদুল ইসলাম ফরহাদ, মনু মাসুদ, কাজী বারিন, রঙতুলি শশী, নুরুল হক, শারমিন সুমি, খায়রুল হুদা খান।
পাঠ্যপুস্তকের কন্টেন্ট নিয়ে বিস্তর গবেষণার পর শিখির দলের মনে হয় "আমাদের এই বইগুলো মৃত"। যে বই মানুষের মধ্যে অনুভূতির সৃষ্টি করতে পারে না তা থেকে কোনো জ্ঞান লাভ করা যায় না। তাই তথ্য নির্ভর বই এর পরিবর্তে জ্ঞান নির্ভর বইয়ের প্রচলন করতে নতুন ধরণের বইয়ের কন্টেন্ট নিয়ে ভাবতে শুরু করেন তারা।
"শিশুরা আগামীর মানব। আগামী দিনের বিশ্বসমাজ পৃথিবীকেই দেশ মনে করবে। সেই বিশ্বের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে আমাদের বাচ্চাদের। ভবিষ্যৎ সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা তাদের দিতে হবে"- বলেন এহসান হাফিজ। সেই আগামীর উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার শুরু করতে তাদের কর্মযজ্ঞকে শিক্ষা আন্দোলন বলে অভিহিত করেন তিনি।
জীবনের শুরু থেকে মানুষ যা দেখে তাই শেখে। তার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নানা উপকরণে যদি জীবনের নানা দিকের জ্ঞান তুলে ধরা যায় তবে মানুষ জীবন ঘনিষ্ট শিক্ষা পায় শুরু থেকেই। বড় হয়ে ওঠার প্রথম প্রতিষ্ঠান যেহেতু পরিবার তাই শিশুর বাবা-মাকেই শুরুতে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে হবে। তবেই একজন শিশু আগামীর জন্য উপযোগী শিক্ষিত মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারবে। বাবা-মা আর শিশু উভয়পক্ষই যেন একসাথে জ্ঞান অর্জন করে সঠিক পথে এগোতে পারে সে চিন্তা থেকেই ২০১৩ সালের দিকে এহসান হাফিজ তার বন্ধুদের সাথে মিলে "বাবা মা'র ইশকুল" নামে এক ফাউন্ডেশনের স্বপ্ন দেখেন। "শিখি" এই "বাবা মা'র ইশকুল" ফাউন্ডেশনেরই একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বলে জানান তিনি।
"বাবা মা'র ইশকুল" গড়ার পেছনে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাহলিল জিবরানের মতো ব্যক্তিত্বদের জীবন থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি বাবা মা'র ইশকুলের স্বপ্নকে অনেকটাই দিকনের্দশনা দেয় বলে জানিয়েছেন এহসান হাফিজ।
"বাবা মা'র ইশকুল" গড়ে তুলতে অনেক পরিকল্পিত কার্যক্রমের একটি হলো শিখি। ২০১৮ সাল থেকে শিখিকে রূপদানের পরিকল্পনা চলতে থাকলেও ২০২১ এর ফেব্রুয়ারী মাসে শিখির শিক্ষা উপকরণ সর্বসাধারণের জন্য প্রচার করা শুরু হয়। ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার বেঙ্গল বইয়ে দশ দিনব্যাপী ফাগুন মেলায় অংশ গ্রহণ করে শিখি। সেখানে বিষয়ভিত্তিক মগ, একটিভিটি বই ও খাতা, কুশন কভার-ব্যাগ-বই, চাঁদের ক্যালেন্ডার, পেইন্টিং, টি শার্ট, বুকমার্কসহ নানাধরনের বিচিত্র শিক্ষা উপকরণ প্রদর্শনী ও বিক্রির আয়োজন করে তারা।
কোন মাসের কোন তারিখে চাঁদ কত বড় হবে, পূর্নিমা কবে হবে- এসব তথ্য দিয়েই সাজানো শিখির চাঁদের ক্যালেন্ডার। "অভিব্যক্তি ও ভাষা" নামের "একটিভিটি বুক" এ আছে গল্পে গল্পে নানা অভিব্যক্তি ও ভাষার ব্যাখ্যা ও পার্থক্য। "একটিভিটি" খাতায় আছে সুন্দরবনের গল্প। আবার টিশার্টেও আছে বান্দরবান ও সুন্দরবনের গল্প, প্যাঁচা নিয়ে কবিতা, বাঘ-সিংহ-হাতির ভাষায় প্রাণীর সাথে বন্ধুত্বের গল্প। মগে আছে ষড়ঋতু, মেঘ-বৃষ্টিসহ নানা বিষয়ভিত্তিক গল্প।
কুশন-কভার-ব্যাগ-বই শিখির অন্যতম উদ্ভাবন। ব্যাগের গায়ে গল্পের বইয়ের মতো লেখা আর আঁকা থাকে রবীন্দ্রনাথ, সুন্দরবন, মেঘসহ নানাকিছুর গল্প। সে ব্যাগের ফিতা খুলে নিলেই তাকে ব্যবহার করা যায় কুশন কভারে! শিখির চমকপ্রদ সব উপকরণই সকল বয়সী মানুষের নতুন চিন্তার খোরাক যোগায়।
"বেঙ্গল বইতে দশদিনের সেই মেলায় আমরা খুব ভালো সাড়া পাই" বলেন এহসান হাফিজ। "সাধারণ অভিভাবক, শিশুদের আগ্রহ তো ছিলই, সরকারের সহযোগী হয়ে কাজ করার অফারও তখন পাই আমরা। কিন্তু নিজেরা এখনও প্রস্তুত না বলে সে প্রস্তাবে আপাতত সাড়া দেওয়া যায়নি।"
শিখিসহ "বাবা মা'র ইশকুল" ফাউন্ডেশনের আরও অনেক পরিকল্পনা এখনও প্রস্তুতি পর্বে রয়েছে। শেখার যাত্রাকে আনন্দময় করে তুলতে পারিবারিক, সামাজিক সংস্কৃতি তৈরির লক্ষ্যে সামগ্রিকভাবে কাজ করতে চায় তারা।
শিখির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি রিসার্চ ও আর্টিস্ট দল রয়েছে। "আমাদের রিসার্চ টিম প্রচলিত পাঠ্যপুস্তক বিশ্লেষণ করে বইগুলোর দূর্বলতা ও সেসবের বিকল্প ব্যবস্থা চিন্তা করেন। শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে তাদের মতামতও গ্রহণ করেন তারা। এরপর তারা ঠিক করেন কোনো ভাষায় বই বা শিক্ষা উপকরণ সাজালে সেটি সবার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে" – বলেন এহসান হাফিজ।
"রিসার্চ টিমের পরামর্শকে কাজে লাগিয়ে আর্টিস্টরা শিক্ষা উপকরণের ডিজাইনের কাজ করেন। কীভাবে শব্দ কমিয়ে ছবির মধ্য দিয়ে অর্থবহ গল্প বলা যায় তাই থাকে তাদের প্রধান চিন্তায়।"
প্রধান এগারোজনসহ বর্তমানে মোট ৩০ জন কাজ করেন শিখিতে।
বাবা মা'র ইশকুলের ভবিষ্যৎ কর্মযজ্ঞের পরিকল্পনায় আছে ক্লাসরুম, বাসা, হসপিটাল, অফিসসহ নানা "এডুকেটিভ" স্থান শিক্ষা উপযোগী করে ডিজাইন করা, শিশুদের জন্য শিক্ষা ও বিনোদনমূলক ভিডিওচিত্র বানানো, শিশু-কিশোরদের চলচ্চিত্র নির্মাণ, শিশু-কিশোরদের জন্য গান ও ব্যান্ড দল তৈরি, তাদের জন্য শিক্ষামূলক অনলাইন ভিডিও গেম তৈরির মতো নানা কার্যক্রম।
এহসান হাফিজের ভাষায়, "এই ফাউন্ডেশনের কাজ শুধু নির্দিষ্ট শ্রেণী বা স্থানের বাবা-মা ও শিশুদের জন্য নয়। দেশের প্রত্যন্ত কোনো চর অঞ্চলের পরিবারও যেন 'বাবা মা'র ইশকুল থেকে উপকৃত হয় সে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা"। নিরক্ষর যে অভিভাবকের ছেলে-মেয়ে পড়ালেখা করছে সেসব ছেলে-মেয়েরাই যেন তাদেরকে শেখাতে পারে সেরকম নানা একটিভিটি খাতা ও শিক্ষা উপকরণ অত্যন্ত স্বল্প মূল্যে প্রান্তীয় অঞ্চলে পৌঁছে দিতে কাজ করবে "বাবা মা'র ইশকুল" ফাউন্ডেশন।
আগামী বছরের শুরুতেই "বাবা মা'র আমার বই" নামে প্যারেন্টিং বিষয়ক বই পাওয়া যাবে শিখির শিক্ষা উপকরণের সাথে। সন্তানদের সাথে বাবা মা'র সম্পর্ককে সময়োপযোগী ও সহজ করে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে এই বই।
পরিকল্পিত বিশাল কর্মযজ্ঞের জন্য এখনো পর্যন্ত কোনো আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করেনি এহসান হাফিজের দল। নিজেদের বিনিয়োগ দিয়েই প্রস্তুতি পর্বে নিজেদের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টায় আছেন তারা। ভবিষ্যতে প্রয়োজনে তাদের লক্ষ্যের সাথে একমত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ফান্ডিং গ্রহণ করতে পারেন।
শিক্ষা উপকরণগুলোর মধ্যে "একটিভিটি বুক" ও চাঁদের ক্যালেন্ডার এপর্যন্ত সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বাংলাদেশের বাইরে ভারতেও চাঁদের ক্যালেন্ডার ক্রেতা রয়েছেন। এছাড়া "সুলতানার স্বপ্ন" কুশন-কভার-ব্যাগ-বইটি আলাদাভাবে সমাদৃত হয়েছে গ্রাহকের কাছে। শিখির প্রদর্শনী বা বিক্রয়ের জন্য এখনো তাদের নিজস্ব কোনো আউটলেট নেই। তবে ঢাকার পাঠকসমাবেশ, বেঙ্গল বইসহ উত্তরা ও মিরপুরের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শিখির শিক্ষা উপকরণ পাওয়া যায়। শীঘ্রই বাতিঘর ঢাকাতেও এসব উপকরণ পাওয়া যাবে বলে জানান এহসান হাফিজ। ঢাকার বাইরে দিনাজপুর ও জামালপুরে শিখি ও বাবা মা'র ইশকুল ফাউন্ডেশনের নানা কার্যক্রম বিস্তারের পরিকল্পনা করছেন তারা।
নতুনকে গ্রহণ করতে সাধারণ মানুষের ভয় আর গবেষণার সীমিত সুযোগই শিখি ও বাবা-মার ইশকুল ফাউন্ডেশনের এপর্যন্ত যাত্রায় প্রধান প্রতিবন্ধকতা। "কাজের সময় অপ্রাসঙ্গিক উপদেশ কাজের গতিতে বেশ প্রভাব ফেলে", বলেন এহসান হাফিজ।
আগামীর বিশ্বায়নের পৃথিবীতে শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে বাঙালি ভাষাভাষিদের যোগ্য করে তুলতেই এত আয়োজন শিখির। আমাদের নড়বড়ে শিক্ষাব্যবস্থার একটি সামগ্রিক পরিশিলিত রূপের স্বপ্ন দেখায় শিখির দল। সুপ্ত হিমশৈলের মতো তাদের কার্যক্রমের কেবল উপরি তলটুকুই এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়েছে। সামনের বছরগুলোতে তাদের বিশাল পরিকল্পনার কার্যক্রম পরিপূর্ণভাবে শুরু হওয়ার অপেক্ষায় আছে।