বাচাল সহকর্মীকে কীভাবে সামলাবেন!
পরিবারে যেমন কেউ কেউ থাকে মুখচোরা, কেউবা বেশি সপ্রতিভ। অফিসও তার বাইরে নয়। আপন কর্মক্ষেত্রেও এমন অতি-সদালাপী!সহকর্মীর জ্বালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় অনেকেরই। কাজের কাজ পিছিয়ে যায় নির্ধারিত সময় থেকে।
চাকরির ক্যারিয়ারে আমাদের অনেকেই এমন বিড়ম্বনার মুখে পড়েছি। কাজের চেয়ে কথাতেই যাদের আনন্দ বেশি, তারা প্রায়ই ফোনকলে বা ম্যাসেঞ্জারের বার্তায় ১০ মিনিট জরুরি কাজে কথা বলতে চান। কিন্তু,ভদ্রতার খাতিরে 'হ্যাঁ' সূচক সম্মতি দিয়েছেন, তো ব্যাস সঙ্গেসঙ্গেই কথার ফুলঝুড়ি একথা-সেকথার গলি ধরে থামে এক ঘণ্টা পার করে যায়।
এমন কলিগেরা নিজের অখণ্ড অবসরে 'ঢুঁ' মেরে বসেন আপনার কর্মব্যস্ত ডেস্কে। আবারো আলাপের তুবড়ি ছোটে। একথা-সেকথায় দীর্ঘসময় ধরে বলে যান, সপ্তাহের ছুটি তার কতোটা 'বোরিং' কেটেছে। এদিকে আপনি যে মহাবিরক্তি চেপে বসে আছেন, সেদিকে তার লক্ষ্যই নেই।
অনেক সময় এমন সহকর্মীকে এড়িয়ে চলার উপায়ও থাকে না। আসলে সব ধরনের মানুষকে নিয়েই তো কাজের পরিবেশ। এমন অবস্থাতেই পড়েছিলেন শার্লট নামের এক নারী। সঙ্গতকারণেই তার পুরো পরিচয় ও প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হলো না। কিন্তু, তার প্রতিষ্ঠানের ডেটা সায়েন্স টিমের এক তর্কবাগীশ সহকর্মী বাকি সবার বিরক্তির উদ্রেক করেই চলেছিলেন।
ভদ্রোমহোদয়/ মহোদয়া মিটিংয়ে নিজে যেমন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কথা বলতেন, তেমনি তার জ্বালায় অন্যদের কথা বলাই ছিল দায়। ফলে প্রতিটি মিটিং শেষ হতে নির্ধারিত সময়ের চেয়েও ২০-৩০ মিনিট বেশি সময় লাগতো। ফলে শার্লটের অন্যান্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট পিছিয়ে যায় প্রতিবার। তার সহকর্মীটির কিন্তু এসব দিক নিয়ে মাথাব্যথাই ছিল না, তিনি নিজ বিভাগের তথ্য পরিসংখ্যান আরও জটিলভাবে উপস্থাপনে চেষ্টার কমতি রাখতেন না কিছুতেই।
শেষমেষ প্রতিনিয়ত এই 'মজার অভিজ্ঞতা!' নিজের এক্সিকিউটিভ কোচকে জানালেন শার্লট। অভিজ্ঞ কোচ মেলোডি ওয়াইল্ডলিং বুঝলেন, শার্লটের দরকার ওই লোকটির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করা। তার মানেই রীতিমতো লড়াই নয়, বরং কাজের আলাপের বাইরে অতিরিক্ত কথাবার্তায় লাগাম দেওয়ার সীমা নির্ধারণ।
কিন্তু, এ পরামর্শ শার্লটের মনে ধরলো না। তিনি বললেন, 'সে আমার সময় নষ্ট করছে এটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে আমি তার সাথে রূঢ় আচরণও করতে চাই না। কারণ এই অফিসে আমাকে তার সাথেই কাজ করতে হবে। সে যদি আমাকে ঘৃণা করা শুরু করে, তাহলে কাজের পরিবেশ বিষিয়ে উঠবে।'
মেলোডি এবার বুঝলেন, শার্লট উচ্চ সফলতা অর্জনকারী কর্মীদের কাতারে পড়েন, যাদের ব্যক্তিগত আবেগ ও বিশ্বাস অনেক তীব্রভাবে কাজ করে। এসব গুণাবলী শক্তিশালী নেতৃত্বের হলেও, অনেক সময় তা মানুষকে অযাচিতভাবে কাছে আসার সুযোগ দেয়, যা এড়িয়ে চলার সাথে একেবারেই সাংঘর্ষিক।
অনেক নির্বাহী ও উচ্চ পদস্থ কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া মেলোডির মতে, কারো মনে আঘাত দেওয়ার ভয়ে আপনি বাচালদের সাথে দূরত্বের দেওয়াল না তৈরি করেন, তাহলে এই সয়ে চলার কী মূল্য দেবেন সেটাও আপনাকে ভেবে দেখতে হবে। আপনি যতই ধৈর্য ধরে তাদের কথা শুনুন, তাতে একসময় আপনার নিজের মনই বিষিয়ে উঠবে। মানসিক সুস্থতা ও উৎপাদনশীলতা নষ্ট হবে। তাই নিজে এবং টিমের অন্যদের কথা মাথায় রেখেই আপনাকে সতর্ক কূটনীতিকের মতো একটি উপায় বের করতে হবে।
তার বাৎলে দেওয়া এমন কিছু কৌশলই এখানে আলোচনা করা হলো;
#আলাপের চেষ্টা শুরুতেই ভেস্তে দিন:
আপনাকে প্রথমেই কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত যাদের সাথে কাজ করতে হচ্ছে, তাদের মধ্যে অতিরিক্ত আলাপীদের চিহ্নিত করতে হবে। ফলে আপনি আগে থেকেই তাদের সাথে কীভাবে কথা বলবেন তার পরিকল্পনা ভেবে রাখতে পারবেন। কোনো বৈঠক বা আলাপের আগেই কোন কোন কাজের কথা শুনতে চান, তা জানিয়ে দিন। কথা বলার জন্য আপনার হাতে কতটুকু সময় আছে, কী কাজ বাকি অল্পকথায় তা সাফ সাফ বলে দিন।
যেমন- বলতে পারেন, 'এখন মাত্র ১০ মিনিট কথা বলতে পারি বা মাত্র একঘণ্টার মধ্যেই একটি জরুরি কাজ করতে হবে'- ইত্যাদি। আপনাকে কেন দ্রুত কথা সাড়তে হবে কোনোভাবেই তার ব্যাখ্যা দেবেন না। কারণ, এটা আপনার ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা। আপনি এসময়ে বিশ্রাম নেবেন না অফিসের কাজ করবেন তা আপনার মর্জি।
তাই এভাবে সীমানা নির্ধারণ করে বাচালদের সাথে কথা বলুন। ঠিক যতটুকু সময় দিয়েছিলেন তার মধ্যেই কথা শেষ করলে, সেই ব্যক্তিটিও বুঝে যাবেন আপনার সাথে কথা বাড়ানোর সুযোগ নেই।
আর যদি তা না করেন, তাহলে আপনার অনুরোধ অবজ্ঞা করা বা আপনাকে গুরুত্ব সহকারে না নিলেও যে ক্ষতি নেই, বাচাল সহকর্মীটি সেই বার্তাই পাবেন।
আলাপ দ্রুত শেষ করার দিকে লক্ষ্য রাখুন:
ধরুন ৪৫ মিনিটের মধ্যে একটি বৈঠকে যোগ দিতে হবে সহকর্মীদের এমন সময়সীমা দিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে বসেছেন। নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগেই তাদের সেটি স্পষ্ট করে স্মরণ করিয়ে দিন এবং দ্রুত কথার সমাপ্তি টানার চেষ্টা করুন।
যেমন- 'আপনাদের সাথে আর ১৫ মিনিট কথা বলার সময় পাচ্ছি। তাই আসুন পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলাপ করি' বা 'কথা বলে বুঝলাম,আপনি জনাব 'ক'কে ম্যানেজ করবেন, আর জনাব 'খ'কে সামলানো আমার দায়িত্ব।
আরেকটি কৌশল হতে পারে প্রতিপক্ষের প্রতিই সমাপ্তিসূচক প্রশ্ন রাখা। যেমন- 'আজ তো কথা বলার সময় প্রায় শেষ, আপনিই নাহয় বলুন আমরা শেষপর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নিলাম?' বা 'আজকের ব্রেইনস্টর্মিং সেশন থেকে কী কী আইডিয়া পাওয়া গেল' ইত্যাদি।
কথার মাঝে বাঁধা দেওয়ার কৌশলকে শিল্পের পর্যায়ে রপ্ত করুন:
কথার মধ্যে বাঁধ সাধা নিঃসন্দেহে সৌজন্যের পরিপন্থী। কিন্তু, অপ্রয়োজনীয় আলাপের ভেতর কাজের কথা ঢুকিয়ে দেওয়াটা একটি শিল্প। এজন্য প্রথমে বিনীত কৌশলই ধরুন। যেমন-আমি কী এখানে নিজের আইডিয়া বলতে পারি?' বা হাতের ইশারায় বা আঙ্গুল উঁচিয়ে আপনিও মন্তব্য করতে চান সেই ইঙ্গিত দিতে পারেন।
নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরুন:
সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে 'আমি' শব্দের প্রয়োগে আপনার দৃষ্টিভঙ্গিকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করুন। অর্থাৎ, উত্তম পুরুষ সম্বোধনের ভাষায় কথা বলার চর্চাটি রপ্ত করতে হবে। যেমন-
• হাতের কাজ শেষ করার ডেডলাইন প্রায় শেষ, এখন আমার আলাপ করার সময় খুব কম।
• নিজের সর্বোচ্চটা দিতে হলে মনোযোগ দেওয়ার জন্য আমার কিছুটা একান্ত সময় দরকার। এই প্রয়োজন বোঝার জন্য আপনাকে আগাম ধন্যবাদ জানাই।
• এই মুহূর্তে আমি অনেকগুলো বিষয় নিয়ে ভাবছি। আপাতত এই প্রসঙ্গে বলার মতো কিছু মাথায় আসছে না। আগামী সপ্তাহে কী আপনার সময় হবে?
• আগে এসব বিষয়ে মতামত দিয়েছি, কিন্তু এখন আমায় অন্যান্য কাজকে গুরুত্ব দিতে হচ্ছে ইত্যাদি।
নির্ধারিত সময়ে আলাপ করার প্রতি গুরুত্ব দিন:
বাচাল সহকর্মীটি প্রায়ই হয়তো নানান প্রশ্নের উত্তর জানতে, বা কোনো বিষয়ে পরামর্শ বা দিকনির্দেশনা চেয়ে আপনার ডেস্কে হানা দিচ্ছেন। তাকে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দিন, সব সময় আপনি এমন আলাপে যোগ দেওয়ার অনুরোধ রাখতে পারবেন না। 'অফিসের সময়' যুক্তি দিয়ে অনেকক্ষেত্রে টিম মেম্বারদের অযাচিত আলাপ এড়ানো যায়, এই কৌশল অনেকেই সফলভাবে ব্যবহার করছেন। যেমন-আলাপি কলিগ তার প্রসঙ্গ তোলা মাত্রই বলতে পারেন, আরে এটা তো মজার বিষয়, অফিসের সময় শেষে কী আমরা এনিয়ে আলাপ করতে পারি না?' বা 'আগামী সোমবার সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে চায়ের দাওয়াত নিন, জমিয়ে আলাপ করা যাবে' ইত্যাদি।
#আগে থেকেই কথার গতিপ্রকৃতি ধরার চেষ্টা করুন:
আলাপি সহকর্মীও কৌশলী হতে পারেন। তিনি ছোট্ট একটি কথা তুলে তার প্রতিক্রিয়ায় অন্যদের বাড়তি কথায় উৎসাহিত করতে পারেন। এতে আপনার টিমের কাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাবও পড়ে। এমন অবস্থার সৃষ্টি হলে নিজের সঙ্গে অন্যদের কাজের সম্পর্কটি তুলে ধরুন। এমন আলাপে কতক্ষণ সময় দিতে পারবেন সেটাও স্পস্ট জানিয়ে দিন। সুষ্ঠু কাজের জন্য সকলের সামনে বৈঠকের মূল এজেন্ডা ও গুরুত্ব তুলে ধরে, শুরুতেই বাড়তি আলাপ থামাতে ভূমিকা নিন।
সহকর্মীদের সাথে সীমানা নির্ধারণের কাজটি সহজ নয়,প্রায়শই তা কঠিন। তবে এটি আপনার আস্থা তৈরির একটি চর্চা। প্রতিবার আপনি নিজের স্বাচ্ছন্দ্য, ইচ্ছে-অনিচ্ছা তুলে ধরার মাধ্যমে আপনার কাজকে যে মূল্যায়ন করা উচিত সেই বার্তাই দিতে থাকবেন।
- সূত্র: হাভার্ড বিজনেস রিভিউ