ফুটবলকে যেভাবে অর্থ পাচারে ব্যবহার করা হয়

ইংল্যান্ডের ফুটবল ক্লাব মালিকানা জগতের অন্ধকার দিক এবং কীভাবে সেখানে নিয়মের অপব্যবহার করা হয়, সম্প্রতি আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে।
ইংলিশ ফুটবল ক্লাবগুলোর মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন ও অর্থপাচারের এক বিশাল অন্ধকার অধ্যায়ের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে আল জাজিরার সেই গোপন প্রতিবেদনে।
একজন ফুটবল বিক্রেতা আল জাজিরার প্রতিবেদককে জানায়, কীভাবে একজন মধ্যস্বত্বভোগী ইংলিশ ফুটবল কর্তৃপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে অপরাধীর পরিচয় এবং তার লুট করা অর্থ লুকিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়। এমনকি মিথ্যা নাম পরিচয়ে পাসপোর্ট তৈরিরও ক্ষমতা রয়েছে তার।
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বেন কাউডক বলেছেন, "এই প্রতিবেদন দেখার পর ফুটবল অনুরাগীদের মনঃক্ষুণ্ণ হওয়া স্বাভাবিক; কারণ এখানে ইংলিশ ফুটবল ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাগুলো তুলে ধরা হয়েছে; সেই সঙ্গে সন্দেহজনক উৎস থেকে এবং ক্লাবের মালিকানা 'অনুপযুক্ত ব্যক্তিদের' হাতে দিয়ে তাদের থেকে ফান্ড সংগ্রহ করার ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে"।
আল জাজিরার প্রতিবেদক তার সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে ক্রিস্টোফার স্যামুয়েলসন নামক একজন মধ্যস্বত্বভোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেই ব্যক্তির মাধ্যমেই উঠে আসে এই অন্ধকার জগতের অধিকাংশ রহস্য ও তথ্য। সেই মধ্যস্বত্বভোগীই বলেছেন, কীভাবে সে একজন পরিচয় গোপনকারী ধনাঢ্য চীন দেশীয় অপরাধীর সঙ্গে ইংল্যান্ডের অন্যতম পুরোনো ফুটবল ক্লাব ডার্বি কাউন্টি কেনাবেচার ব্যাপারে চুক্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিলেন।
স্যামুয়েলসন হলেন একজন ট্রাস্ট ফান্ড ম্যানেজার এবং ফুটবল চুক্তি-নির্মাতা যিনি পরিচিতদের কাছে 'দ্য ম্যাজিশিয়ান' বা জাদুকর নামে পরিচিত।

অফশোর অর্থনীতি বিশ্লেষক অ্যাড্রিয়ান গ্যাটন স্যামুয়েলসনের ট্রাস্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তহবিল গোপন করার দক্ষতা সম্পর্কে উদাহরণ দিয়ে বলেন, "তিনি গোপনে একটি আস্ত হাতিও গায়েব করে দিতে পারেন।"
স্যামুয়েলসনের পরিচয় গোপনকারী চীন দেশীয় সেই ক্লায়েন্ট অর্থ পাচারে অভিযুক্ত। তার বিরুদ্ধে তদন্তে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে অর্থ পাচারের ঘটনা উঠে এসেছে, তবে তাকে কখনও শাস্তির আওতায় আনা যায়নি।
ক্যাসিনোর ব্যবসায়ের মাধ্যম চীন থেকে ম্যাকাউতে অর্থ লুটের দায়ে তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। আর এখন সেই লুট করা অর্থ পাচার করতেই তিনি একটি ফুটবল ক্লাব কিনতে চান। এমনটাই বলা হয়েছে স্যামুয়েলসনকে।
স্যামুয়েলসন ক্লায়েন্টের অপরাধে মনোযোগ না দিয়ে, বরং কীভাবে ধাপে ধাপে অফশোর ট্রাস্টের অর্থ ও পরিচয় গোপন করা যায় যেই নির্দেশনা দিয়েছেন তার ক্লায়েন্টকে।
স্যামুয়েলসন বলেন, অপরাধী বিনিয়োগকারীকে ইংলিশ ফুটবল লিগ অনুমোদন দেবে, এই ব্যাপারটি তিনিই নিশ্চিত করবেন। যেকোনো ভাবে তিনি কর্তৃপক্ষকে অন্ধকারে রেখে গোপনে কিংবা বল খাটিয়ে অপরাধীদের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করে থাকেন।
এমনকি স্যামুয়েলসন আল জাজিরার প্রতিবেদককে ডার্বিতেও নিয়ে যান, যেখানে তারা ডার্বি কাউন্টি কেনার জন্য ৯৯ মিলিয়ন পাউন্ডের (১৩৭ মিলিয়ন ডলার) চুক্তি আলোচনা করার জন্য ক্লাবের মালিক মেল মরিসের সঙ্গেও দেখা করেন। মরিস প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে তিনি চুক্তিতে একজন ছোট অংশীদার হয়েই থাকতে চান।
স্যামুয়েলসন দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক ব্যবসার একজন পাকা খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত। বহু বছর ধরে তিনি অফশোর ট্রাস্ট বাজারের এ ধরণের চুক্তি করে থাকেন। ২০০৪ সালে তার কোম্পানি রাশিয়া থেকেও মিলিয়ন ডলার সরাতে সক্ষম হয়েছিলো।
এছাড়া স্যামুয়েলসনের সঙ্গে তার আরও একজন সহযোগী, কেইথ হান্টার রয়েছেন, যিনি একজন ব্যক্তিগত তদন্তকারী এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তারা উভয়েই আল জাজিরার ছদ্মবেশী এই প্রতিবেদককে বলেছেন, কীভাবে তারা চুক্তি করার ক্ষেত্রে অবৈধ কূট কৌশল অবলম্বন করে থাকেন।
এমনকি তারা প্রতিবেদককে প্রতারণার মাধ্যমে নতুন পাসপোর্ট তৈরি করে দেয়ারও প্রলোভন দেখান।
অথচ আল জাজিরার এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর স্যামুয়েলসনের আইনজীবী জানিয়েছেন, তিনি সেই পরিচয় গোপনকারী চীন দেশীয় ক্লায়েন্টের অপরাধ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। ক্লায়েন্টের অপরাধ সম্পর্কে ধারণা থাকলে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই চুক্তি আলোচনা নাকচ করে দিতেন।
অন্যদিকে, হান্টার আল জাজিরার প্রতিবেদনের প্রতিটি বিষয়ই অস্বীকার করেছেন। এবং সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তার অনুকরণীয় সাফল্যের কথাও উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
এছাড়া ডার্বি কাউন্টির মালিক মরিস আল জাজিরাকে বলেন, ক্লাবটি শুধুমাত্র 'যথাযথ জিম্মাদারের' কাছেই বিক্রি করা হবে; স্যামুয়েলসনের সাথে বেশ কিছু সময় ধরে তাদের কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
- সূত্র- আল জাজিরা