পাথরে বিপন্ন প্রাণ ও পরিবেশ
১৩৭ দশমিক ৫০ একর আয়তনের শাহ আরেফিন টিলা। বাইরে থেকে ঠিকঠাক থাকলেও টিলার ভেতরে গেলে দেখা যাবে এর করুণ অবস্থা। পুরো টিলা খুঁড়ে তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য গর্তের। গহীন একেকটা গর্ত। মনে হয় অসংখ্য পুকুর খুঁড়ে রেখেছে কেউ। পাথর উত্তোলনের জন্য ধ্বংস করা হয়েছে বিশাল এই টিলা।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নে সরকারি খাস খতিয়ানের লালচে, বাদামি ও আঠালো মাটির এ টিলার নিচে রয়েছে বড় বড় পাথর খণ্ড। এসব পাথর উত্তোলন করতেই ধ্বংস করা হয়েছে টিলাটি।
সর্বশেষ গত ২ ফেব্রুয়ারি এই টিলার গর্ত থেকে রুবেল মিয়া নামে এক শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে ২০ জানুয়ারি একই এলাকা থেকে আরেক শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এর হিসাব মতে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭৬ জন পাথর শ্রমিক নিহত এবং ২১ জন আহত হয়েছেন।
এ তো গেল শাহ আরেফিন টিলার চিত্র। সিলেটের গোয়ানঘাট উপজেলার জাফলংয়ের চিত্র আরও ভয়াবহ। প্রকৃতি কন্যা হিসেবে পরিচিত জাফলং ছিল সিলেটের অন্যতম পর্যটন সমৃদ্ধ স্থান। তবে অপরিকিল্পিত ও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে জাফলং হারিয়েছে নিজের সৌন্দর্য। পাথর উত্তোলনের ধূলো-শব্দ আর ধ্বংসলীলার কারণে জাফলং এখন পর্যকদের হাহাকারের নাম।
ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে ২০১২ সালে জাফলংয়ের পিয়াইন নদীসহ ১৫ কিলোমিটার এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
পরিবেশের বিপর্যয় ঠেকাতে ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর সিলেটের জাফলং, ভোলাগঞ্জ, শাহ আরেফিন টিলা, বিছনাকান্দি ও লোভছড়া- এই পাঁচ কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এর আগে ২০১৪ সালে বেলা’র দায়ের করা একটি রিটের প্রেক্ষিতে সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোতে সব ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন উচ্চ আদালত।
অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে প্রায় প্রতিদিনই সিলেটের বিভিন্ন কোয়ারিতে অভিযান চালাচ্ছে প্রশাসন। সর্বশেষ ৪ ফেব্রুয়ারি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির কালাইরাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাথর উত্তোলনে ব্যবহৃত আট কোটি টাকার যন্ত্র ধ্বংস করে প্রশাসন। বাঁধ কেটে পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয় ২১টি কোয়ারি। গত ১৫ দিনে ধ্বংস করা হয়েছে অন্তত ১৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। তবু থামানো যাচ্ছে না বেপরোয়া পাথর ব্যবসায়ীদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাই নিয়ন্ত্রণ করেন পাথর কোয়ারিগুলো। তাদের মদদেই পাথর ব্যবসায়ীরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য পাথর উত্তোলন করে।
কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন আচার্য্য বলেন, ‘‘পাথর উত্তোলন একেবারে বন্ধ করতে প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা। পাথর উত্তোলনে এই এলাকায় যে বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে ওঠেছে তা কেবল প্রশাসন অভিযান চালিয়ে বন্ধ করতে পারবে না।’’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি ও শাহ আরেফিন টিলা কেটে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীদের নেতৃত্বে রয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামীম মিয়া।
অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগে ২০১৭ সালে শামীমসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। অভিযুক্তদের প্রায় সকলেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। তবে মামলা দায়ের হলেও তাদের গ্রেপ্তার হতে হয়নি। প্রকাশ্যেই রয়েছেন এলাকায়।
এ ব্যাপারে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শামীম মিয়া বলেন, ‘‘আমি আগে পাথর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। জনপ্রতিনিধি হওয়ার পর এসবের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘‘রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের কারণেই পাথর ব্যবসায়ীদের ঠেকানো যাচ্ছে না। পাথর লুটপাটের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপির একটি বিরল ঐক্য রয়েছে। আওয়ামী লীগ ৭০ শতাংশ ও বিএনপি ৩০ ভাগ পায়। ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়ায় এ নিয়ে তাদের বিরোধ দেখা যায় না।’’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কীম বলেন, প্রশাসনের প্রশ্রয়ে দুর্বৃত্তরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ফলে এখন কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাদের দমন করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া রাজনৈতিক প্রশ্রয় তো রয়েছেই।
সিলেট জেলা প্রশাসক কাজী এমদাদুল ইসলাম বলেন, পরিবেশের সুরক্ষায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। আমাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডেই তার প্রমাণ পাবেন। জাফলংয়ের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে আমরা বদ্ধপরিকর। গোয়াইনঘাটের পাথর ব্যবসায়ীদের আমরা পর্যটন খাতে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করছি। তাতে পাথর শ্রমিকদেরও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।