পঞ্চগড়: হিমালয়ের আশীর্বাদে ঘেরা জীববৈচিত্র্যময় ভূমি
২০১৫ সালে আমি প্রথম পঞ্চগড় যাই 'কালো তিতির' (Black Francolin) নামের এক ধরনের পাখির খোঁজে। বাংলাদেশের সবচেয়ে রহস্যময় এবং বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে অন্যতম এই পাখির অপরূপ সৌন্দর্য্য আপনাকে মুহূর্তেই মুগ্ধ করে দিবে। কিন্তু ছবি তোলা তো দূরের কথা, বিলুপ্তপ্রায় এই পাখিটি আমাদের দেশে দেখা যায়না বললেই চলে।
তবুও পঞ্চগড়ই একমাত্র জায়গা যেখানে ভাগ্য সহায় থাকলে আপনি এই পাখিকে ক্যামেরাবন্দী করার একটা সুযোগ পেতেও পারেন। গ্রীষ্মের প্রখর দিনে সদ্য বোনা ভুট্টা কিংবা আখ ক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে চোখ রাখতে হবে আপনাকে, গভীর মনোযোগের সাথে দ্রুত হাতে আঙুল চালাতে হবে ক্যামেরার শাটারে।
সেবার আমি এবং আমার বন্ধুদের পাখির ছবি তোলা হয়নি। তার বদলে মাঠের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাখির কালো-সোনালি ডানার ঝাপটানি দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল।
২০১৭ তে আবার প্রকৃতির টানে পঞ্চগড় ফিরে গেলাম। এবার খুঁজেছিলাম কালো দোচরা (red-naped ibis) পাখিকে। কালো পালক এবং অদ্ভুত লম্বা ঠোঁটবিশিষ্ট বড় সারস পাখির মতো এই প্রাণীকে অবশেষে বাংলাদেশে দেখা গেল। রাতারাতি খবরটা ছড়িয়ে পড়লো দেশের পাখিপ্রেমীদের মধ্যে। এবার ভাগ্য সুপ্রসন্নই ছিল আমাদের, আমরা ১১ টি কালো দোচরা দেখতে পেয়েছিলাম এবং কিছু সুন্দর ছবিও তুলতে পেরেছিলাম। পাখি দেখার সুবাদে সেবার বেশকিছু বিদেশী বিজ্ঞানী এবং আলোকচিত্রীর সঙ্গেও পরিচয় হয়ে গিয়েছিল।
প্রকৃতি এবং প্রাণীজগতের বৈচিত্র খুঁজে দেখার নেশা পেয়ে বসেছিল আমাকে, তাই পরে আমি আরও বেশ কয়েকবার পঞ্চগড় গিয়েছি। পঞ্চগড়ে আমার সব অভিজ্ঞতাকে যদি এক লাইনে বলতে হয়, তাহলে আমি বলবো পঞ্চগড় অদ্বিতীয় আর সেই সাথে ভৌগলিকভাবেও অসাধারণ এবং জীববৈচিত্র্যে অতুলনীয়।
কাঞ্চনজঙ্ঘার কোমল স্পর্শ
শরতে পঞ্চগড়ের উত্তর আকাশে জেগে ওঠে হিমালয়। বর্তমানে ট্যুরিজম এর যুগে যে কাউকে পঞ্চগড় নিয়ে জিজ্ঞেস করলে সে হিমালয়ের কথাই প্রথমে বলবে। আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে হিমালয়ের তৃতীয় সর্বোচ্চ চূড়া কাঞ্চনজঙ্ঘার নাম নিতে হয়। প্রতি বছর অক্টোবর থেকে নভেম্বরে পঞ্চগড়ের আকাশে উঁকি দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় সৌন্দর্য্য।
হিমালয়ের কোলঘেঁষা জেলা পঞ্চগড়ে রয়েছে ভৌগলিক ও জীববৈচিত্র্যের সবরকম উপাদান। সমতল ভূমি বলে পরিচিত হলেও পঞ্চগড়ে রয়েছে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণের চা বাগান।
এছাড়াও পঞ্চগড়ে আছে পাথরের খনি যার পেছনে রয়েছে মহানন্দা ও করতোয়া নদীর অবদান। এই নদীগুলোই সুদূর পাহাড় থেকে পাথরগুলো বয়ে নিয়ে আসে। ফলে পঞ্চগড়ে ঘুরতে গেলেই নানা বর্ণের ও আকৃতির অসংখ্য পাথর আপনার চোখে পড়বে।
পাখাওয়ালা দ্যুতি
শুধুমাত্র যে কালো দোচরা এবং কালো তিতিরই পঞ্চগড়ের দর্শনীয় পাখি তা নয়, এখানে এত বেশি পাখিদের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায় যে তা বর্ণনা করতে গেলে এক লেখায় শেষ হবেনা। শীতে পঞ্চগড় হয়ে যায় শকুনদের যাতায়াতের একটা অন্যতম পথ। এছাড়াও শকুনের অন্তত চারটি প্রজাতি পঞ্চগড়ে দেখা যায়। শীতকালে যেগুলোর দেখা মেলে তার মধ্যে রয়েছে হোয়াইট রাম্পড ভালচার, সিনেরিয়াস ভালচার, দ্য ইউরাশিয়ান এবং দ্য হিমালয়ান গ্রিফন।
ইন্ডিয়ান গ্রে হর্নবিল নামের বিলুপ্তপ্রায় একটি প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যায় পঞ্চগড়ে। এমনকি বছর দুয়েক আগে পুনরায় পাওয়ার আগপর্যন্ত মনে করা হত যে বাংলাদেশে এই পাখিটি বিলুপ্তই হয়ে গেছে।
পঞ্চগড়ের সরু হ্রদ এবং নদীখাতগুলো শীতকালীন হাঁসদের কাছে একটা প্রিয় জায়গা। নর্দার্ন ল্যাপউইং(তিতির পাখি জাতীয় প্রাণী) এবং অতি বিরল প্রজাতির মারগ্যানসার পাখিও ফি বছর পঞ্চগড়ের দিকে আসে।
কোরালরঙা সাপ
ভাবুন তো পাকা কমলার মত উজ্জ্বল রঙের একটা সাপ দেখছেন চোখের সামনে, ভাবতে পারছেন কি? হ্যাঁ, ঠিক এরকম একটি সাপ বাস্তবেও আছে। আর আমি কোন প্রাচীন যুগের প্রাণীর কথা বলছি না, বলছি আমাদের পঞ্চগড়েই বাস করা এক প্রজাতির সাপের কথা যা সারা বিশ্বেই অত্যন্ত বিরল।
রেড কোরাল কুকরি স্নেক সাপটি পাওয়া যায় মাত্র ২০-২২ ধরণের নমুনার। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে একটি পতিত জমি সাফ করার সময় এর একটিকে জ্যান্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। পঞ্চগড়ের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী ফিরোজ আল সাবাহ এই খবরটি সারা দেশে তুলে ধরেছিলেন। শহীদুল নামের এক স্থানীয় সাপপ্রেমী ব্যক্তি সেই সাপটিকে মুক্ত করেন তখন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা পঞ্চগড়ে এই বিরল প্রজাতির সাপটির বেশকিছু নমুনা বসবাস করে আসছে।
নদীতীরস্থ মাছ
পঞ্চগড় জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীটি শুধুমাত্র যে দামী পাথর বয়ে নিয়ে আসে তা নয়, এর দ্রুত প্রবহমান ,অক্সিজেনসমৃদ্ধ পানি এবং নদী খাদ একটি অনন্য বাস্তুসংস্থান তৈরি করে। আপনি জেনে অবাক হবেন যে পঞ্চগড়ের পানির উৎসগুলো সবচেয়ে কম আবিষ্কৃত হয়ে রয়ে গেছে। এখানের পানিতে যে ধরণের মাছের পোনা, ব্যারিলস, ক্যাটফিশ, বার্বস ইত্যাদি রয়েছে তা খুব কমই অন্যত্র পাওয়া যাবে। এদের অনেকগুলোই হয়ত বিজ্ঞানে একেবারেই নতুন সংযোজন।
একটি মাংসাশী কেন্দ্র
বাঘের পর চিতাকেই ধরা হয় এশিয়াতে বিড়াল প্রজাতির সবচেয়ে বড় প্রাণী। বাংলাদেশকে চিতাবাঘের জন্য একটি রেঞ্জ কান্ট্রি হিসেবে ধরা হয়। তবে আমাদের দেশেও চিতাবাঘ খুবই বিলুপ্তপ্রায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই পঞ্চগড় হতে পারে এই প্রাণীটি সংরক্ষণের জন্য একটি আদর্শ জায়গা।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চা বাগান থাকায় সেখানে চিতাবাঘের সংখ্যাটাও বেশি। এদের কিছু কিছু বাংলাদেশে ঢুকে পড়লেও বেশিরভাগ সময়ে শুধু নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়। গত ছয় সাত বছরে এ ধরণের অন্তত দুটি কেস পাওয়া গেছে পঞ্চগড়ে।
পঞ্চগড়ে কোন বনাঞ্চল না থাকলেও এখানে চিতাবাঘ হানা দেয়াটা দুই ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত এটি সহনশীল এবং বিড়াল প্রজাতির সব প্রাণীর মধ্যে চিতাই সবচেয়ে বেশি অভিযোজিত হতে পারে। ভারতের মুম্বাই নগরীর পাশে চিতার একটি বড় বসতি পাওয়া গেছে। দ্বিতীয়ত, এই চিতাবাঘকে যদি বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলে এনে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে তা প্রাণী সংরক্ষণের এক মাইলফলক তৈরি করবে।

বেঙ্গল ফক্স নামের আরও একটি বিলুপ্তপ্রায় মাংসাশী প্রাণীও আমাদের দেশে রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে এই শেয়ালটি খুবই পরিচিত হলেও এর জীবনধরন সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায়না।
এই বিশাল পরিমাণ প্রাণীবৈচিত্র্য থাকার পরেও পঞ্চগড় এখনও অবহেলিত। আমাদের প্রাণী সংরক্ষণের জন্য পঞ্চগড়কে অবশ্যই স্পটলাইটে নিয়ে আসা উচিৎ। মাসখানেক আগে আমি ফিরোজ আল সাবাহর কাছ থেকে একটি কল পাই।
উত্তরবঙ্গের তীব্র শীতের মধ্যেও সে তখন একদল বন্যপ্রাণী শিকারীকে বাধা দিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং প্রাণীদের প্রতি তার যে ভালোবাসা এবং দায়িত্বশীলতা, তা আমি তার কন্ঠ শুনেই বুঝতে পারছিলাম। গবেষক , বিজ্ঞানী এবং সচেতন নাগরিকদের মধ্যে একটি ভালো নেটওয়ার্ক থাকলেই আমরা এই ব্যাপারে আশার আলো দেখতে পাবো ।