নিজেদের শহর অচেনা লাগছে: ইসরায়েলি হামলায় বদলে গেছে গাজার মানচিত্র
ইসরায়েল-গাজার বিগত কিছুদিনের সংঘর্ষের সময় প্রাণ বাঁচাতে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেওয়া ফিলিস্তিনিরা আবারও নিজেদের আবাসস্থলে ফিরে আসছেন। কিন্তু, নিজেদের স্মৃতির সঙ্গে তারা আর মিল খুঁজে পাচ্ছেন না, বিভিন্ন সড়কের যাতায়াতের পথ, ট্রাফিক সংকেত- কোনো কিছুই আর আগের মতো নেই।
রাস্তায় কিছু দূর পর পর গর্ত, চারপাশে শুধু ধ্বংসস্তূপ। স্থানীয়ভাবে বিখ্যাত বহুতল ভবনগুলোরও অস্তিত্ব নেই।
শুক্রবার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা বিগত দিনগুলোর সংঘর্ষে ৬৬ জন শিশুসহ অন্তত ২৪৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৯০০ জন। ইসরায়েলে হামাসের রকেট হামলায় দুইজন শিশুসহ নিহত হয়েছেন ১২ জন।
গাজা শহরের মূল সড়কের আল-ওয়েহদা সড়ক বেশ কয়েকবার ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় প্রায় ধূলিস্মাত, সর্বশেষ হামলাতেই মারা যান ৪২ জন। আল-ওয়েহদার শেষ প্রান্তে শিফা হাসপাতালে আহত অনেকেই চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়েছেন।
হাসপাতালে ভর্তি ৪০ বছর বয়সী আমজেদ মুর্তজা তার বাসভবনে মিসাইল হামলায় আহত হন।
"ভবনটি সজোরে কাঁপছিল। তখন আমার একমাত্র চিন্তা ছিল কীভাবে আমার স্ত্রী-সন্তানকে নিরাপদে সরিয়ে আনা যায়।"
কিন্তু তিনি অপরকক্ষে যেতেই ভবনটি ধসে পড়তে শুরু করে।
"আমরা সবাই একসঙ্গে নিচে পড়ে যাই।" তার হাত ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যায়, তবে তার স্ত্রী-সন্তান তার আশেপাশেই ছিলেন।
তিনি যখন আটকে পড়ার সময়কার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, হাসপাতালের অন্যান্য রোগী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নিজেদের কাজ থামিয়ে তার কথা শুনছিলেন। ধ্বংসস্তুপে চার ঘণ্টা আটকে থাকার ফলে তার স্ত্রীর মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে।
তার স্ত্রী বলছিলেন, যখন ভবনটি ধসে পড়ে, তিনি প্রথমে বুঝতে পারেননি কী হতে চলেছে। ধ্বংসস্তূপের মাঝে আটকে পড়ার পর তার একমাত্র চেষ্টা ছিল কীভাবে উদ্ধারের আগ পর্যন্ত তার ২ বছর বয়সী শিশু সন্তানকে শান্ত রাখা যায়। তাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করলেও ধসে পড়া ভবনের পাথর-ধূলিকণা ভেসে ভেসে পড়ার কারণে শিশুটি বারবার জেগে যাচ্ছিল।
ওই অঞ্চলে একই হামলায় নিহত হয়েছেন শিফা হাসপাতালের ডা. আয়মান আবু আল-আউফ ও তার পরিবারের একাধিক সদস্য। তিনি হাসপাতালটির করোনা ইউনিটের প্রধান হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন।
ইসরায়েল জানিয়েছে, বেশ কিছু অঞ্চল জুড়ে থাকা সুড়ঙ্গপথ ধ্বংস করাই আল-ওয়েহদায় হামলা চালানোর কারণ ছিল। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ভবনগুলোতে হামলার উদ্দেশ্য ছিল না তাদের।
হামলার এক সপ্তাহ পরে আল-ওয়েহদার দৃশ্যপট একেবারেই পাল্টে গেছে, চারপাশে শুধু ধ্বংসস্তূপ। কিছু জায়গায় ধ্বংসস্তূপের মাঝে উঁকি দিচ্ছে পানির ট্যাংকের ধ্বংসাবশেষ, পানির বোতল, বালিশ, ফ্রায়িং প্যান।
কিছু স্থানে মৃতদের নাম লিখে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আরবিতে লেখা একটি সাইনবোর্ডে লেখা 'আল-ওয়েহদা গণহত্যা'।
ধ্বংসস্তূপের পাশে ট্যাক্সি থেকে নেমে এলেন একজন নারী, সাথে তার কিশোর বয়সী সন্তান। ৪৪ বছর বয়সী জাকিয়া আবু দায়ের জানালেন, তিনি ভেঙে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপে নিজের কিছু জিনিস খুঁজতে এসেছেন।
হামলার আগের রাতে তারা পাশের একটি সড়কে আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। আত্মীয়ের বাসা নিচ তলায় হওয়ায় তারা ভেবেছিলেন, সেখানে থাকা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হবে। কিন্তু দুদিন পরেই তারা যখন খেতে বসেন, সেখানেও হামলা হয়।
"গাজায় কোনো নিরাপদ স্থান নেই। পুরো এলাকায় অন্ধকারে ডুবে যায়" তখনও তার পা ব্যান্ডেজে মোড়া ছিল।
তার কয়েক মিটার দূরে থাকা অবস্থাতেই তার স্বামীর মৃত্যু হয়, তাদের পরিবারের ১১ বছর বয়সী এক শিশুও মারা যায়। ওই অঞ্চলেই বেশ কিছু স্থানীয় দাতব্য সংস্থার কার্যালয় ছিল।
তাদের বাড়ির অপর প্রান্তেই গাজার পুরাতন ক্লিনিকগুলোর মধ্যে একটি ভবনের ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে।
গাজায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক কর্মসূচি বিষয়ক মহাপরিচালক আবদেল আল-হাজ্জ বলছিলেন, "এটিই হয়তো গাজার সবচেয়ে পুরাতন ক্লিনিক ছিল,"
ক্লিনিকটি দেখলে মনে হতে পারে এর ওপর সরাসরি আঘাত হানা হয়েছে। ক্লিনিকের ভবনের বিপরীত পাশের ভবনটিতে মিসাইল হামলার পর ভবনটি ভেঙে ক্লিনিকের ওপর পড়ে, এভাবেই ক্লিনিকের ভবনটিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এই ভবনটিই গাজায় কোভিড টেস্টিংয়ের মূল কেন্দ্র ছিল বলে জানালেন আবদেল আল-হাজ্জ। বিস্ফোরণে ক্লিনিকের ভেতর কর্মরত অনেকেই আহত হন। গাজায় ইতোমধ্যে ভয়াবহ মাত্রায় কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল।
"আমরা টেস্ট করাতে না পারলে কী ঘটতে পারে তা সহজেই অনুমেয়," বলেন তিনি।
এই সংঘাতের ফলে এমনিতেই এক স্থানে বহু মানুষের জমায়েতের ফলে সংক্রমণের আশঙ্কা আরও বেড়েছে।
জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, গাজায় সাম্প্রতিক এসব হামলায় প্রায় ২৬০টি ভবন ধ্বংস হয়েছে। এরমধে রয়েছে ৫৩টি স্কুল, ছয়টি হাসপাতাল ও ১১টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। প্রায় ৮০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, এর দশ গুণ বেশি সংখ্যক মানুষের নেই কোনো নিরাপদ পানীয়ের উৎস।
'বিশ্বের সর্ববৃহৎ জেলখানা' হিসেবে পরিচিত গাজায় প্রায় ২০ লাখ মানুষের বাস, বেকারত্বের হার ৫০ শতাংশ। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাও প্রায় ধসে পড়েছে, লাগাতার বিদ্যুৎ না থাকা বা সুপেয় পানির অভাব তো আছেই। এমন অবস্থাতেই দিন যাপন করছেন এতগুলো মানুষ।
শুক্রবার যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর এবার হয়তো নতুন কোনো সমাধানের পথ উন্মোচিত হবে এমনটাই আশা করছেন অনেকে।
তবে ইসরায়েলে অক্সফামের প্রধান শেন স্টিভেনসন জানিয়েছেন, সাময়িক এই যুদ্ধবিরতিকে সমাধান ধরে নেওয়া উচিৎ হবে না। ১২ দিন ধরে ধরে ইসরায়েল যে নৃশংস, অমানবিক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তার জন্য ইসরায়েলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিৎ। ইসরায়েলের শহরগুলোতে এলোপাথাড়ি হামলার জন্য গাজার সশস্ত্র বাহিনীর জবাবদিহিতার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, "অবৈধ দখলদারত্ব, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত হওয়া অমানবিক কার্যকলাপ থামাতে পারবে না এই সাময়িক যুদ্ধবিরতি। এই অমানবিক ও নৃশংস স্থিতাবস্থা একেবারের জন্য বন্ধ করতে হবে।"
এদিকে, হাসপাতালে শুয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন আহমেদ মুর্তজা। বৃহস্পতিবার থেকেই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসতে পারে এমন কথা শোনা যাচ্ছিল। আহতাবস্থায় এই ঘোষণার অপেক্ষাতেই জেগে ছিলেন তিনি।
"কারণ আমি পরিবারের বাকি সদস্যদের হারাতে চাই না," বলছিলেন তিনি।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান